উইনস্টন চার্চিল ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক। ২০০২ সালে বিবিসি কর্তৃক এক জরিপে উইনস্টন চার্চিল সর্বকালের সেরা ব্রিটন নির্বাচিত হন। প্রাচুর্যের মাঝে বেড়ে উঠলেও তিনি ছিলেন জনদরদী ব্যক্তি। তিনি আদর্শবাদী ও বাস্তববাদী মানুষ ছিলেন। নানাবিধ প্রতিভার অধিকারী এই সৈনিক ছিলেন প্রগতিশীল সামাজিক সংস্কারের একজন প্রবক্তা এবং গণতন্ত্রের একজন রক্ষক; বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়।
চার্চিল ১৯৪০-১৯৪৫ এবং ১৯৫১-১৯৫৫ সাল পর্যন্ত গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৪০ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন অক্ষশক্তিকে পরাজিত করতে এবং যুদ্ধোত্তর শান্তি স্থাপনের জন্য একটি সফল মিত্র কৌশলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
তবে ভারতীয় উপমহাদেশে তার ভূমিকার জন্য তিনি একজন খলনায়ক। কারণ তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩০ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর জন্য তাকেই দায়ী করা হয়।
উইনস্টন চার্চিলের পুরো নাম স্যার উইনস্টন লিওনার্ড স্পেন্সার চার্চিল। তিনি ১৮৭৪ সালের ৩০শে নভেম্বর ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডশায়ারের ব্লেনহাইম প্যালেসে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা লর্ড র্যান্ডলফ চার্চিল মার্লবোরোর প্রথম ডিউকের বংশধর ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন।
তার মা জেনি জেরোম ছিলেন একজন ধনী আমেরিকান। চার্চিলের নানা ছিলেন বিলিয়নিয়ার এবং দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর আংশিক মালিক।
চার্চিল আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে বেড়ে ওঠেন। যেহেতু চার্চিলের বাবা-মা ভ্রমণ এবং সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকতেন তাই শৈশবে চার্চিল আয়া এলিজাবেথ এভারেস্টের কাছেই লালিত পালিত হয়েছেন। ইনি চার্চিলকে আদর ও স্নেহের সাথে লালন-পালন করেছিলেন এবং শৈশবের অনেক অসুস্থতার সময়ও তার যত্ন করেছিলেন।
১৮৮২ সালে চার্চিল সেন্ট জর্জ স্কুলে ভর্তি হন। কিন্ত তিনি স্কুল পছন্দ করতেন না। লেখাপড়ায়ও ততটা মনোযোগী ছিলেন না। তিনি স্বাধীনচেতা ছিলেন তাই স্কুল জীবনের নিয়মানুবর্তিতা তার স্বাধীন চেতনার সাথে খাপ খায়নি। সেন্ট জর্জে মাত্র দুই বছর থাকার পর তাকে ব্রাইটনের একটি স্কুলে পাঠানো হয় যেখানে তিনি এমন কিছু শিখেছিলেন যা তাকে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে। যেমন- ইতিহাস, কবিতা, ঘোড়ায় চড়া এবং সাঁতার।
এরপরে চার্চিল ১৮৮৮ সালের এপ্রিলে লন্ডনের কাছে হ্যারো প্রিপ নামের একটি বোর্ডিং স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। এখানে ভর্তি হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি হ্যারো রাইফেল কর্পসে যোগদান করেন। হ্যারো থেকে পাশ করার পর, চার্চিল ১৮৯৩ সালে স্যান্ডহার্স্টের রয়্যাল মিলিটারি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৯৪ সালের ডিসেম্বরে চার্চিল ভালো ফলাফল করে স্নাতক হন এবং একজন অশ্বারোহী অফিসার হিসাবে কমিশন পান।
এই সময় পর্যন্ত তার মা-বাবা উভয়ের সাথেই তার দূরত্ব ছিল, যদিও তিনি তাদের উভয়কেই ভালোবাসতেন। স্কুলে পড়াকালীন চার্চিল তাকে দেখতে আসার জন্য অনুরোধ করে তার মাকে আবেগঘন চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু তার মা কমই আসতেন তাকে দেখতে। ২১ বছর বয়সে যখন চার্চিলের বাবা মারা যান তখনও তাদের দূরত্ব ঘোচেনি।
সৈনিক জীবনে সাত মাস প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর চার্চিল প্রথম ছুটি পান। কিন্ত ছুটি কাটাতে তিনি বাড়িতে যাওয়ার পরিবর্তে যুদ্ধ দেখতে চেয়েছিলেন; তাই তিনি স্প্যানিশ সৈন্যদের যুদ্ধের কার্যক্রম দেখতে কিউবা ভ্রমণ করেন। পাশাপাশি তিনি লন্ডনের দ্য ডেইলি গ্রাফিক-এর যুদ্ধ সংবাদদাতা হওয়ার সুযোগ পেয়ে যান। এখান থেকে তার দীর্ঘ লেখালেখির জীবনের শুরু হয়।
ছুটি শেষ হলে, চার্চিল তার রেজিমেন্টের সাথে ভারতে ভ্রমণ করেন। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে তার প্রথম বই ‘দ্য স্টোরি অফ দ্য মালাকান্দ ফিল্ড ফোর্স’ (১৮৯৮) লিখেছেন।
চার্চিল তারপরে সুদানে লর্ড কিচেনারের অভিযানে যোগ দেন এবং তিনি দ্যা লন্ডন মর্নিং পোস্টের জন্যও লেখালেখি করেন। সুদানের অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে ‘দ্য রিভার ওয়ার’ (১৮৯৯) লিখেছিলেন। ১৮৯৯ সালে দ্য লন্ডন মর্নিং পোস্ট তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বোয়ার যুদ্ধের কভার করতে পাঠায়, কিন্তু তিনি সেখানে শত্রু সৈন্যদের দ্বারা বন্দী হন।
পরবর্তীতে বাথরুমের জানালা দিয়ে পালানোর খবর সাহসী চার্চিলকে ব্রিটেনের একজন ইয়াং সেলিব্রিটি করে তুলেছিল। তিনি এই অভিজ্ঞতাগুলি নিয়ে একটি বই লেখেন যার শিরোনাম ছিল, ‘লন্ডন টু লেডিস্মিথ ভায়া প্রিটোরিয়া’ (১৯০০)।
১৯০০ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে তিনি ওল্ডহ্যাম থেকে কনজার্ভেটিভ পার্টির এম.পি. নির্বাচিত হন। এটি ছিল চার্চিলের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের শুরু। স্পষ্টভাষী চার্চিলের দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণির জন্য সহানুভূতি ছিল। তিনি শুল্কের বিরুদ্ধে এবং দরিদ্রদের জন্য সামাজিক পরিবর্তনের সমর্থনে বক্তৃতা দেন। এসব কারণে কনজার্ভেটিভ পার্টির সদস্যদের সাথে মতবিরোধ দেখা দিলে তিনি কনজার্ভেটিভ পার্টি ছেড়ে ১৯০৪ সালে লিবারেল পার্টিতে চলে যান।
১৯০৫ সালে লিবারেল পার্টি জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং চার্চিলকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করা হয়। তার নিষ্ঠা এবং দক্ষতা তাকে খ্যাতি এবং পদোন্নতি এনে দেয়। ১৯০৮ সালে তাকে বোর্ড অফ ট্রেডের সভাপতি এবং ১৯১০ সালে স্বরাষ্ট্র সচিব করা হয়।
চার্চিল খুব ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন তিনি প্রায় ধারাবাহিকভাবে বই, প্রবন্ধ এবং বক্তৃতা লিখছিলেন। এরই মাঝে উইনস্টন চার্চিল ১৯০৮ সালের মার্চ মাসে ক্লেমেন্টাইন হোজিয়েরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই বিয়ে টিকেছিল। এই দম্পতির পাঁচটি সন্তান ছিল।
১৯১১ সালের অক্টোবরে চার্চিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ফার্স্ট লর্ডের দায়িত্ব পান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আভাস পেয়ে চার্চিল গ্রেট ব্রিটেনকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলেন। এজন্য তিনি রয়্যাল নেভাল এয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, ব্রিটিশ নৌবহরকে আধুনিকীকরণ এবং যুদ্ধজাহাজগুলোতে তেল চালিত ইঞ্জিন ব্যবহারের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু ১৯১৫ সালে তুরস্কের গ্যালিপোলিতে সামরিক পরাজয়ের পর চার্চিল এই অ্যাডমিরালটি ত্যাগ করেন।
প্রায় দুই বছর রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পর ১৯১৭ সালে চার্চিলকে আবার আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং যুদ্ধের মন্ত্রীর পদ দেওয়া হয়। পরের বছর তাকে যুদ্ধ ও বিমানের জন্য সেক্রেটারি অফ স্টেট মনোনীত করা হয়। নানা ঘটনাপ্রবাহের পর চার্চিল পুনরায় কনজার্ভেটিভ পার্টিতে যোগ দেন।
১৯৩৩ সালে নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার পর চার্চিল তার দেশবাসীকে জার্মান জাতীয়তাবাদের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার চার্চিলের সতর্কবাণী উপেক্ষা করে। ১৯৩৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেন জার্মানির সাথে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্ত হিটলার চুক্তি ভঙ্গ করেন এবং পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। তখন ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে চেম্বারলেন পদত্যাগ করেন এবং উইনস্টন চার্চিল ১৯৪০ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
ঐ সময়ই জার্মানিরা ফ্রান্স,ব্রিটেন ও আরও কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের উপর হামলা শুরু করে। যদিও ভবিষ্যতের সময়টা খারাপ হওয়ারই ছিল তবুও চার্চিল ব্রিটিশদের অনুপ্রাণিত করার জন্য সংসদে এবং রেডিওতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বক্তৃতা দেন।
সেইসাথে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট ও মিত্রবাহিনীকে যুদ্ধাস্ত্র যেমন-গোলাবারুদ, বন্দুক, ট্যাঙ্ক, প্লেন-সরবরাহ করতে রাজি করিয়ে ছিলেন। চার্চিলের কৌশলি যুদ্ধনীতি ও সবার সম্মিলিত নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ঘটে।
কিন্ত এত অবদান সত্ত্বেও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চার্চিল প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে হেরে যান ও বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। তিনি বিখ্যাত ‘আয়রন কার্টেন’ বক্তৃতায় ব্রিটেন এবং আমেরিকানদের সোভিয়েত সম্প্রসারণবাদের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এরপরে ১৯৫১ সালে পুনরায় তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে ৮০ বছর বয়সী উইনস্টন চার্চিল অসুস্থতার কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এরই মাঝে চার্চিল তার চার খণ্ডের ‘অ্যা হিস্ট্রি অফ দ্যা ইংলিশ স্পিকিং পিপলস’ (১৯৫৬-১৯৫৮) শেষ করেন এবং লেখালেখি, বক্তৃতা ও ছবি আঁকা চালিয়ে যান।
১৯৫৩ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ উইনস্টন চার্চিলকে অর্ডার অফ দ্য গার্টারের “নাইট” উপাধি দেন। একই বছরে চার্চিল সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি চার্চিলকে সম্মানসূচক মার্কিন নাগরিকত্ব প্রদান করেন।
১৯৬৫ সালে এই মহান রাজনীতিবিদ মারা যান। মৃত্যুর ৩৭ বছর পরে ২০০২ সালে বিবিসির জরিপে উইনস্টন চার্চিল সর্বকালের সেরা ব্রিটন নির্বাচিত হন। তার জীবনী নিয়ে মুভিও বানানো হয়েছে।
স্যার উইনস্টন চার্চিলের জীবনী আলোচনায় তার ভালো দিকগুলো উঠে আসলেও কিছু মন্দ দিকও পাওয়া যায় যা হয়ত আড়াল করে রাখা হয়। এমনি একটি ঘটনা হল ভারতীয় উপমহাদেশের মন্বন্তর। ১৯৪৩ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ মারা যায়; যার নেপথ্যে ছিল চার্চিলের নীতি। ঐ সময় চার্চিল ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ ভারতে তার নেওয়া নীতি বাঙালির জন্য ছিল অকল্যানকর।
এজন্য তিনি ছিলেন বাঙালির কাছে এক ভয়ংকর শাসক। চার্চিলের ধারণা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জাপানীরা বার্মা দখল করতে এসে যদি কোন কারণে বাংলা ও বিহার দখল করে, তাহলে তারা যেন খাদ্যদ্রব্য লুট করতে না পারে এবং খাদ্যের অভাবেই যেন তাদের মৃত্যু ঘটে।
চার্চিলের নির্দেশ অনুযায়ী এসব এলাকা থেকে সব ধরণের খাদ্য সংগ্রহ করে অন্যত্র গুদামজাত করা হয়। যাতে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ব্রিটিশ সৈন্যদের কোনো প্রকার খাদ্য সংকট না হয়।
জানা যায়, ঐ সময় তিনি ইউরোপের জন্যও খাদ্য গুদামজাত করেছিলেন। অথচ তখন বাংলাজুড়ে চলছিল চরম দুর্ভিক্ষ। এই কারণ ছাড়াও চার্চিল ছিলেন বর্ণবাদী। তিনি এশীয়, আফ্রিকান ও রেড ইন্ডিয়ানদের এমন চোখেই দেখতেন।
Feature Image: pinterest.com References: 01. Winston Churchill. 02. Biography of Sir Winston Churchill, Prime Minister of the UK. 03. Winston Churchill. 04. Sir Winston Churchill: A biography.