বিস্তীর্ণ নীলসমুদ্র। তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্ল্যাটফর্ম, নাম তার সিল্যান্ড। এটি নাকি পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশ। কি অবাক লাগছে তো? আসলে অবাক হওয়ার মতোই বিষয়। কারণ, পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষই এই নামটি সম্পর্কে অপরিচিত। আর সবাই এতদিন শুনে আসছে যে ভ্যাটিকান সিটি হল বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম দেশ। তবে সিল্যান্ড দেশটির কম করে হলেও ৫৫ বছর বয়স। এই দেশ সম্পর্কে অবাক হবার মতো সব তথ্য নিয়েই আজকের আয়োজন।
ইংল্যান্ডের উপকূল থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে গভীর উত্তর সাগরে অবস্থিত সিল্যান্ড বা প্রিন্সিপালিটি অব সিল্যান্ড আসলে একটি মাইক্রোনেশন বা অনুরাষ্ট্র। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, এই দেশের মোট জনসংখ্যা মাত্র ২৭ জন। আছে নিজস্ব জাতীয় পতাকা, পাসপোর্ট, মুদ্রা ও রাজধানী। এই তথ্যগুলো শুনে কপালে ভাঁজ পড়লেও বিশ্বাস করতেই হবে যে এটা কোনো রূপকথার গল্প নয় একেবারে বাস্তব।
এই দেশটির আয়তন প্রায় চার হাজার বর্গমিটার। বিশ্বের অন্য কোন দেশ সিল্যান্ডকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখনো বিশ্বের সবচেয়ে ছোট দেশ ভ্যাটিকান সিটি। তবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের যা যা থাকা দরকার তার সবই আছে সিল্যান্ডের। তথাকথিত ক্ষুদ্রতম দেশটির রাজধানীর নাম এইচ এম ফোর্ট রাফ। মুদ্রার নাম সিল্যান্ড ডলার। যার মান আমেরিকান ডলারের সমমূল্যের হলেও বাইরের কোন দেশে এই মুদ্রা চলে না।
সিল্যান্ড-ই একমাত্র দেশ যার কোন মাটি নেই। দুটি পিলার এর উপর বসানো ইস্পাতের পাটাতনটি হলো দেশটির সার্বভৌম এলাকা। দেশটিতে একটিমাত্র বাড়ি আছে। যেটি সিল্যান্ডের রাজপ্রাসাদ। আর এই রাজপ্রাসাদের উপরই সিল্যান্ডের পতাকা উড়তে দেখা যায়। এটি আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত একটি সমুদ্র বন্দর। মূলত সিল্যান্ডের এই অবকাঠামো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল।
জার্মানরা যে কোনো সময় ইংল্যান্ডে আক্রমণ করতে পারে এই ধরনের আশঙ্কা থেকে ব্রিটিশ সেনা ও নৌ বাহিনী ইংল্যান্ডের উপকূলে বেশ কিছু দুর্গ নির্মাণ করে। এদের একসাথে বলা হতো মানসেল ফোর্ট বা দুর্গ। এসব দুর্গ থেকে শত্রুর যুদ্ধ জাহাজগুলো নজরদারি করা হতো। প্রয়োজনে সেসব জাহাজে আক্রমণ পরিচালনার ব্যবস্থাও ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ব্রিটিশ বাহিনীরা নিজেরাই কিছু দুর্গ বোমা মেরে ধ্বংস করে ফেলে। আর কিছু দুর্গ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়ে যায়। ১৯৪৩ সালে তৈরি হওয়া এসব দুর্গগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ‘রাফস টাওয়ার।’ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অনেক বছর এটি খালি ও ভগ্ন অবস্থায় পড়েছিল। যুদ্ধের সময় এখানে ১৫০- ৩০০ জন সৈন্য অবস্থান করতো। এছাড়া, এখানে ছিল বিভিন্ন রাডারের যন্ত্রপাতি, ৬ ইঞ্চি বন্দুক এবং দুটি ৪০ মিলিমিটার অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট অটোমেটিক কামান। ১৯৫৬ সালে বৃটিশ রয়েল নেভি এই টাওয়ারকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।
আয়তনে এত ছোট দেশ হলেও আশ্চর্যজনকভাবে সিল্যান্ডের একটি বড় ইতিহাস রয়েছে। এর অস্তিত্বের গত পাঁচ দশকে এই মাইক্রোনেশন রাজকীয় মৃত্যু, জিম্মি পরিস্থিতি, অঞ্চল বিরোধ এমনকি হেলিকপ্টার যুদ্ধ দেখেছে! ১৯৬৭ সালে প্যাডি রয় বেটস নামে একজন ব্রিটিশ সেনাদলের অবসরপ্রাপ্ত মেজর এই পরিত্যক্ত সমুদ্র দুর্গ দখল করে নেয় এবং এটিকে সিল্যান্ডের প্রিন্সিপালিটি ঘোষণা করে। ষাটের দশকে প্রথমভাগে প্যাডি রয় বেটস প্রথমে অন্য একটি সমুদ্র দুর্গ ‘নকজন ‘এ রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠা করেন। যার নাম ছিল রেডিও এসেক্স।
সেই সময়ে এই ধরনের রেডিও স্টেশন প্রতিষ্ঠা করা নীতিবিরুদ্ধ কাজ ছিল। তাই একে পাইরেট রেডিও স্টেশন বলা হতো। যদিও এই রেডিও স্টেশন ব্রিটিশ নাগরিকদের কাছে খুবই উপভোগ্য ছিল। কেননা সেই সময় এই রেডিও স্টেশন পপ সঙ্গীত ও বিভিন্ন মজাদার অনুষ্ঠান সম্প্রচার করত। আর সেগুলো সেই সময় বিবিসি করতো না। কিন্তু তিনি নানা ঝামেলার কারণে পরবর্তীতে ‘রাফ টাওয়ার’ দুর্গে তার রেডিও স্টেশনটি স্থানান্তরিত করেন যা ব্রিটিশ আঞ্চলিক জলসীমার ঠিক বাইরে ছিল।
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কারনে যখন বেটসের জন্য সম্প্রচার করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে তখন তিনি তার রেডিও ক্যারিয়ার ছেড়ে দেন। কিন্তু তিনি ফোর্ট রফস টাওয়ারের উপর তার কর্তৃত্ব ছাড়েননি। ১৯৬৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বর, বেটস দুর্গটিকে ‘প্রিন্সিপালিটি অব সিল্যান্ড’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি তারিখটি বেছে নিয়েছিলেন কারণ এটি ছিল জোয়ানের জন্মদিন এবং দুর্গটিকে তিনি স্ত্রীকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে দেন। গত ৫০ বছর ধরে, তার পরিবার এই ‘মাইক্রোনেশন’ চালিয়েছে যেন এটি একটি বাস্তব দেশ, যদিও এটি কখনই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হয়নি। আজ, সিল্যান্ডের নিজস্ব সংবিধান, নিজস্ব পতাকা এবং এমনকি নিজস্ব সরকারী নীতিবাক্য, যার অর্থ ‘সমুদ্র থেকে, স্বাধীনতা’ আছে।
কিন্তু এর পরের বছরই সিল্যান্ডকে মুখোমুখি হতে হয় আরেক বিপদের। ১৯৬৮ সালে, ব্রিটিশ শ্রমিকরা তাদের নৌ-চলাচলের জন্য সিল্যান্ডের প্রিন্সিপ্যালিটিতে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল। বেটস জাহাজটির দিকে সতর্কীকরণ গুলি ছোড়েন। যদিও তিনি তখন একজন ব্রিটিশ প্রজা ছিলেন তাই তাকে যুক্তরাজ্যের আদালত তলব করেছিলেন। সংঘটিত অপরাধটি দেশের জলসীমার ৩ নটিক্যাল মাইল সীমার বাইরে থাকায় তাকে শাস্তি দেওয়া হয়নি এবং এইভাবে ব্রিটিশ সরকারের বেটস এর বিরুদ্ধে করা মামলাটি এগোতে পারেনি। তখন বেটস সিল্যান্ডে মুদ্রা এবং পাসপোর্টসহ একটি সংবিধান, একটি জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীত প্রবর্তন করেছিলেন।
১৯৭০ এর দশকে, বিশ্বের তথাকথিত ক্ষুদ্রতম দেশটিতে প্রায় ৫০ জন মানুষ বসবাস করতে এসেছিল। তারা বেশিরভাগই বেটস পরিবারের বন্ধুবান্ধব ছিলেন। বেটস পরিবার তখন তাদের নাগরিকদের জন্য দুর্গটিকে যতটা সম্ভব অতিথিপরায়ণ করার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, তারা প্ল্যাটফর্মের ফ্ল্যাটটপে একটি বায়ু চালিত জেনারেটর ইনস্টল করেছিল। যা সিল্যান্ডের ভেতরে ১০টি ঘরে স্পেস হিটারগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছিল। এই ১০টি কক্ষের মধ্যে একটি রান্নাঘর, একটি বসার ঘর এবং একটি চ্যাপেল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কিছুটা নিয়মিতভাবে, একটি নৌকা সিল্যান্ডে খাবার, পানীয়, সংবাদপত্র এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসত।
১৯৭৮ সালে, আলেকজান্ডার আচেনবাখ নামে একজন জার্মান ব্যক্তি নিজেকে সিল্যান্ডের প্রকৃত ‘প্রধানমন্ত্রী’ বলে দাবি করেছিলেন এবং দুর্গে একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন। প্যাডি রয় বেটস দুর্গ থেকে দূরে থাকাকালীন সময়ে তিনি ভাড়াটেদের একটি দল নিয়ে হেলিকপ্টারে করে সিল্যান্ডে যান এবং প্রিন্স মাইকেলকে জিম্মি করেন। জবাবে, তার বাবা পাল্টা আক্রমণ করেন, যার ফলে বেশিরভাগ জার্মান পালিয়ে যায়। অবশ্য সিল্যান্ডের অস্তিত্ব তখনও সম্পূর্ণ সুরক্ষিত ছিল না। ১৯৮০ এর দশকে, সমুদ্রের আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘের কনভেনশন দুর্গটিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য যুক্তরাজ্যের আঞ্চলিক জলসীমা বাড়িয়ে দেয় এবং যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর স্পষ্টভাবে সিল্যান্ডের বৈধতা অস্বীকার করেছে; কারণ দুর্গটির একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করার মতো কোন বৈশিষ্ট্যই ছিল না।
পরবর্তী বছরগুলিতে, সিল্যান্ড কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। ১৯৯০ এর দশকে, বেটস পরিবারকে সিল্যান্ড পাসপোর্ট বাতিল করতে হয়েছিল; কারণ সেগুলি জালিয়াতির জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০০৬ সালের ২৩ শে জুন সিল্যান্ডে একবার অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগে। এই দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ইংল্যান্ডের উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার এসে সিল্যান্ডের লোকজনকে উদ্ধার করে।
বর্তমানে সিল্যান্ডের নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সকল রসদ সংগ্রহ করা হয় নিকটবর্তী ইংল্যান্ডের এসেক্স কাউন্টি থেকে। তাছাড়া, সিল্যান্ডের ভেতরে রয়েছে সুপেয় জলের ব্যবস্থা। পর্যটক হিসেবে চাইলে আপনি সিল্যান্ড ভ্রমণ করতে পারবেন না। তাই সিল্যান্ড কর্তৃপক্ষ আগ্রহীদেরকে তাদের ওয়েবসাইট ঘুরে দেখার অনুরোধ করেন। তাছাড়া, চাইলে আপনি সিল্যান্ডের ওয়েবসাইট থেকে সম্মানসূচক পদবী, পরিচয়পত্র এবং বিভিন্ন ধরনের সিল্যান্ডের পণ্য ক্রয় করতে পারবেন। এমনকি দশ বছরের জন্য সিল্যান্ডের কয়েক ইঞ্চি জায়গা কেনার সুযোগ রয়েছে। যদিও সেই জায়গায় কখনো সশরীরে যেতে পারবেন না।
Feature Image:
References:
01. How Sealand Became The Smallest ‘Country’ In The World.
02. Smallest country of the World: All You Need To Know About Sealand.
03. THE PINT-SIZE NATION OFF THE ENGLISH COAST.