গ্রিক পুরাণ মতে, দেবতা জিউস প্রমিথিউসের উপর রাগ করে মানবজাতির জন্য আগুনের সরবারহ বন্ধ করে দিলে, প্রমিথিউস সিদ্ধান্ত নেন; তিনি হেফেস্টাসের কর্মশালা থেকে আগুন চুরি করবেন। তাই তিনি অলিম্পাস পাহাড়ের চূড়ায় উঠে হেফেস্টাস ও এথেনার কারখানা থেকে আগুন চুরি করে আনলেন। তিনি একটি ফাঁপা খোলকের মধ্যে আগুনের শিখাকে লুকিয়ে নিয়ে নিরাপদে লোকালয়ের মানুষের কাছে এসে মানবজাতিকে পুনরায় আগুন সরবরাহ করলেন। এই আগুন মানুষকে দিল শক্তি। প্রমিথিউসের আগুন পেয়ে মানব সভ্যতার খুব দ্রুত বিকাশ ঘটলো।
যুগে যুগে পৃথিবীতে বহু মানুষকে ‘প্রমিথিউস’ উপাধি দেওয়া হয় আর তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাক্ষাৎ প্রমিথিউস, বিজ্ঞানী জে. রবার্ট ওপেনহাইমার। তিনি পৃথিবীর মানুষকে দেখিয়েছেন পরমাণু জগতের এক নতুন পথ।
১৬ জুলাই ১৯৪৫
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো অঙ্গরাজ্যের ইয়োর্নাদা দেল মুয়ের্তো মরুভূমি। সেদিন ১৬ জুলাই ১৯৪৫ সালের ভোরবেলা, সেখানে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা হতে যাচ্ছে-যার সাংকেতিক নাম ট্রিনিটি।
বিস্ফোরণস্থল থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে একটি কন্ট্রোল বাংকারের ভেতরে কাউন্টডাউনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এই প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী ও পরিচালক রবার্ট ওপেনহাইমার। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।
পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের আগে তিনি ঘুমিয়েছিলেন মাত্র চার ঘণ্টা। একদিকে দুশ্চিন্তা, আরেক দিকে ধূমপানজনিত কাশি-তাকে জাগিয়ে রেখেছিল। ওপেনহাইমারের জীবনে ১৯৪৫ সালের সেই দিনটি ছিল তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর অন্যতম।
বিস্ফোরণের কাউন্টডাউন শুরু হবার মুহূর্তে ওপেনহাইমারকে দেখছিলেন পাশে থাকা একজন সামরিক কর্মকর্তা। বার্ড আর শেরউইন বর্ণনা করেন, সেই জেনারেলটি বলছিলেন ‘শেষ কয়েকটি সেকেণ্ডে ড. ওপেনহাইমার যেন আরো উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়ছিলেন, তার শ্বাস পড়ছিল না।’ ওপেনহাইমারের তখন মনে পড়ছিল একটি উক্তি-
আমি এখন সাক্ষাৎ মৃত্যু, বিশ্ব ধ্বংসকারী
– শ্রী ভগবদ গীতা
তারপরই ঘটলো সেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তার ঔজ্জ্বল্য সূর্যকেও ফিকে করে দিল। একুশ কিলোটন টিএনটির ক্ষমতাসম্পন্ন সেই বিস্ফোরণ ছিল তখন পর্যন্ত পৃথিবীর বৃহত্তম। এর ফলে যে শকওয়েভ বা বাতাসের ঝাপটা তৈরি হয়েছিল তা ১০০ মাইল দূর থেকেও অনুভব করা গিয়েছিল। প্রচণ্ড গর্জনে মরুভূমি কেঁপে উঠলো, আকাশে পাকিয়ে উঠলো মাশরুম আকৃতির মেঘ।
ওপেনহাইমারের মুখে এবার এক বিরাট স্বস্তি ফুটে উঠলো। কয়েক মিনিট পর ওপেনহাইমারের বন্ধু ও সহকর্মী ইসিডোর রাবি দেখলেন, তিনি হেঁটে যাচ্ছেন।
আমি কখনো তার সেই হাঁটার দৃশ্য ভুলবো না, ভুলবো না যেভাবে তিনি গাড়ি থেকে নেমেছিলেন। সেটা ছিল ‘হাই নুন’ ছবির মতো একটা দৃপ্ত ভঙ্গী-যাতে ফুটে উঠছিল যে তিনি তাকে দেয়া কাজটা করতে পেরেছেন।
– আমেরিকান প্রমিথিউস, কা বার্ড এবং মার্টিন জে. শেরউইন
মেক্সিকোর মরুভূমিতে পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা চালানোর কয়েক ঘণ্টা আগে ওপেনহাইমার সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে অনূদিত যেই স্তবক পাঠ করেছিলেন তা ছিল:
যুদ্ধক্ষেত্র, বন আর সমস্ত পাহাড়ের চূড়ায়
সাগরের অন্ধকারে, তীরে ও বল্লমে
ঘুমের অতলে, বিভ্রান্তিতে, লজ্জার গভীরে
সব মহান কাজের আগে মানুষ করেছে নিজেকে রক্ষা।
-শ্রী ভগবদ গীতা
পরমাণুর নিউক্লিয়াস
ওপেনহাইমার ছিলেন ম্যানহাটান প্রজেক্টের মূল ব্যক্তি। পরমাণু বোমাকে বাস্তবায়নে তার ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বেশি। যুদ্ধ পরবর্তীকালে তার এক সহকর্মী জেরেমি বার্নস্টাইন বলেছেন, লস আলামোসের ওই প্রকল্পে যদি ওপেনহাইমার না হয়ে অন্য কেউ পরিচালক হতেন তাহলে যুদ্ধ শেষ হতো ঠিকই-তবে পারমাণবিক বোমা ছাড়া।
এই বোমা সফলভাবে তৈরির ব্যাপারে ওপেনহাইমারের প্রতিক্রিয়া ছিল বিচিত্র। এক এক সময় তার মধ্যে যেমন উত্তেজনা আর উচ্চাভিলাষী মনোভাব দেখা গিয়েছিল-তেমনই ছিল বিষাদ ও গ্লানি।
পরমাণু অস্ত্রের হুমকি সম্পর্কে রাজনীতিবিদদের আগে বিজ্ঞানীরাই সচেতন হয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রথম মার্কিন সরকারের নেতাদের কাছে এই নিয়ে এক চিঠি লিখেছিলেন।
পরে ১৯৪২ সাল নাগাদ এটা স্পষ্ট হয় যে, পারমাণবিক বোমা তৈরি করা সম্ভব এবং এতে ওপেনহাইমারের দলেরও অবদান ছিল। এজন্য পরিকল্পনা তৈরি হতে থাকে তখন থেকেই।
প্রথম যখন বোমা তৈরির প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে ওপেনহাইমারের নাম প্রস্তাব করা হয়, তখন বেশ কিছু আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু তার জ্ঞান এবং বিশ্বস্ততা ও উচ্চাভিলাষের কারণে ম্যানহাটান প্রকল্পের সামরিক নেতা জেনারেল লেসলি গ্রোভস তাকে নেবার পক্ষেই মত দেন।
আমি এখন সাক্ষাৎ মৃত্যু
১৯৬০-এর দশকে এক সাক্ষাৎকারে ওপেনহাইমার গভীরতর অনুভূতির কথা জানিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, বিস্ফোরণের পরপরই তার মনে পড়েছিল হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ভগবত গীতার একটি উক্তি-
এখন আমি পরিণত হয়েছি
সাক্ষাৎ মৃত্যুতে, বিশ্ব ধ্বংসকারীতে।
তার বন্ধুদের কথায়, পরবর্তী দিনগুলোতে ওপেনহাইমারের মধ্যে একটা বিষণ্ণতা ভর করেছিল। একজন বলেছেন, ‘রবার্ট চুপচাপ আর আনমনা হয়ে গিয়েছিল, কারণ সে জানতো কী ঘটতে যাচ্ছে।’ একদিন তাকে জাপানিদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে বিড়বিড় করতে শোনা যায়। তিনি বলছিলেন, ‘আহা ওই ছোটখাটো বেচারা লোকগুলো, ওই ছোটখাটো বেচারা লোকগুলো!’
কিন্তু কয়েক দিন পরই তার হাবভাব আবার পাল্টে যায়। সামরিক নেতাদের সাথে কথা বলার সময় তিনি বারবার তাদের বলে দিচ্ছিলেন যেন বৃষ্টি বা কুয়াশার সময় বোমাটা ফেলা না হয়, বা খুব বেশি উঁচুতে বিস্ফোরণ ঘটানো না হয় – তাহলে ততটা ক্ষয়ক্ষতি হবে না।
– আমেরিকান প্রমিথিউস, কা বার্ড আর মার্টিন জে শেরউইন
হিরোশিমায় সফলভাবে বোমা ফেলার পর সহকর্মীদের সামনে তিনি মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে তুলে যে ভঙ্গী করেছিলেন-তা ছিল বিজয়ী যোদ্ধার মতোই।
অনুতপ্তবোধ
যুদ্ধের পর পরমাণু বোমা সম্পর্কে ওপেনহাইমারের মত পাল্টে গিয়েছিল। তিনি একে ‘ত্রাস ও আক্রমণের’ যন্ত্র এবং অস্ত্র নির্মাণ শিল্পকে শয়তানের কাজ বলে আখ্যায়িত করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানকে ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় যেন আমার হাতে রক্ত লেগে আছে।’ প্রেসিডেন্ট পরে বলেছিলেন, ‘আমি ওকে বলেছিলাম রক্ত লেগেছে আমার হাতে-ওটা নিয়ে আমাকেই ভাবতে দাও।’
অস্ত্র তৈরির সময় ওপেনহাইমার তার সহকর্মীদের বলতেন-পরমাণু বোমা ব্যবহৃত হলে কী হবে তা বিজ্ঞানীদের বিষয় নয়, তাদের দায়িত্ব তাদের কাজ করা। কিন্তু যুদ্ধের পরে ওপেনহাইমারের নিজের যুক্তির ওপর আস্থা নড়ে গিয়েছিল। তিনি পরে আরো শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমা তৈরিরও বিরোধিতা করেছিলেন।
পরে এই কারণে ১৯৫৪ সালে তার বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার তদন্ত করে এবং তার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স কেড়ে নেয়। অবশ্য পরে ১৯৬৩ সালে তাকে ‘এনরিকো ফার্মি’ পুরস্কার দেয়-যদিও ক্লিয়ারেন্স ফেরত দেয়া হয় তার মৃত্যুর ৫৫ বছর পরে। ওপেনহাইমার তার বাকি জীবনে একদিকে তার কাজ নিয়ে গর্ব, অন্যদিকে এর পরিণাম নিয়ে অপরাধবোধ – এই দুই সমান্তরাল অনুভূতি নিয়েই বেঁচে ছিলেন।
তরুণ বয়স থেকেই অত্যধিক ধূমপান করতেন ওপেনহাইমার। একারণে তার কয়েক দফা যক্ষ্মা হয়। ১৯৬৭ সালে তিনি গলার ক্যান্সারে মারা যান। তিনি বলেছিলেন-
একই ভুল পুনরায় না করাই হচ্ছে
বিজ্ঞানের কাজ, এটা কবিতা নয়।
ওপেনহাইমার
ওপেনহাইমারের জন্ম নিউইয়র্কে ১৯০৪ সালে-জার্মানি থেকে অভিবাসী হয়ে আমেরিকায় আসা এক ইহুদি পরিবারে। কাপড়ের ব্যবসা করে তারা বিত্তশালী হয়েছিলেন। নিউইয়র্কের আপার ওয়েস্ট সাইডে তাদের বড় অ্যাপার্টমেন্টে ছিল তিনজন কাজের মেয়ে, একজন ড্রাইভার-আর বাড়ির দেয়ালে শোভা পেতো ইউরোপিয়ান শিল্পীদের আঁকা ছবি। বিলাসিতার মধ্যে বড় হয়েও ওপেনহাইমার ছিলেন খুবই বুদ্ধিমান কিন্তু অত্যন্ত লাজুক।
নয় বছর বয়সে ওপেনহাইমার গ্রিক ও লাতিন দর্শন পড়ছিলেন, আর আগ্রহী ছিলেন খনিজ পদার্থে। তার লেখা চিঠি পড়ে নিউইয়র্কের মিনারেলজিক্যাল ক্লাব ভেবেছিল তা হয়তো বয়স্ক কারো লেখা। ওপেনহাইমার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন পড়েন, এরপর স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেন ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজে।
জার্মানিতে ১৯২৬ সালে গোয়েটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউটের পরিচালকের সাথে দেখা করেন ওপেনহাইমার, আর তিনিই চিহ্নিত করেন যে ওপেনহাইমারের একজন তাত্ত্বিক হবার প্রতিভা রয়েছে। তাকে এই ইনস্টিটিউটে পড়তে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়।
ওপেনহাইমার পরে বলেছেন এর মাধ্যমেই পদার্থবিজ্ঞানে তার আগমন। এখানে পিএইচডি ও ফেলোশিপ করার মধ্যে দিয়ে অন্য তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের সাথে তার আলাপ-পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। এদের অনেকেই পরে আবার লস অ্যালামোসে তার সাথে কাজ করেছেন।
আমেরিকায় ফিরে ওপেনহাইমার অধ্যাপনা শুরু করেন প্রথম হার্ভার্ডে, পরে বার্কলেতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানকার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও তিনি একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এসময়ই হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোর প্রতি তার আগ্রহ জন্মায়, এবং ভগবত গীতা পড়ার জন্য তিনি সংস্কৃত শেখেন।
গীতায় কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধের কাহিনি তাকে পরমাণু বোমা তৈরির প্রকল্পে কাজ করার দার্শনিক পশ্চাৎপট তৈরি করে দেয়-যাতে কর্তব্য ও নিয়তির ওপর জোর দিয়ে বলা হয়, এর পরিণাম যাই হোক না কেন, তাকে কখনোই নিষ্ক্রিয় থাকার যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করা চলে না।
তিনি ১৯৩২ সালে তার ভাইকে লেখা এক চিঠিতে গীতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, যুদ্ধের সময় এই দর্শনকে কাজে লাগানো যেতে পারে। ওপেনহাইমার ১৯৪০ সালে জীববিজ্ঞানী ক্যাথরিন কিটি হ্যারিসনকে বিয়ে করেন। ১৯৬৭ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি এই আমেরিকান প্রমিথিউস মৃত্যুবরণ করেন।
Feature Image : indiatvnews.com References: 01. J. Robert Oppenheimer 02. J. Robert Oppenheimer (1904 - 1967) 03. J. Robert Oppenheimer - American physicist 04. J.Robert Oppenheimer: 5 Facts About the ‘Father of the Atomic Bomb’