গৃহযুদ্ধের সময় জন নেইলসন ছিল ২১ বছরের তরুণ। গতকাল নেইলসনের আরেক সঙ্গী ১৪ বছর বয়সী ব্রায়ান মারা গেছে। ক্ষুধার্ত ব্রায়ানকে নির্যাতনের পরে কুকুরের সামনে ছেড়ে দেওয়া হয়। শরীরে হাড্ডি ছাড়া ব্রায়ানের শরীরে আর কিছুই ছিল না। কয়েক কামড়ে আর হিংস্রতায় ব্রায়ান ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। অথচ, কিশোর ব্র্যায়ানের এই মুহুর্তে থাকার কথা বাড়িতে, ক্রিসমাসের পরিকল্পনা নিয়ে।
ব্র্যায়ানের সুন্দর শান্ত চোখ জোড়া নেইলসনের চোখে ভাসছিল। অনেকদিন ধরে অনাহার আর বিষাদে নেইলসনের নিজের শরীরও ভঙ্গুর, যেন আস্ত এক কঙ্কাল। ক্রিসমাসের আর কয়েকদিন বাকি। নেইলসন স্মৃতিচারণ করছিল আগের বছরগুলোর বাড়িতে থাকাকালীন থ্যাংকসগিভিং উৎসবের। পরিবারের সাথে কাটানো সময়ের। প্রেয়সীর অভিমান আর ভালবাসার কথা।
নেইলসনের ইচ্ছে হচ্ছে দৌড়ে সমস্ত বিষাদ কাটিয়ে দাদীমার কাছে ছুটে যেতে। ক্রিসমাস ট্রি আর ভায়োলিন নিয়ে রাতের পসরা বসাতে। ভাবতে ভাবতেই চোখ ঘোলা হয়ে এলো তার। মাথা উঁচু করে মিসিসিপির বন্দিশিবিরের এক ছোট ফাঁক দিয়ে নেইলসন তাকিয়ে আছে মুক্ত আকাশের দিকে। আকাশের রঙ ধূসর, আকাশি নয়। যুদ্ধের রঙ চিরকাল ধূসর! চারিদিকে অস্ত্রের দামদামা বাজছিল। বাতাসের শুভ্রতা ভরে ছিল বিষাদগ্রস্ততায়, কেননা সমস্ত শুভ্রতা গ্রাস হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের প্রতাপে।
একটু ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মূলত উনিশ শতকেই আমেরিকার রাজ্যগুলোর মধ্যে শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়া লাগে। বিশেষ করে উত্তরের রাজ্যগুলোতে। অপরদিকে, দক্ষিণের রাজ্যগুলোর ভিত্তি ছিল কৃষিনির্ভরতা। আয়ের প্রধান উৎস ছিল তুলা ও তামাক। দক্ষিনে দাসদের দিয়েই কায়িকশ্রমের কাজ করানো হতো। এদিকে, উত্তরের শিল্প উন্নয়নের ফলে তাদের মধ্যে দাসপ্রথার ব্যবহার ধীরে ধীরে কমে যায়। ফলে, আব্রাহাম লিংকন দাসপ্রথা বিলুপ্ত করে। শুরু হয় গন্ডগোলের সূত্রপাত।
দক্ষিণের সাতটি রাজ্য যথাক্রমে সাউথ ক্যারোলিনা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, অ্যালাবামা, জর্জিয়া, লুইজিয়ানা ও টেক্সাস আমেরিকান ইউনিয়নের বিপক্ষে চলে যায়। ফলশ্রুতিতে, ১৮৬১ সালের ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে দক্ষিণের ১১টি রাজ্য একত্র হয়ে ঠিক করলো, তারা এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। নতুনভাবে কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা গঠন করা হলো। জেফারসন ডেভিস হলেন সেই যুক্তপ্রদেশের প্রেসিডেন্ট।
এদিকে, দক্ষিণের রাজ্যের এই বিদ্রোহের জবাবে উত্তরের রাজ্যগুলোও নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে দিল, কোনোমতেই এই যুক্তরাষ্ট্রকে ভাঙা চলবে না। ফলে, দক্ষিনের এই ১১টি রাজ্য বাদ দিয়ে দাসবিরোধী বাকি রাজ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্র ইউনিয়ন বা উত্তর নামে পরিচিতি পায়। এই ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আব্রাহাম লিঙ্কন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-১৮৬৫), যা যুক্তরাষ্ট্রে সংগঠিত এক আঞ্চলিক বিরোধ। মূলত মার্কিন ফেডারেল সরকার আর বিপ্লবী ১১টি দাস-নির্ভর প্রদেশের মাঝে সংগঠিত হয়। স্বদেশের মধ্যেই চলতে থাকে বন্দীশিবিরের হিরিক। ইউনিয়নের অনেক সৈন্যকে আটক করেছিল কনফেডারেট সেনাবাহিনী। এবং যাদেরকে পরবর্তীতে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে নিয়ে আসা হয়। আলাবামা, জর্জিয়া ও মিসিসিপির বন্দীশিবিরগুলোর সৈন্যদের দুর্দশার করুণ কাহিনীর এক চিহ্ন শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় চার বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে ১৮৬৫ সালে ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘোষণা হয়।
ইতি ঘটে গৃহযুদ্ধের। বন্দীশিবির থেকে মুক্তি দেওয়া হয় শত শত বন্দী সৈন্যদের। এরমধ্যে নতুন খবর হলো দক্ষিনের রাজ্য থেকে উত্তরে আসা সৈন্যদের নদীপথ ব্যবহার করতে হবে। যেহেতু যুদ্ধের ফলে স্থলপথে যোগাযোগের সমস্ত যাতায়াত ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। উত্তরে অবতরণের জন্য নিয়ে আসা হলো উত্তরের সরকারের পক্ষ থেকে সৈন্যদের জন্য এস এস সুলতানাকে!
সুলতানা শব্দের অর্থ ক্ষমতাবান বা সাম্রাজ্যের অধিপতি। তৎকালীন সময়ে এসএস সুলতানা ছিল আমেরিকার সবচেয়ে ভালো বাষ্পচালিত জাহাজগুলোর একটি। সুলতানার সক্ষমতা যদিও ছিল ৩৭৫। অনুমোদন ছিল ২৯০ জন যাত্রী নেওয়ার। কিন্তু শেষে দেখা গেল আলবাবা, জর্জিয়া ও মিসিসিপি থেকে প্রায় ২৫,০০০ সৈন্যের বিশাল জনবহর এসে মিলিত হয় ভিক্সবার্গে। এই জায়গা থেকেই সুলতানার যাত্রা শুরু হবে। এত বিশাল সৈন্যের সংখ্যা দেখে জাহাজের কাপ্তান নিজেই বিস্মিত হয়ে যায়। এদিকে, ঠিক কত সৈন্য বেঁচে আছে তা উত্তরের সরকার সঠিক জানত না।
ফলাফলস্বরূপ, উত্তরের পক্ষ থেকে বন্দীদের ফিরিয়ে আনতে এতটুকুও কার্পণ্য করা হয়নি। জাহাজের কাপ্তানকে দক্ষিনের বন্দীশিবির থেকে ফিরিয়ে আনতে প্রতি অফিসারের জন্য দশ ডলার ও সাধারণ সৈন্যের জন্য পাঁচ ডলার দিতে রাজি হয়েছিল উত্তরের ইউনিয়ন সরকার। এদিকে, জাহাজের মধ্যে তখন বয়লারের লিকেজ দেখা যায়। জাহাজের কাপ্তান জেমস ম্যাসন ইন্সপেক্টরের কথা অগ্রাহ্য করে প্রায় জোরপূর্বক সুলতানা ভাসিয়ে দেয় নদীতে।
এত টাকার সুযোগ হাতছাড়া করতে ম্যাসন রাজি হয়নি। ইন্সপেক্টর জাহাজটির বয়লারে কিছুটা সমস্যা দেখতে পায়। কিন্তু বিশাল সৈন্যের এই ঝাঁক জাহাজ ছাড়তে দেরি হলে আবার জাহাজ ছেড়ে অন্য পথে না যাত্রা করে সে ভয়ে ম্যাসন জাহাজ দ্রুত ছাড়তে নির্দেশ দেয়।
১৮৬৫ সালে ২৪ এপ্রিল সমস্ত জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে জাহাজের ক্ষমতার চেয়ে ৬গুন বেশি মানুষ নিয়ে সুলতানা যাত্রা করে উত্তরের দিকে। সুলতানার প্রথম ক্লার্ক উইলিয়াম জে. গ্যামব্রেল যাত্রার দিন এক সৈন্যকে বলেন –
যদি আমরা কায়রোতে নিরাপদে পৌঁছে যেতে সক্ষম হই, তবে এটি হবে পশ্চিমের জলসীমায় করা সবচেয়ে বড় ভ্রমণ।
জাহাজের অবস্থা এতটাই শঙ্কটজনক ছিল গ্যামব্রেল মেজর ফিডলারকে সতর্ক করে দেয় জাহাজে কেউ যেন পায়চারি না করে। এমনকি জটলা করে একস্থানে না বসার জন্যও সবাইকে জানানো হয়। বন্যার কারণে মিসৌরি নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চতা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। প্রতিকূল আবহাওয়ার মাঝে মিসৌরি নদীতেও তুলকালাম প্রবাহ চলতে থাকে।
বিধাতা যেন এই হতভাগ্য সৈন্যদের কোনোভাবেই বাড়ি পৌঁছে দিতে রাজি নয়। ক্যাপ্টেন ম্যাসন সবাইকে বলে গন্তব্যে পৌঁছে জাহাজটি পূর্ণাঙ্গ মেরামতের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু নিয়তি গন্তব্য পর্যন্ত ধৈর্যের সীমানায় থাকতে পারেনি। গন্তব্যের পথে পরতে থাকে একে এক বিপদ।
২৭ এপ্রিল মেমফিসে সুলতানা সাময়িক যাত্রা বিরতির পরেই রাতে আবার যাত্রা শুরু করে। রাত তখন দুটোর মতো। কাপ্তান ছাড়া সবাই প্রখর ঘুমে বেহুশ। হঠাৎ বিস্ফোরণের আওয়াজে সবাই সচকিত হয়ে উঠে। ভিক্সবার্গের সেই বয়লার লিকেজ এবার অগ্নিগিরির মতো বিস্ফোরিত হয়। বয়লারের কাছেই যে সৈন্যরা ছিল তাৎক্ষনিকভাবেই তারা পুড়ে মারা যায়।
একে তো উত্তাল মিসৌরির কূল, অন্যদিকে আগুন, সৈন্যদের হাতে বাঁচার আর ভাল কোনো উপায় ছিল না। অনেকে নদীতে ঝাঁপ দেয়, বাকীরা আগুনে পুড়ে দাহ হয়ে যায়। মিসৌরির চারপাশের কনফেডার সমর্থকরা বিদ্বেষ ভুলে অনেককে বাঁচাতে নদীর তীরে আসে। গৃহযুদ্ধের চিরশত্রুতাও মুহুর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়, গৃহযুদ্ধের ৬০০,০০০ জনেরও বেশি সহযোদ্ধাদের মধ্যে বেঁচে থাকা এই সৈন্যরা শেষ পর্যন্ত আগুন আর পানির অতল ভাগ্যে নিঃশেষ হয়ে যায়। অথচ তারা বর্বর যুদ্ধ এবং অ্যান্ডারসনভিল এবং কাহাবার মতো কুখ্যাত ক্যাম্প থেকে বেঁচে এসেছিল। এসব সৈন্যদের বেশিরভাগই ছিল বয়সে একদম তরুণ। পরিবারকে, দেশকে গৌরবে মোড়াতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল অনেকে। বন্দীশিবিরে অনেকে পাগলের মত ছটফট করতো প্রিয়জনের জন্য।
কারণ, তারা আশাই ছেড়ে দিয়েছিল উত্তরে আসার। ক্যাম্প থেকে মুক্ত হওয়ার পরে তারা যখন বাড়িতে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল, কবর থেকে উঠে আসা ভয়ংকর মৃত্যু যেন সামনে এগোচ্ছিল। ছেঁড়া, চিটচিটে এক খন্ড কাপড় গায়ে হাড্ডি সমেত ভয়ংকর মৃত্যু! তবুও, সুলতানায় উঠে তারা আনন্দে ভেসে যাচ্ছিল।
অবস্থা এতটা করুণ হয়েছিল, এক সৈন্য জাহাজের এক মহিলার লাইফবেল্ট টেনে হিঁচড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। মিসিসিপি ইতিমধ্যেই বন্যায় আক্রান্ত ছিল এবং সুলতানার কাছে শুধুমাত্র একটি লাইফবোট এবং কয়েকটি জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম ছিল। ফলে, বিস্ফোরণ থেকে বেঁচে যান মাত্র ৬০০ জন। এস এস সুলতানা বিস্ফোরণের পরে বেশ কয়েকদিন ধরে উদ্ধারকারীরা বিস্ফোরণ অঞ্চলের কাছাকাছি গাছ থেকে মৃতদেহ খুঁজে পায়। এমনকি ২০০ মাইল দূরে ভিক্সবার্গ, দক্ষিণে নদী পর্যন্ত লাশ খুঁজে পাওয়া যায়।
ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন যে, প্যাডেল হুইলারের যাত্রীদের মধ্যে ১৮,০০ জনেরও বেশি মারা যায়। যদিও সুলতানার এই বিপর্যয়কে “টাইটানিক অফ মিসিসিপি” বলা হয়, কিন্তু সুলতানা বিপর্যয় প্রকৃতপক্ষে ১৯১২ সালের জাহাজডুবির চেয়ে ৩০০ এর বেশি প্রাণ দেয় এবং এখনও আমেরিকার ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় সামুদ্রিক বিপর্যয় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
দুঃখজনকভাবে, বিপর্যয়টি অন্যান্য ঘটনা দ্বারা ছেঁয়ে যায়। ৯ এপ্রিল আব্রাহাম লিংকন আততায়ীর হাতে নিহত হয়। এদিকে, গৃহযুদ্ধেরও অবসান হয়। কনফেডারেট জেনারেল জোসেফ জনস্টনের আত্মসমর্পণের পাশাপাশি জন উইলকস বুথ, যে ব্যক্তি আব্রাহাম লিংকনকে দুই সপ্তাহ আগে হত্যা করে সে নিজে মিসিসিপিতে সুলতানার বিস্ফোরণের আগের দিন ২৬ তারিখে নিহত হন। ফলে, এহেন পরিস্থিতিতে সুলতানা এবং সেই হতভাগ্য সৈন্যদের ট্রাজেডির খবর তলিয়ে যায় অতলে।
ফিচার ইমেজঃ Orangebeanindiana.com
তথ্যসূত্রঃ
অনেক সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছ আপু। সুলতানা ট্রাজেডি সম্পর্কে জানা ছিল না খুব একটা; তবে এটি পড়ে বিস্তারিত জানতে পেরেছি। খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছ সুলতানা ট্রাজেডি সম্পর্কে😊
বিষয়গুলো একদম অন্যরকম, সাথে লেখিকার লেখনীয় শক্তি। দুটোই মিলে পরপর অনেকগুলো লেখা গ্রোগ্রাসে পড়লাম। শুভকামনা প্যানেলকে।
অসাধারণ লেখনী। প্রতিটা ডিটেইলস এবং প্রতিটা এটাচমেন্ট প্রচন্ড ইনফরমেটিভ যেন চোখের সামনেই ঘটনাগুলোকে দেখছি…
এস.এস.সুলতানা ট্র্যাজেডির নাম শুনলেও সেভাবে বিস্তারিত জানা ছিলো না। প্রতিটা ডিটেইলস এবং প্রতিটা এটাচমেন্ট এতো গুছিয়ে দেয়া যেন চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। লেখিকার লেখনী শক্তি অসাধারণ