অনেককাল আগের কথা, তুনুপা নামের এক দেবী কুসকু নামক এক যুবকের প্রেমে পড়েছিলেন। কুসকু তুনুপাকে বিয়ে করেছিল। তাদের সুখেই দিন কাটছিল আর ফুটফুটে এক সন্তানও হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পরই কুসিনাকে নিয়ে কুসকু পালিয়ে যায়। বিষয়টি জানতে পারে যখন সে তার ছেলেকে দুধ পান করাচ্ছিল।
মনের কষ্টে, নিজের অজান্তেই তার চোখ হতে জল ঝরে। সেই অশ্রু আর দুধের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয় সালার (লবণের সমতল ভূমি)। আয়মারা (আন্দিজ অধিবাসী) সম্প্রদায়ের কাছে তুনূপা গুরুত্বপূর্ণ দেবী হিসাবে বিবেচিত। তুনুপাকে আগ্নেয়গিরি ও উর্বরতার দেবী মানে তারা। তাই স্থানীয়রা এই প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্যের নাম দেয়, সালার দে তুনুপা। পরবর্তীতে যার নাম হয় সালার দে উয়ুনি।
সালার দে উয়ুনি দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে অসাধারণ আকর্ষণগুলির মধ্যে একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০০ মিটার উপরে এবং বলিভিয়ার ৪ হাজার বর্গমাইলেরও বেশি বিস্তৃত, সালার দে উয়ুনি বিশ্বের বৃহত্তম এবং সর্বোচ্চ লবণের ফ্ল্যাট বা সমতল ভূমি।
সালার দে উয়ুনি অর্থ কী?
ইংরেজিতে সালার দে উয়ুনি (Salar De Uyuni) এর অর্থ, মোটামুটি সোজা। স্প্যানিশ ভাষায়, সালার মানে সল্ট ফ্ল্যাট এবং উয়ুনি (Uyuni) হলো সবচেয়ে কাছের শহরের নাম। আয়মারা ভাষা থেকে Uyuni এর অনুবাদ হলো কলম বা ঘের। তাই এটিকে, ঘেরসহ লবণের সমতল বা উয়ুনিকে লবণের সমতল ঘের হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
সালার দে উয়ুনি আদতে কী?
দক্ষিণ বলিভিয়ার আল্টিপ্লানো অঞ্চলে এর অবস্থান। এখানে আনুমানিক ১০ বিলিয়ন টন লবণ রয়েছে। তবে, স্থানীয়দের জন্য আসল কল্যাণটি লুকিয়ে আছে লবণ ভূমির নিচে, সেটা হলো লিথিয়াম। বিশ্বের বৃহত্তম লিথিয়াম রিজার্ভ হিসাবে কাজ করে, সালার দে উয়ুনি।
পৃথিবীর অন্য কোথাও এত পরিমাণ লিথিয়ামের মজুদ নেই। বিশ্বের মোট চাহিদার ৭০% লিথিয়ামের মজুদ রয়েছে সেখানে। লিথিয়ামের মজুদ ও পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়তার কারণে এই সালার দে উয়ুনি বলিভিয়ার অর্থনীতিতে একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে।
১৮৯০ সালে খুঁজে পাওয়া যায় এই সালার দে উয়ুনিকে, স্ল্যাভ এবং সিরিয়ার উপনিবেশবাদীদের সহায়তায় এটাকে একটি রেল জংশন এবং খনির বাজার কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়, পরবর্তীতে উপনিবেশবাদীদের সহায়তায় এটি সমৃদ্ধ হয়েছিল।
খনিজ মূল্য কমে গেলে উয়ুনি তার গুরুত্ব হারায়, কিন্তু পর্যটনের মাধ্যমে এটি আবার তার জনপ্রিয়তা ফিরে পায়। শহরটি উয়ুনি সল্ট ফ্ল্যাট এবং ইনকাহুয়াসি দ্বীপে ভ্রমণের শুরুর পয়েন্ট হিসেবেও পরিচিত লাভ করে।
ভূ-ইতিহাস কী বলে?
সালার দে উয়ুনি ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস বেশ কয়েকটি বিস্তীর্ণ হ্রদের পর্যায় ক্রমিক রূপান্তরের সাথে জড়িত। প্রায় ৩০,০০০ থেকে ৪২,০০০ বছর আগে। তখন এলাকাটি এক বিশাল প্রাগৈতিহাসিক মিনচিন হ্রদের অংশ ছিল। এই হ্রদের বয়স অনুমান করা হয়েছিল রেডিওকার্বন ডেটিং, শেলগুলির আউটক্রপিং পলি এবং কার্বনেট রিফ থেকে। কিন্তু বিভিন্ন স্টাডি রিপোর্টে এর বয়সের একটা তারতম্য লক্ষ্য করা যায়।
মিনচিন হ্রদ (অরুরোর জুয়ান বি. মিনচিনের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়) পরবর্তীতে প্যালিও লেক টাউকায় রূপান্তরিত হয় যার সর্বোচ্চ গভীরতা ১৪০ মিটার (৪৬০ ফুট), এবং উৎসের উপর নির্ভর করে আনুমানিক বয়স ১৩,০০০ থেকে ১৮,০০০ বা ১৪,৯০০ থেকে ২৬,১০০ বছর।
সর্বকনিষ্ঠ প্রাগৈতিহাসিক হ্রদ ছিল কোইপাসা, যেটার রেডিওকার্বন করা হয়েছিল এবং বয়স দেখায় ১১,৫০০ থেকে ১৩,৪০০ বছর আগে। যখন এটি শুকিয়ে যায়, তখন দুটি আধুনিক হ্রদ, পুপো এবং উরু উরু এবং দুটি প্রধান লবণের সমতল ভূমি, সালার ডি কোইপাসা এবং বৃহত্তর সালার দে উয়ুনি এর উৎপত্তি হয়।
সালার দে উয়ুনি ১০,৫৮২ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোনভিলের সল্ট ফ্ল্যাটের আকারের প্রায় ১০০ গুণ বেশি। লেক পুপো, লেক টিটিকাকার অনেক বড় একজন প্রতিবেশী, সেটা অবশ্য তার আকারের দিক থেকে। বর্ষার মৌসুমে, টিটিকাকার পানি উপচে পড়ে এবং লেক পুপোতে বহির্গত হয়, যার ফলস্বরূপ, সালার ডি কোইপাসা এবং সালার দে উয়ুনিতে বন্যা হয়।
সালার দে উয়ুনির পৃষ্ঠের নিচে রয়েছে, লবণ ও ব্রাইন মিশ্রিত লবণ পরিপূর্ণ ল্যাকস্ট্রিন কাদা। ব্রাইন হলো পানিতে সোডিয়াম ক্লোরাইড, লিথিয়াম ক্লোরাইড এবং ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইডের একটি সম্পৃক্ত দ্রবণ। সালার এর কেন্দ্রে কয়েকটি দ্বীপ রয়েছে, যা মিনচিন হ্রদের যুগে নিমজ্জিত প্রাচীন আগ্নেয়গিরির শীর্ষের অবশিষ্ট অংশ, এর মধ্যে রয়েছে অস্বাভাবিক এবং ভঙ্গুর প্রবাল-সদৃশ কাঠামো এবং প্রায়শই জীবাশ্ম এবং শ্যাওলা নিয়ে গঠিত।
বৃষ্টি হয়?
এই অঞ্চলের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা নভেম্বর থেকে জানুয়ারিতে ২১ ডিগ্রী সে. এবং জুনে সর্বনিম্ন ১৩ ডিগ্রী সে.। সারাবছর রাতে ঠান্ডা থাকে, তাপমাত্রা−৯ এবং ৫ ডিগ্রী সে. এর মধ্যে থাকে। আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশ কম এবং সারাবছর ৩০% থেকে ৪৫% পর্যন্ত স্থির থাকে। এপ্রিল এবং নভেম্বরের মধ্যে প্রতি মাসে ১ থেকে ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে, তবে এটি জানুয়ারিতে ৮০ মিলিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ
সালার দে উয়ুনি’র কঠোর পরিবেশ এখানের উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবনের উন্নতির ক্ষেত্রে একটি বাঁধার সৃষ্টি করেছে, তবে এখনও কিছু উল্লেখযোগ্য প্রজাতি রয়েছে। সালার দে উয়ুনি উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পর্কে এখানে কিছু মূল বিষয় রয়েছে-
উদ্ভিদের জীবন
লবণের সমতলের শুষ্ক এবং লবণাক্ত অবস্থা সত্ত্বেও, এখনও কিছু উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে যেগুলি এই এলাকায় টিকে থাকতে সক্ষম। এর মধ্যে রয়েছে হ্যালোফাইট, যা লবণাক্ত পরিবেশে বসবাসের জন্য অভিযোজিত, এবং ক্যাকটি, যা শুষ্ক সময়ের মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য তাদের কান্ডে জল সঞ্চয় করতে পারে।
আশেপাশের এলাকার অন্যান্য উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ইলারেটা (Azorella compacta) এবং কুইওনা (Polylepis tarapacana) গাছ।
প্রাণীর প্রজাতি
সালার দে উয়ুনি’র আশেপাশে কয়েকটি প্রাণীর প্রজাতি পাওয়া যায়, যদিও তারা সংখ্যায় তুলনামূলকভাবে কম। এর মধ্যে রয়েছে আন্দিয়ান ফ্ল্যামিঙ্গো, যারা লবণের সমতলের চারপাশে অগভীর জলের শেওলা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
সেই সাথে ভিকুনাস, লামাস এবং আলপাকাস, যা স্থানীয় সম্প্রদায়ের দ্বারা লালিত গৃহপালিত প্রাণী। এই এলাকায় দেখা যেতে পারে এমন অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে রয়েছে আন্দিয়ান শিয়াল, আন্দিয়ান বিড়াল এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
সংস্কৃতি
সালার দে উয়ুনি’র একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ইতিহাস রয়েছে, কারণ এটি হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের কার্যকলাপের একটি স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সালার দে উয়ুনি‘র সংস্কৃতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে এখানে কিছু মূল বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।
আদিবাসী সম্প্রদায়
সালার দে উয়ুনি’র আশেপাশের অঞ্চলে হাজার হাজার বছর ধরে ছিল আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস, যার মধ্যে রয়েছে আয়মারা এবং কেচুয়া সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়গুলি ঐতিহ্যগতভাবে তাদের জীবিকার জন্য লামা এবং আলপাকা পশুপালনের পাশাপাশি কৃষি এবং লবণ খনির উপর নির্ভরশীল ছিল।
লবণ খনন
যুগের পর যুগ ধরে, লবণ খনন এই অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত, যেখানে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলি সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করে লবণের ফ্ল্যাট থেকে লবণ আহরণ করতো। তারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে লবণ ব্যবহার করেছে, যার মধ্যে রয়েছে খাদ্য সংরক্ষণ এবং এই অঞ্চলে মুদ্রা হিসেবে।
বাণিজ্যিক রুট
সালার দে উয়ুনি শতাব্দী ধরে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, কারণ এটি বেশ কয়েকটি প্রধান বাণিজ্য রুটের পাশে অবস্থিত যা দক্ষিণ আমেরিকার বাকি অংশের সাথে আন্দিয়ান অঞ্চলকে সংযুক্ত করেছে। এই রুটগুলি মহাদেশ জুড়ে টেক্সটাইল, ধাতু এবং লবণের মতো পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
ঔপনিবেশিক প্রভাব
১৬ শতকে এই অঞ্চলে স্প্যানিশ উপনিবেশকারীদের আগমন, এলাকার সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল। স্প্যানিশ উপনিবেশকারীরা নতুন প্রযুক্তি এবং উৎপাদন পদ্ধতি, যেমন রূপালী খনির প্রবর্তন করে এবং এই অঞ্চলে নতুন শস্য ও পশুসম্পদ নিয়ে আসে।
পর্যটন
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, সালার দে উয়ুনি ক্রমেই একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, যা এর অনন্য সৌন্দর্য এবং সংস্কৃতির জন্য বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে।
ঘুরতে যাওয়া যায়?
যেহেতু সালার দে উয়ুনি একটি পর্যটন কেন্দ্র আর এটার উপর নির্ভর করে সেখানকার অর্থনীতি। অবশ্যই ঘুরতে যাওয়া যাবে। তবে সব পর্যটন কেন্দ্রেরই একটা নিদির্ষ্ট সময় থাকে ঘুরতে যাওয়ার সালার দে উয়ুনির ক্ষেত্রে মার্চ এবং এপ্রিলের মধ্যে যাওয়াটাই উত্তম হবে। কারণ অনেকে মিরর ইফেক্ট দেখার আশায় সালার ডি ইউনিতে যান ওই সময়টাতে সেই ইফেক্ট দেখার একটা সুবর্ণ সুযোগ থাকে।
সালার দে উয়ুনি হলো বিশ্বের বৃহত্তম লবণের সমতল এবং একটি অনন্য ভূতত্ত্ব, যা সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে। বিস্তৃত লবণের ফ্ল্যাটগুলিতে প্রতিফলিত হয় আকাশ, রঙিন করে উপহ্রদ।
এলাকাটির একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে, যেখানে আদিবাসী সম্প্রদায়, লবণ খনি, বাণিজ্য পথ এবং ঔপনিবেশিক প্রভাব সবই এলাকার পরিচয়ে অবদান রাখে। প্রকৃতির হাত ধরে টিকে থাকুক এই অনন্য সৌন্দর্য।
Feature Image: discovery.com References: 01. Salar De Uyuni 02. Bolivia’s Magical Salt Flats 03. Salar de Uyuni Info