কেন দক্ষিন আফ্রিকা পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়েও ধ্বংস করে দিয়েছিল?

320
0

আগুন আবিষ্কার ছিল গুহাবাসী মানুষের সভ্যতার দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রথম ধাপ। এরপর ধীরে ধীরে মানুষ আরো অনেক কিছুই আবিষ্কার করেছে।  আদিম মানুষেরা নিজেদের টিকে রাখার জন্য যেসব হাতিয়ার তৈরী করেছিল, আধুনিক শিক্ষিত মানুষ সেই টিকে থাকার অস্ত্রকেই ব্যাপক বিধ্বংসী রূপ দিয়ে দিয়েছে। তাদের কিছু কিছু আবিষ্কার শুধুই মানুষকে হত্যা করার জন্য, বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

হানাহানি বা যুদ্ধের ময়দানের জন্য যে বিশেষ অস্ত্রগুলো ব্যবহার করা হয় পারমানবিক অস্ত্র তারই একটি। পৃথিবীর মানুষ পারমাণবিক অস্ত্রের সাথে প্রথম পরিচিত হয় ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে। যখন আমেরিকা ‘লিটল বয়’ এবং ‘ফ্যাটম্যান’ নামে দুইটি পারমাণবিক অস্ত্র জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহর দুইটিতে নিক্ষেপ করে। সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধ্বংসযজ্ঞের সাথে সাথে পৃথিবীবাসী প্রথম পরিচিত হলো নতুন এক বিধ্বংসী মারনাস্ত্রের সাথে।

প্রতিটা দেশই কোনো না কোনোভাবে অপর একটি দেশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। হোক সেটা সরাসরি বা স্নায়বিক। রাজনীতিতে ভারসাম্য আনতে প্রতিটি রাষ্ট্রকেই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি সামরিকভাবেও শক্তিশালী হতে হয়। আর এজন্যই প্রতিটি দেশ প্রতি বছর সামরিক সুরক্ষায় বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকে।

১৯৪৫ সালে পারমাণবিক বোমার প্রথম বিস্ফোরনের পর এর ক্ষয়-ক্ষতি দেখে পুরো পৃথিবী আতঙ্কিত হলেও রাজনৈতিক নেতারা যেন আলাদিনের চেরাগ খুঁজে পেলেন। এবং এরই ধারাবাহিকতায় আমেরিকার পাশাপাশি পৃথিবীর আরো সাতটি দেশ পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে, যারা প্রতিনিয়ত তাদের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে এখনো।

হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামলা। Image Source: wikimedia.commons

যেখানে বিশ্বের প্রতিটি দেশের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে উন্নত করা সেই তালিকায় একমাত্র ব্যাতিক্রম দেশ হচ্ছে দক্ষিন আফ্রিকা। যারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরী করার পরও তা আবার ধ্বংস করে দিয়েছিল। দক্ষিন আফ্রিকা ছাড়াও বেলারুশ, কাজাখস্তান এবং ইউক্রেন তাদের কাছে থাকা পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু দক্ষিন আফ্রিকার ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

যে তিনটি দেশের কথা বলা হয়েছে সেই দেশ তিনটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির চাপে পড়ে একরকম কোনঠাসা হয়ে তাদের কাছে থাকা পারমাণবিক বোমা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু দক্ষিন আফ্রিকা সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব অর্থায়ন ও প্রযুক্তিতে তৈরী পারমাণবিক বোমা ধ্বংস করেছিল যার রক্ষণাবেক্ষণের সম্পূর্ণ সামর্থ্য তাদের ছিল। যদিও এই পরমাণু বোমা ধ্বংসের পেছনে জোরদার রাজনৈতিক কারণ ছিল। তবুও এটি ছিল বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি বিশাল পদক্ষেপ।

তবে  হঠাৎ করেই কেন দক্ষিন আফ্রিকা পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়ার কাতারে শামিল হতে চাইলো তা জানতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। পৃথিবীব্যাপী চলা স্নায়ুযুদ্ধ এই ব্যাপারে বিশাল একটি ভূমিকা পালন করেছিল। এই স্নায়ুযুদ্ধ পুরো পৃথিবীকে দুইটি ভাগে ভাগ করে ফেলেছিল। যার একপাশে ছিল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো, যাদের অভিভাবক ছিল আমেরিকা। আরেক ভাগে ছিল কমিউনিস্ট/সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো যাদের অভিভাবক ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।

অধীনস্থ রাষ্ট্রগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা আমেরিকার কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে আসছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর পুনর্গঠনের জন্য ‘মার্শাল প্ল্যান’ নিয়ে আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের অনুগতরাষ্ট্রগুলোকে ‘মলোটোভ প্ল্যান’ এর অধীনে মোটামুটি বড় অংকের সহায়তা প্রদান করেছিল।

মার্শাল ও মলোটোভ প্ল্যানের পোস্টার। Image Source: lumenlearning.com

আমেরিকার এই সাহায্যের উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে এই দেশগুলোর আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কমিউনিজম/সমাতান্ত্রিক ভাবনা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। অপর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্দেশ্য ছিল সর্বস্তরে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়া।

স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুইদেশই নিরপেক্ষ দেশগুলোকে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করে আসছিল।বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতার পাশাপাশি আমেরিকা ১৯৬৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় প্রথম পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণের জন্য। তারা পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামও সরবরাহ করে।

কিন্তু বিশ্বব্যাপী নিন্দিত বর্ণবাদী সরকারের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিল না। একইসাথে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফ্রিকার দেশগুলোতে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছিল।

দক্ষিন আফ্রিকায় বর্ণবাদের প্রচলন থাকায় তারা পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সমর্থন পাচ্ছিলো না। এমতাবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুদ্ধ বেঁধে গেলে আমেরিকা কোনো সাহায্য করবে না এই ভয়ে দক্ষিন আফ্রিকা নিজেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরীর সিদ্ধান্ত নেয়। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ দেশটির জন্য পারমাণবিক বোমা তৈরির মূল উপকরণ ইউরেনিয়াম অতি সহজলভ্যই ছিল বলা যায়।

সাউথ আফ্রিকার ইউরেনিয়াম খনি। Image Source: belfarcenter.org

কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র তৈরীর কথা বিশ্বদরবারে ফাঁস হয়ে গেলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের একটা ভয় ছিল। তবুও খুব গোপনে ১৯৬৭ সালে একটি পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পের গোপনীয়তা এতটাই তীব্র ছিল যে মন্ত্রীসভার সব মন্ত্রীরাও এই সম্পর্কে জানতেন না।

১৯৭৯ সালে দক্ষিন আফ্রিকা প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরী করতে সক্ষম হয়। এর ১০ বছর পর ১৯৮৯ সালে এফ. ডব্লিউ ডি ক্লার্ক যখন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হোন তখন দেশটির হাতে ৬টি পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ আছে এবং ৭মটির নির্মাণকাজ প্রায় অর্ধেক সমাপ্ত হয়ে গেছিল।

এরপর ঘটতে লাগলো একের পর এক ঘটনা। জার্মানির বিভেদে বার্লিন প্রাচীরের পতন, এ্যাঙ্গোলা থেকে কিউবার সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার এবং সবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন।

যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হতে চেয়েছিল সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙ্গে গেলো তখন দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন নেতাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্রগুলোকে বাহুল্য মনে হতে লাগলো এবং তারা সেগুলো ধ্বংস করার মতো যুগান্তকারী এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন।

দক্ষিণ আফ্রিকার পারমাণবিক অস্ত্র। Image Source: stanford university

একই বছর মানে ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা তার সবগুলো পারমাণবিক বোমা ধ্বংস করে ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করে ফেলে।

পুরো পৃথিবীতে যখন প্রতিটি রাষ্ট্র নিজেদের পারমাণবিক শক্তিধর দেখাতে পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার সমৃদ্ধ করছে সেই সময়ে এসে দক্ষিন আফ্রিকা রক্ষণাবেক্ষণের সামর্থ্য, পর্যাপ্ত লোকবল থাকার পরেও পারমাণবিক বোমার সম্ভার ধ্বংস করার এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এক মাইলফলক হয়ে থাকবে।

 

Feature Image: Foreign Affairs 
References: 

01. South Africas 16 years secret nuclear bomb. 
02. South Africa says it built 6 atom bombs.
03. South Africa Nukes. 
04. South Africa. 
05. South Africa.