দেখতে দেখতে শেষ হয়ে আসছে পবিত্র রমজান মাস এবং রমজান শেষই দেখা মিলবে ঈদের চাঁদ। পালিত হবে মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। ঈদের দিন সকালে মসজিদসহ বিভিন্ন স্থানেই ঈদ জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়।
এরকমই একটি স্থান হচ্ছে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান, যেখানে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় ঈদ জামায়েত অনুষ্ঠিত হয়। বিখ্যাত এই ঈদগাহ ময়দান সম্পর্কেই জানুন আজকের এই আয়োজনে।
ইতিহাস
১৭৫০ মতান্তরে ১৮২৮ সাল থেকে শোলাকিয়া মাঠে ঈদ জামায়েত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। দলিল ও নথি অনুযায়ী শোলাকিয়া ঈদগাহের বয়স প্রায় ২৭১ বছর। প্রতিষ্ঠার ৭৮ বছর পর ১৮২৮ সালে এই ময়দানে প্রথম বড় জামায়েতে ১ লাখ ২৫ হাজার মুসল্লি একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেন।
সেখান থেকেই যাকে বাংলায় সোয়া লাখও বলা হয়, এই মাঠের নাম হয়েছে ‘সুয়ালখিয়া’, যা পরবর্তীতে বিবর্তিত হয়ে শোলাকিয়া হিসেবে পরিচিতি পায়।
পরবর্তীতে, কিশোরগঞ্জ হয়বতনগরের প্রাক্তন দেওয়ান মান্নান দাদ খান ১৯৫০ সালে ওয়াকফ দলিলের মাধ্যমে ৪.৩৫ একর জমি উপহার দেন এবং বর্তমানে ঈদগাহে সাত একর জমি রয়েছে। এই ঈদগাহটি নরসুন্দা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত।
তৎকালীন পাকিস্তান আমল ও ব্রিটিশ শাসনামলে এই মাঠে সুদূর আসাম ও কুচবিহার থেকে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলিম ঈদ নামাজ পড়তে এখানে আগমন করতেন। পবিত্র ঈদে এই জামায়াতে এখনও জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল অসংখ্য মুসল্লি সাথে অন্যান্য অঞ্চলের হাজারো মুসলমান অংশ গ্রহন করেন।
বৃহত্তর ময়মনসিংহ ছাড়াও সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, নরসিংদী, ঈশ্বরদীসহ কয়েকটি জেলা থেকে অনেক মুসলিম নামাজ আদায় করতে আসেন। পাকিস্তান আমলে থেকেই এই মাঠে দুর দুরান্ত থেকে লোক আসার জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা রাখা হয়।
এই ময়দানে টানা তিন ঈদের নামাজ আদায় করতে পারলে একবার হজ্ব করার সওয়াব পাওয়া যায় বলে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস রয়েছে। এই কারণে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান ‘গরিবের মক্কা’ নামেও পরিচিত। প্রতি বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পাশাপাশি বিদেশি মুসল্লিরা এই ঈদগাহ ময়দানে ঈদুল ফিতর নামাজ আদায় করেন।
আয়তন
কিশোরগঞ্জ মৌজায় এই মাঠের মূল আয়তন বর্তমানে ৬.৬১ একর। নিচু দেয়াল ঘেঁষে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে মোট ২৬৫টি সারি রয়েছে যেখানে দেড় লাখেরও বেশি মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করেন। এছাড়াও মাঠে জায়গা স্বল্পতার কারণে একই সংখ্যক মুসল্লি ঈদগাহ সংলগ্ন ফাঁকা জায়গা, রাস্তা ও আশপাশ এলাকায় দাঁড়িয়ে সবচেয়ে বড় ঈদ জামায়াতে অংশ নেন।
প্রখ্যাত আলেমগণ ঐতিহ্যবাহী এই মাঠে ইমামতি করেছেন বলে জানা গেছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রথম বড় জামায়াতের পর যারা নামাজের ইমামতি করেছেন তারা হলেন- হযরত মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ হযরত উল্লাহ, হযরত মাওলানা পেশওয়ারী, হযরত মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন, আলহাজ্ব মাওলানা হামিদুল হক, হযরত মাওলানা আব্দুল গণি, হযরত মাওলানা মাজহারুল হক, হযরত মাওলানা আতহার, হযরত মাওলানা আব্দুল মান্নান, হযরত মাওলানা আবুল খায় মুহাম্মদ নুরুল্লাহ ও মাওলানা আবুল খায় মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ।
আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ২০০৯ সাল থেকে ঈদ জামায়াত নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তবে, ২০১৬ সালে ঈদ জামায়াত শুরুর আগে জঙ্গি হামলার ঘটনায় মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বড়বাজারের ইমাম হাফেজ মাওলানা শোয়েব আবদুর রউফ স্থলাভিষিক্ত হন।
প্রসঙ্গত, গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশ ওলামা-মাশায়েখ সংহতি পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ সভাপতিত্বে জামায়াত অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে ঈদ জামায়েত অনুষ্ঠিত না হওয়ায় আবারও জামায়েত অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। তবে ২০২২ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুনরায় ঈদ জামায়েত চালু করার অনুমতি দেয়। তারই ধারাবাহিকতাক্রমে, এই বছর ১৯৬ তম ঈদ জামায়েত এই বিখ্যাত ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হবে।
শোলাকিয়া ঈদগাহ ব্যবস্থাপনা কমিটি মুসল্লিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চার স্তর নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখার ব্যবস্থা করে থাকে।পুরো শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানকে মোটা নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা হয় এইসময়ে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, পুলিশ ও গোয়েন্দার পাশাপাশি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মোট পাঁচ প্লাটুন মোতায়েন থাকে। সিসিটিভি ক্যামরা ছাড়াও ড্রোন মোতায়েন করা হয়।
যেকোন জরুরী প্রয়োজনে দুটি ফায়ার টেন্ডার ও অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত থাকে ও দুইটি বিশেষ ট্রেন শোলাকিয়া এক্সপ্রেস নামে ভৈরব-কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ রুটে চলে যাতে যে কেউ এই বৃহত্তম ঈদ জামায়াতে যোগ দিতে পারেন।
এনটিভি ২০০৬ সালে ঈদ জামায়াত একটি সরাসরি সম্প্রচার আয়োজন করেছিল। ২০০৭ সাল থেকে চ্যানেল আই নিয়মিতভাবে ঈদ জামায়াত সম্প্রচার করে আসছে। এছাড়া অন্যান্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রতিবছর এই ঈদ জামায়াত খবর প্রচার করে থাকে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সকাল-সন্ধ্যা আন্তঃনগর ট্রেনে কিশোরগঞ্জ পৌঁছানোর পর মাত্র ১৫/২০ টাকায় রিকশা ভাড়া করে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে পৌঁছানো যায়। এছাড়াও, সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে নন-এসি অন্যান্য সুপার, ট্রাভেল, ঈশা খাঁ বাস সার্ভিস বা এসি ট্রাভেল বাসে করে।
কিংবা মহাখালী বাস স্ট্যান্ড থেকে নন-এসি অন্যান্য, অন্যান্য ক্লাসিক বাসের মাধ্যমে যেতে পারবেন। বিভিন্ন জেলা থেকে রিজার্ভ বাসে করে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানে সমবেত হন ভক্তরা। নামাজ শেষে তারা বাসে করে রওনা দেন।
ধনী-গরীব নির্বিশেষে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে প্রতি বছর ঈদুল ফিতর দিনে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে নামাজ আদায় করেন। এ যেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
Feature Photo: thedailystar.net Sources: 01. Sholakia Eidgah Maidan. 02. Sholakia Eidgah represents Kishoreganj’s heritage. 03. Sholakia hosts Asia's largest Eid Jamaat. 04. Country’s largest Eid congregation is held at Sholakia.