কুয়েত সিটি-বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী রাষ্ট্র কুয়েতের রাজধানী; যাদের অর্থনীতির মূল উৎস ভূ গর্ভস্থ তেল। পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত হলেও এখানে নেই খাবার পানির প্রাকৃতিক কোনো উৎস। ষোড়শ শতাব্দীতে জেলেদের গ্রাম হিসেবে যাত্রা শুরু হওয়া শহরটিই আজ বিশ্বে অভিবাসীদের অন্যতম শীর্ষ আবাস। কুয়েতের মুদ্রা কুয়েতি দিনার আজ বিশ্বের সবচেয়ে দামি মুদ্রা। চলুন আজ জানি কুয়েত সিটির ইতিহাস; যা জেলেদের আবাস থেকে বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্রের রাজধানী হয়ে উঠেছে।
১৯৬১ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে কুয়েত। রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে কুয়েত সিটির। বিভিন্ন ইতিহাসের সাক্ষী কুয়েত সিটির আভিজাত্য বেশি দিনের নয়। জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগীজরা এ অঞ্চলে একটি দূর্গ তৈরি করে। এরপর এটি জেলেদের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পায়। সপ্তদশ শতকের শুরুতে এখানে আরবীয় যাযাবর আল সাবাহ পরিবার বসবাস স্থাপন করে এ অঞ্চলটিকে শাসন করতে শুরু করে। এরপরই বদলাতে থাকে দৃশ্যপট। উল্লেখ্য, আল সাবাহ পরিবার আল উতুব গোত্রের শাখা ছিল যার মধ্যে বাহরাইনের শাসক খলিফাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
পারস্য উপসাগরে বন্দরকে কেন্দ্র করে এবং রাজপরিবারের সুবিধা নিয়ে বাগদাদ, দামেস্কের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে এ অঞ্চলকে এগিয়ে নিতে থাকে সাবাহ পরিবার। পরবর্তীতে বসরা অবরোধের সময় ইরাকি বণিকেরা কুয়েতে অবস্থান নিলে কুয়েতের সমুদ্র বাণিজ্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। তবে এরপর নানা কারণে কুয়েতের অর্থনীতি অনেকটাই দরিদ্রপ্রবণ ছিল। এমনকি উনিশ শতকে তেল আবিষ্কারের সময়েও অধিকাংশ পরিবারই দরিদ্র ছিল।
তেল আবিষ্কার কুয়েতের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ১৯৪৬ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তেল এবং উদার পরিবেশের সাহায্যে কুয়েত সিটি বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। ফলশ্রুতিতে জেলেদের সেই ছোট এলাকাটিই পরিণত হয় বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্রের রাজধানীতে।
নাগরিক সমাচার
১৭ হাজার ৮২০ কিলোমিটারের দেশ কুয়েতের জনসংখ্যা মাত্র ৪৩ লাখ যাদের বেশিরভাগেরই অবস্থান রাজধানী কুয়েতসিটিতে। দেশটির প্রায় ৭০ ভাগ নাগরিকই বিভিন্ন দেশের প্রবাসী। কুয়েতি নাগরিকদের ৮৫ ভাগই ইসলাম ধর্ম অনুসারী; যার ৪৫ ভাগ সুন্নি এবং ৪০ ভাগ শিয়া সম্প্রদায়। বাকি ১৫ শতাংশ নাগরিকদের মধ্যে খ্রিস্টান, পার্সি, হিন্দু ইত্যাদি বিদ্যমান।
দেশটিতে ধর্ম পালনে বেশ কঠোরতা দেখা যায়। বিভিন্ন ইসলামিক আয়োজনে, যেমন রমজান মাসে কিয়ামুল লাইলের জন্য বহুসংখ্যক মানুষ ভিড় জমায় রাজধানীর গ্র্যান্ড মসজিদে। রমজান মাসে প্রকাশ্যে খাওয়া-দাওয়া ও গানবাজনা আইনত নিষিদ্ধ নগরীতে। এছাড়াও নারীদের কোনো উপহার দিতে হলে অবশ্যই নিজের পরিবারের মহিলা তথা মা, বোন বা স্ত্রীর মাধ্যমে তা পৌঁছাতে হবে। দেশটির সংস্কৃতিতেও ইসলামিক ছাপ স্পষ্ট। আরবি ক্যালিগ্রাফিক শিল্প খুবই প্রশংসনীয় এখানে।
তবে কুয়েতে সম্প্রদায়ভিত্তিক বিভাজন লক্ষ্যণীয়। এখানে ৫ ধরণের বিন্যাস দেখা যায়। সবার উপরে রয়েছে শাসক পরিবার, এরপর পুরোনো কুয়েতি বণিক পরিবার এবং তারপরে বেদুইনদের স্থান।
কুয়েত সিটির অর্থনীতি
তেল আবিষ্কারের পূর্বে কুয়েত সিটির অবস্থান খুব একটা ভালো ছিল না। এমনকি পুরোনো অভিজাত বণিকেরাও নগর ছেড়ে চলে যেতে থাকেন। কিন্তু উনিশ শতকে তেল আবিষ্কার যেন পুরো কুয়েতের ভাগ্যরথই ঘুরিয়ে দেয়। বর্তমানে বিশ্বের ১০ শতাংশ তেল এখানে রিজার্ভ করা রয়েছে এবং কুয়েত সিটি বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম তেল রিজার্ভকারী নগর।
পুরো দেশের অর্থনীতি তেলশিল্পের উপর নির্ভরশীল। কার্যত বিশ্বের অনেক উন্নত দেশই তেলের জন্য কুয়েতের উপর নির্ভরশীল। যার ফলে কুয়েত সিটির ৯৫ ভাগ রপ্তানি আয় আসছে পেট্রোলিয়াম থেকে। যদিও ইরাকের সাথে যুদ্ধে বহু শিল্পকারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এরপরও কুয়েত পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মাথাপিছু আয়ের সূচকে কুয়েত আজ বিশ্বের ৫ম ধনী রাষ্ট্র। কুয়েতি দিনার বর্তমানে সবচেয়ে দামি মুদ্রা, বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি দিনার ২৮৩ টাকা (পরিবর্তনশীল)।
মিঠাপানির হাহাকার
কুয়েতে খাবার পানির প্রাকৃতিক কোনো উৎস নেই। খাবার পানির প্রায় পুরোটাই প্রক্রিয়াজাত ও আমদানি নির্ভর। পারস্য উপসাগর তীরবর্তী এ অঞ্চলে একদিকে যেমন কৃষিজমির সংকট অন্যদিকে তেমনি পানির হাহাকার। তেলের চেয়ে পানির মূল্য বেশি বহুলাংশে।
একমাত্র মাছ ব্যতীত তেমন কোনো নিজস্ব খাদ্য সরবরাহও নেই। প্রক্রিয়াজাত পানি ট্যাংকের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। দেশটির অন্যতম পর্যটন শিল্প কুয়েত টাওয়ার ও মূলত পানির ট্যাংক হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।
পর্যটনে কুয়েত সিটি
পারস্য উপসাগরের তীরে কুয়েত সিটি যেন ভ্রমণপিপাসুদের বিভিন্ন আকর্ষণের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। কুয়েত টাওয়ার থেকে জাতীয় জাদুঘর, মিরর হাউজ, কৃত্রিম দ্বীপ, মিউজিক্যাল ফাউন্টেইন, জাতীয় মসজিদ-প্রতিটি স্থানই পর্যটকদের মুগ্ধ করবে।
কুয়েত টাওয়ার ১৯৭৯ সালের মার্চে নির্মিত হয়। তিনটি সিলিন্ডার টাওয়ার নিয়ে গঠিত স্থাপত্যটির প্রধান টাওয়ারের উচ্চতা ১৮৭ মিটার যার নিচের অংশ পানির ট্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর উপরে রেস্টুরেন্টে বসে পুরো কুয়েত দেখা যায়। মূলত রাতের বেলায় এর মূল সৌন্দর্য্য ধরা পড়ে। বাকি দুটি টাওয়ারের একটি সম্পূর্ণভাবে পানির ট্যাংকি এবং অন্যটি অপর দুটি টাওয়ারের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবহৃত হয়।
পারস্য উপসাগরের বুকে এক টুকরো সবুজ বাগান গ্রীন আইল্যান্ড যা কুয়েত এর কৃত্রিম দ্বীপ। ১৯৮৮ সালে উন্মুক্ত হওয়া এ দ্বীপটি যেন ছুটি কাটানোর অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। পার্ক, ফুটবল খেলার মাঠ, সাইক্লিং স্পেস, সুইমিং পুলসহ আরো অনেক কিছুই আছে আর্টিফিশিয়াল এই দ্বীপটিতে। কুয়েত সিটির খুব কাছেই অবস্থিত এটি।
কুয়েত সিটির অন্যতম নান্দনিক স্থাপনা গ্র্যান্ড মসজিদ যা মসজিদ আল কাবির নামেও পরিচিত। ১৯৮৬ সালে উদ্বোধন হওয়া মসজিদটিতে আল্লাহর ৯৯টি নামের ক্যালিগ্রাফি রয়েছে। এছাড়াও প্রায় ১৩০০ কেজি ওজনের ঝাড়বাতিটিও নজর কাড়বে সবার৷ প্রতি রমজানে বহুসংখ্যক মুসল্লির সমাগম ঘটে এখানে।
অভিবাসীদের স্বর্গরাজ্য
একটি দেশের ৭০ ভাগ নাগরিকই যদি ভিন্ন দেশের প্রবাসী নাগরিক হয় তবে তা অভিবাসীদের রাজ্য বললে ভুল হবে কি? অবাক করা বিষয়, মাত্র ৪৩ লাখ জনসংখ্যার দেশ কুয়েতের ৩০ লক্ষাধিক মানুষই প্রবাসী নাগরিক। আরব অঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকান প্রবাসীদের সংখ্যাই বেশি এখানে। একক সম্প্রদায় হিসেবে প্রথমে ভারতীয় এবং এরপরই মিশরীয়দের অবস্থান।
মূলত নির্মাণ খাত, সেবা খাতসহ বেশিরভাগ অঞ্চলে নিয়োগকৃতরাই প্রবাসীদের মূখ্য অংশ। তবে অভিবাসীদের সহজেই আইনি নাগরিকত্ব দেয় না কুয়েত সরকার। বর্তমানে অভিবাসী নিয়ম বদলাতে যাচ্ছে দেশটি। কারণ হিসেবে বলছে মহামারীর পর দেশটির নাগরিকদের অর্থ সংকট দেখা দিতে পারে। তাই বিদেশি নাগরিকসংখ্যা ৭০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় কুয়েত সিটি। প্রবাসী নাগরিক নিয়ন্ত্রণ বিলের খসড়া প্রস্তাবনাও তৈরি। বিশেষজ্ঞদের কাছে যাওয়ার পর আলোচনা-পর্যালোচনার শেষে গৃহীত পদক্ষেপ মেনে নিয়েই এগুবে কুয়েত সিটি।
Feature Image: pinterest.com References: 01. Kuwait. 02. Places to visit in kuwait. 03. Kuwait City.