বৈচিত্রময় সাহারা মরুভূমি

1025
0

মরুভূমি নিয়ে কথা উঠলেই সাহারা মরুভূমির নামই মাথায় আসে। কেননা, এই মরুভূমি নিয়ে মানুষের বিস্ময়ের কোন শেষ নেই। রহস্য যেন ঘিরে রেখেছে এই মরুভূমিকে চর্তুদিক থেকে। সাহারা আরবী শব্দ যার অর্থ ‘মরুভূমি’। শতবছর ধরে এই মরুভুমি মানুষকে আকর্ষিত করেই চলছে। বেদুঈনের দল, বিস্তৃত বালুরাশি, রাতের আকাশে তারার মেলা সব মিলিয়ে সাহারা এক অনন্য প্রাকৃতিক বিস্ময়ের নাম। আমাদের আজকের আয়োজন বিস্ময়কর সাহারা মরুভূমির বিভিন্ন তথ্য দিয়েই সাজানো।

আয়তন ও অবস্থান

বিশ্বের সবচাইতে বড় মরুভূমি কোনটি এমন প্রশ্নের উত্তরে আসে সাহারা মরুভূমির নাম। কিন্তু আদতে এটা ভুল ধারণা। কারণ বিশ্বের সবচাইতে বড় মরুভূমি সাহারা নয়। পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমি হলো এন্টার্কটিকা এবং তারপরের অবস্থানেই জায়গা করে নিয়েছে আর্কটিক অঞ্চল। আর সাহারা মরুভূমি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তর মরুভূমি। তবে ট্রপিক্যাল ডেজার্ট বা উষ্ণ মরুভূমির হিসাব করতে গেলে সাহারার নামই আসবে সবার আগে। কারণ, এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম উষ্ণ মরুভূমি। প্রায় ৩৬ লক্ষ বর্গমাইল বা ৯২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে বিশাল সাহারা মরুভূমির পরিধি। 

সাহারার অবস্থান উত্তর আফ্রিকায়। মিশর, সুদান, সাদ, লিবিয়া, নাইজার, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মালি, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, পশ্চিম সাহারা মোট এগারোটি দেশ সাহারা মরুভূমির অংশ। উল্লেখ্য, পশ্চিম সাহারা কোন সার্বভৌম দেশ নয় বরং বর্তমানে এটি মরক্কোর অংশ।  

সাহারা মরুভূমির অদ্ভুত সৌন্দর্য। Image source: Firstpost.com

সাহারার অতীত ও বর্তমান

শুনলে অবাক লাগলেও অতীতে সাহারা মরুভূমি ছিল উর্বর। যার ফলে পুরোদমে কৃষি কাজ চলতো সাহারায়, জনবসতিও  ছিল এখানে। বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে জানা যায়, সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ একটি মাত্র টেকটোনিক প্লেটের ওপর অবস্থিত। সুদূর অতীতে আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে ছিল টেথিস সাগর। প্রায় চার কোটি বছর আগে টেকটোনিক প্লেটের গতিশীলতার কারণে এটি উত্তরের দিকে সরে এসে আফ্রিকা ও ইউরোপকে একসঙ্গে মিলিত করে দেয়। ফলস্বরুপ আফ্রিকার উত্তর অংশ সংকীর্ণ হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক ওপরে উঠে যায়। এরপর সময়ের সাথে ধীরে ধীরে পানি কমতে থাকে এবং একটি পর্যায়ে বিস্তর এলাকা নিতে তৈরি হয় সাহারা মরুভূমি। 

অন্য সব মরুভূমি থেকে বেশ আলাদা গঠন এই মরুভূমির। সাহারাতে মাত্র ৩০ শতাংশ শতাংশ জুড়ে বালি আর ৭০ শতাংশ হলো গ্র্যাভেল। ভূগর্ভস্থ পানির বিশাল ভান্ডার সাহারা। বিজ্ঞানীদের মতে, সাহারা মরুভূমির নিচের ভূগর্ভস্থ পানি মরূদ্যান জেগে ওঠার মূল কারণ। ছোট বড় মিলিয়ে বেশ কিছু নদী রয়েছে সাহারায়। তবে এগুলো সবই ঋতুনির্ভর ও বিচ্ছিন্ন অবস্থানে অবস্থিত। এছাড়াও প্রায় ২০টি হ্রদ রয়েছে সাহারায়। তবে খাওয়ার উপযোগীর দেখা মিলে শুধু মাত্র সাদ লেকেই। 

আবহাওয়া   

পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম স্থানগুলোর মধ্য সাহারার অবস্থান সবার উপরে। এর কারণ পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের তুলনায় সাহারায় সূর্যের স্থায়িত্ব সবচাইতে বেশি। গঠনগত কারণে মরুভূমির বেশিরভাগ অংশই ৮২ শতাংশের অধিক সূর্যরশ্মি পায় বছরে। আর সাহারার পূর্বাঞ্চলে বছরে প্রায় ৯১ শতাংশ, অন্যভাবে বলা যায় সাহারা মরুভূমি বছরে ৪ হাজার ঘণ্টা সূর্যরশ্মির মধ্যে থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবে এই অঞ্চল দিনে অনেক গরম থাকে। প্রয়োজনের তুলনায় গাছপালা কম এই অঞ্চলে। অন্যদিকে বৃষ্টিপাত কম হয় এখানে। গ্রীষ্মকালে ৩৮-৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার কারণে অসহনীয় হয়ে পরে সাহারা। রাতে অবশ্য অবহাওয়ার তুমুল পরিবর্তন আসে, অন্যসব মরুভূমির মতো সাহারাতেও রাতে অনেক ঠান্ডা নামে। 

যত দূর চোখ যায় কেবল বিস্তৃত বালু রাশি। Image source: Firstpost.com

বৈচিত্রের সম্ভার সাহারা মরুভূমি 

উষ্ণতার কারণে এখানে জীবের পদচারণা নেই ভেবে অনেকেই ভুল করেন। ভৌগলিক আর বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানকার জীবজগৎও বৈচিত্র্যময়। সব মিলিয়ে সাহারায় প্রায় ৩ হাজার প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। এখানকার এক চতুর্থাংশ উদ্ভিদের দেখা কেবল সাহারা মরুভূমিতেই মিলে। পৃথিবীর আর কোথাও এদের দেখা যায় না। খেজুর, সাকুলেন্ট, আকাসিয়াসহ অনেক গাছ রয়েছে সাহারায়। সাহারায় সবচাইতে বেশি দেখা মিলবে খেজুর গাছের।

খেজুর অনেক বেশি পুষ্টিকর ফল হওয়ায় স্থানীয়রা খেজুর গাছ রোপণ করেন। মরুভূমির আবহাওয়ার সাথে টিকে থাকার জন্য এই উদ্ভিদগুলোর আকৃতি অন্যান্য উদ্ভিদের থেকে আলাদা। বেশিরভাগ গাছ এখানে ছোট আকৃতির। আর যেহেতু এখানে পানি তেমন নেই, বৃষ্টিপাত কম হয়; তাই শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখার জন্য স্থুলকায় কাণ্ড এবং সহজেই পানি সন্ধান পেতে মাটির নীচে অনেক দূর প্রযর্ন্ত মূল চলে গিয়েছে এই অঞ্চলের উদ্ভিদের।

সাহারা মরুভূমিতে প্রাণীকূলও বেশ সমৃদ্ধ। বিভিন্ন সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীর দেখা মিলে এই অঞ্চলে। মৌরিতানিয়া এবং এনেদি মালভূমিতে ছোট প্রজাতির কুমির বাস করে। বিপদজনক ডেথস্টার বিছার বাসও সাহারায়। এডেক্স নামক এক প্রজাতির হরিণের বাস সাহারা মরুভূমিতে। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পানি ছাড়া প্রায় এক বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে এডেক্স। দরকাস গ্যাজেল নামক হরিণও দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে। তাই এরাও সাহারাতে নিজেদের ঘাটি বানিয়েছে। মালি, নাইজার, শেয়াল, তোগো, আলজেরিয়া অঞ্চলে সাহারান চিতা বাস করে।

বিভিন্ন সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীর দেখা মিলে এই অঞ্চলে। Image source: Thoughtco.com

সাহারায় মানুষের বাস 

বৃক্ষরাজি, পশুপাখি যেমন রয়েছে কিছু সংখ্যক মানুষও বাস করে সাহারা মরুভূমিতে। সাহারায় সবচাইতে বেশি দেখা মিলে বেদুইন সম্প্রদায়ের লোকদের। এরা উঠের পিঠে চড়ে মরুভূমিময় বিচরণ করে। বেদুইনরা মূলত যাযাবর জাতি। মরুভূমির বুকে তারা রোমাঞ্চকর জীবন অতিবাহিত করে। জরিপ থেকে জানা যায়, প্রায় ২.৫ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে এই সাহারা মরুভুমিতে। যার অর্থ দাঁড়ায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১ জন বাসিন্দা থাকেন এখানে।

বিশাল সাহারা প্রায় ফাঁকা, কিন্তু যেখানেই সামান্য গাছপালা চারণভূমি প্রাণীদের সমর্থন করতে পারে বা খাবার পানির নির্ভরযোগ্য উৎস রয়েছে, সেখানে বাসিন্দাদের বিক্ষিপ্ত বসবাস। তারা লড়াই করে চলেছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পরিবেশের সাথে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আগে একটা সময় আরো বেশি মানুষ বসবাস করতো সাহারায়। ৭০০০ বছর আগে এই অঞ্চলে গৃহপালিত পশুও ছিল। 

Image source: Ovefromeverywhere.com

সেরা বহন উট

প্রাচীনকাল থেকেই মরুভূমিতে চলাচলের জন্য উট সেরা। উটকে বলা হয় মরুভূমির জাহাজ। সাহারা মরুভূমিতেও যাতায়াতের জন্য উট জনপ্রিয় আর সেরা বাহন বলে বিবেচিত। খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে আরবদের মাধ্যমে সাহারায় উটের আগমন হয়েছিল বলে জানা যায়। উট মরুভূমির পরিবেশের সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে পারে। একটানা ১৭ দিন পানি পান না করে উট টিকে থাকতে পারে। উটের কুজের সঞ্চিত চর্বি থাকে যা থেকে অক্সিডাইজ করে পানি তৈরি করতে পারে। তাই দীর্ঘ সময় পানি পান না করলেও উটের সমস্যা হয় না। শুধু তাই নয় খাবারের চাহিদা মেটাতেও উট অনেক উপকারি মরুভূমির রাজ্যে। উটের দুধ অনেক পুষ্টিকর এবং এর মাংসও খাওয়া যায়। মরুভূমি জীবন ও অর্থনীতি অনেকটাই উটের উপর নির্ভরশীল। 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সাহারা মরুভূমিতেও বিরজমান। পৃথিবীর উষ্ণতা বেড়ে চলেছে তার প্রভাব পড়ছে সাহারা মরুভুমিতে। বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্যমতে, ১০০ বছরে গড়ে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে সাহারার আয়তন। প্রতিনিয়ত কমছে বৃষ্টিপাত, বাড়ছে খড়া। এমন চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সাহারার ঘনত্ব বৃদ্ধি পাবে। প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সাথে আমাদের বেখেয়ালি আচরণ বিশ্বকে প্রভাবিত করছে। এটি আমাদের জন্য আর আমাদের আগামী প্রজম্মের জন্য হুমকি স্বরুপ। তাপমাত্রা বৃদ্ধি কমাতে তাই নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। আমাদের আজকের সচেতনতাই পারে আগামী দিনগুলো সুন্দর করতে। 

Feature Image: Thoughtco.com 

তথ্যসূত্র:

01. Britannica.com

02. Thebucketlistcompany.co