গত চার দশকে চীন বিশ্ব অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু চীন কিভাবে অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হলো? এই বিষয়টি অনেকটাই অলৌকিক বটে! এর পেছনে ছিল শক্তিশালী নেতৃত্ব ও গঠনমূলক পরিকল্পনা। বর্তমানে দেশটি শুধুমাত্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তি এবং রপ্তানিকারকই নয়, সেইসাথে সারা বিশ্বের মধ্যে সেরা বিনিয়োগকারীও বটে।
যেসব উন্নয়নশীল দেশ চীনের সাফল্যকে অনুকরণ করে সেসব দেশের জনসাধারণের বেশিরভাগই চীনের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে এবং তারা নিজ দেশের জন্য একটি রোল মডেল হিসেবেই চীনকে দেখে। কিন্তু চীনের এই উত্থান মাত্র অল্প কয়েকদিনের। ৪০/৫০ বছর আগেও চীন ছিল দরিদ্র দেশগুলোর তালিকায়। কোন বন্ধু রাষ্ট্র ছিল না।
কারো সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। কোনো দেশের উপর কর্তৃত্ব খাটানো তো ছিল দূরের কথা ছিল তাদের জন্য! আর বর্তমানে ২০২২ সালে এসে চীন বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক পরাশক্তির দেশ হয়ে উঠেছে। আজকের আলোচনাটা তাই চীনের এই উত্থানকে কেন্দ্র করেই।
গত প্রায় দেড়শ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দখলে ছিল এই তকমা। কিন্তু সময়ের পালাক্রমে এশিয়ার দেশ চীন আজ এই কৃতিত্বের অধিকারী। চীনের এই অবস্থান কখনো প্রথমে আবার কখনো দ্বিতীয়তে উঠানামা করছে। এটাই কি যর্থার্থ নয়?
অথচ চীনের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। গণচীনের প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুং যখন শাসন ক্ষমতায় ছিলেন তখন দেশটিতে কঠোর সমাজতন্ত্র চালু ছিল। কৃষকদেরকেও স্বাধীনভাবে চাষাবাদ করতে দেওয়া হতো না। আর তখন কোন বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে চীনের কোন বানিজ্যিক সম্পর্ক ছিল না।
অথচ একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূল হলো বৈদেশিক বানিজ্য। তবে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে মাও সেতুং-এর মৃত্যুর পর যখন দেং জিয়াওপিং ক্ষমতায় আসেন এবং চীনের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য নানা সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তার সংস্কার নীতির ফলে চীনের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর থেকে শিল্পনির্ভর হয়ে ওঠেছিল। কৃষকদেরকেও নিজস্ব জমি চাষ করার অধিকার দেওয়া হয়েছিল, জীবনযাত্রার মান উন্নত করা হয়েছিল এবং খাদ্যের ঘাটতি কমানো হয়েছিল।
যদিও মাও সেতুংও তার শাসনামল থেকেই অনেক সংস্কার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তিনি এর বাস্তবায়ন করার সুযোগ পাননি। ১৯৭৬ সালে দেং জিয়াওপিং শাসন ক্ষমতায় এসে একবার জাপান সফর করে দেখেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবলিত জাপান কিভাবে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করে একটি উন্নত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়েছে।
জাপানের এমন আমূল পরিবর্তন তার নজর কাড়ে এবং সেখান থেকে অনেক কৌশল রপ্ত করে তা নিজ দেশের উপর প্রয়োগ করেন। জিয়াওপিং চীনের নাগরিকদের জন্য দারিদ্র্যমুক্ত ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করার জন্য ১৯৭৯ সালে আধুনিকীকরণের লক্ষ্য হিসাবে ‘শিয়াওক্যাং সোসাইটি’ গঠন করেন। চার দশকের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের পর চীন এখন এই লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি।
প্রাচীনকাল থেকেই চীন বিশাল আয়তনের ও বিশাল জনসংখ্যার দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তার ভ্রমণ কাহিনীতে চীনের যে বর্ণনা দিয়েছিলেন সেখানে উল্লিখিত চীনের রেশম কাপড়, তৈল চিত্র, রঙ, মনোহারী দ্রব্যের কদর সারা বিশ্বজুড়ে ছিল।
পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীতে এসে চীনের শাসকগণ দেশকে শিল্পায়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। দেশের বিশাল জনসংখ্যাকে ধীরে ধীরে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার চেষ্টা করে। সস্তা ও সহজলভ্য শ্রম ও কাঁচামালের মাধ্যমে অচিরেই এই জনশক্তিকে কাজে লাগিয়ে শিল্পোৎপাদনে দ্রুত অগ্রগতি লাভ করে। এভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই চীন একটি রপ্তানিনির্ভর, শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
চীনের শিল্পখাতে গৃহিত প্রবৃদ্ধির কৌশল দেশটিকে বৃহত্তম উৎপাদনকারী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। যে কারণে চীনকে ‘বিশ্বের কারখানা’ বলা শুরু হয়। চীন তার ছোট শহর এবং বন্দর শহরগুলি শিল্পকেন্দ্রে পরিণত করে। ফলে বিশ্বজুড়ে চীনা পণ্যের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
১৯৭৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বিদেশী বিনিয়োগের দ্বার খুলে গিয়েছিল। এভাবে চীনা অর্থনীতির উন্মোচন প্রচুর পরিমাণে অন্যান্য বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে এবং অনেক পশ্চিমা কোম্পানিও চীনে তাদের জ্ঞান, প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থানান্তর করে। এটি চীনে শিল্প কার্যক্রমকে আরো জোরদার করেছে এবং ধীরে ধীরে চীনকে অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত করেছে।
চীনের সাফল্যকে অনেক উন্নয়নশীল দেশ এবং তাদের নেতারা অনুকরণ করা শুরু করে। এর প্রধান কারণ হলো চীন তার কোটি কোটি জনসংখ্যাকে দরিদ্রতা থেকে বের করে আনতে এবং তাদের জীবনযাত্রার মানকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পেরেছিল।
বিশ্বায়নের যুগে চীন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সাথে প্রতিযোগিতায় না নেমে তার সম্পদের সদ্ব্যবহার ও একত্রিত করে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিল। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য স্থানীয় শিল্পকে সঠিক প্রণোদনা দিয়েছিল। আর এই ‘চীনা মডেল’ তাদেরকে অর্থনৈতিক পরাশক্তি বানাতে সাহায্য করেছে।
চীনের অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে আরেকটি কারণ হলো কমিউনিস্ট পার্টির পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। চীনারা এরকম বেশ কয়েকটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এর মধ্যে ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৮১-১৯৮৫) ছিল জাতীয় উন্নয়ন এজেন্ডাগুলির মধ্যে প্রথম।
এই পরিকল্পনার মূল কাজটি ছিল ‘পুনর্বিন্যাস, পুনর্গঠন, একত্রীকরণ এবং উন্নতির নীতি অব্যাহত রাখা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্তকারী অতীত পরিকল্পনা থেকে অবশিষ্ট বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য আরো চেষ্টা করা।’ এই পরিকল্পনা জাতীয় অর্থনীতির উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখে। চীনের আধুনিকীকরণকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং জনগণকে ক্রমাগত তাদের জীবিকা উন্নত করতে সক্ষম করে।
চীন পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং এর বাইরেও বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সংযুক্ত। ১৯৯০-এর দশকে চীন বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে যোগ দেয়। এই অংশগ্রহণ চীনা নীতিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে পৌঁছে দিয়েছে। ২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেয়। চীন এই আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কগুলিতে প্রবেশ করার পর তাদের অর্থনীতি যেন আরো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
১৯৭৮-সাল থেকে অর্থনৈতিক সংস্কার নীতি কার্যকর হওয়ার ফলে রপ্তানি বৃদ্ধি পায় এবং সেইসাথে চীন বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এখনকার দিনে আমরা যে সমস্ত পণ্য ব্যবহার করি তার অর্ধেকেরও বেশি ‘মেইড ইন চায়না’ লেবেলযুক্ত। অথচ এমন চিত্র সবসময় ছিল না।
চীন সুলভমূল্যে পণ্য উৎপাদন করার কারণে খরচও কমিয়ে ফেলতে পেরেছে। তাই বিশ্ববাজারে চীনা পন্যের প্রচুর চাহিদা তৈরি হয়েছে। পণ্য রপ্তানিতে সুবিধার জন্য চীন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। চীনের জাহাজ নির্মাণশিল্প তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম অংশ। এই শিল্পে সরকারী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উৎপাদন ২০০০ সালে ১০% এরও কম থেকে ২০১৪ সালে প্রায় ৫০%-এ উন্নীত হয়েছিল। এইভাবে এই শিল্পে তারা বিশ্বের বৃহত্তম উৎপাদনকারী হয়ে উঠেছে।
২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে চীন পোশাক, জুতা, কম্পিউটার উপাদান এবং সামুদ্রিক খাবারের বৃহত্তম সরবরাহকারী হয়ে ওঠে। ২০০৯ সাল থেকে চীন বিশ্বের বৃহত্তম পণ্য রপ্তানিকারক হয়েছে যা পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে ছিল। চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অধীনে বহু দেশে শিল্প সহযোগিতার সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কারণে চীন আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়দের সাথে তার সম্পর্ক জোরদার করার জন্য গত এক দশকে যথেষ্ট সম্পদ বিনিয়োগ করেছে। চীনের ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমাগতভাবে লাতিন আমেরিকার পণ্যের শীর্ষ ভোক্তা হয়ে উঠছে। তারা কলম্বিয়া থেকে তেল, চিলি থেকে তামা এবং উরুগুয়ে থেকে গরুর মাংস আমদানি করছে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একটি মূল বৈশিষ্ট্য হলো বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, যা ২০১৫ সালে সরকার কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল। ২০২১ সালের গোড়ার দিকে ১৯টি লাতিন আমেরিকান এবং ক্যারিবিয়ান সরকার ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ট্রান্সকন্টিনেন্টাল বাণিজ্য নেটওয়ার্কে যোগদান করেছে।
এটি শুধুমাত্র চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে নির্দেশ করে না বরং আগামী কয়েক দশক ধরে অংশগ্রহণকারী দেশগুলির মধ্যে অনুকূল অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করবে৷
চীনের অন্যতম একটি নীতি হলো ‘ওয়ার বাই আদার মিন্স’ বা সামরিক সংঘাত ছাড়াই তারা অনেক ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফলভাবে অর্জন করেছে। চীনের এই কৌশল মূলত অর্থনৈতিক কারণের উপর নির্ভর করে। যেমন চীন কতিপয় দেশকে আর্থিকভাবে সাহায্য করার বিনিময়ে তার আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক উত্থানকে সমর্থনের জন্য ঐসব দেশের উপর নিজের প্রভূত্ব বিস্তার করছে। এতে করে চীনের ক্ষমতা বাড়ছে। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের জন্য অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা উভয় ক্ষেত্রে হুমকির সৃষ্টি করে।
কারণ চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী দেশগুলির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করছে। সেইসাথে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধির জন্যও বিভিন্নভাবে আর্থিক সাহায্য করেছে। এদিকে এসব আর্থিক সুবিধাভোগী দেশগুলি সাধারণত এসব সাহায্যের শর্ত ও প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে গিয়ে আরও চাপের সম্মুখীন হয়।
যেমন চীনা সরকারি এবং বেসরকারী উভয় কর্পোরেশনই আফ্রিকায় অবকাঠামো, জ্বালানি এবং ব্যাংকিংয়ে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করে। তাদের লক্ষ্য হলো স্বল্প সুদে ঋণের মাধ্যমে নির্মাণ প্রকল্পে সহায়তা করে আফ্রিকায় বিনিয়োগ করা।
বাণিজ্য বাড়াতে এমন বিনিয়োগ চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের একটি অংশ। ফলে বাণিজ্য বৃদ্ধি এবং আরো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে চীন একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসাবে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে।
চীন অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হতে যেসব নীতি, কৌশল পদ্ধতি প্রয়োগ করেছে সেসব নীতি ও কৌশল কিন্ত পৃথিবীর অনেক উন্নয়নশীল দেশ প্রয়োগ করেছিল। কিন্ত তারা সফল হতে পারেনি। এর কারণ হলো এসব দেশ বিশাল বিশাল সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে এমন নীতি গ্রহণ করেছিল।
আর চীনের ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে সেটা হলো চীনের এমন গুরুতর সমস্যা ছিল না। তারা চেয়েছিল নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে। তারা ছিল তাদের লক্ষ্যে অবিচল। সাথে ছিল বুদ্ধিমান নীতি নির্ধারক ও পরিশ্রমী জনশক্তি।
Feature Image: pinterest.com References: 01. Rise of China. 02. The Chinese Economic Miracle. 03. How the country became the world's 'economic miracle'.