কাজার রাজকুমারী: ভাইরাল মিমের পিছনে নারীবাদের অগ্রদূত দুই নারী

603
0

‘রাজকুমারী কাজার’ এবং কয়েক বছর আগে ভাইরাল হওয়া মিমের ঘটনা কমবেশি সবাইই জানে। তার জন্য ১৩ জন নিজের জীবন দিয়েছিল, এমন ঘটনা মিম হিসাবে সার্কুলার হয়েছে ব্যাপক। কিন্তু, এর পেছনের ঘটনা বা এর সত্যতা কতজন জানেন? প্রচলিত ঘটনার আড়ালে থাকা নারীবাদী আর আধুনিক চিন্তার কাজার রাজকুমারীদের জীবনের গল্প হবে আজ।

মিমের সত্যতা

প্রথমত, মিমে দেখানো নারী একজন নয়, মূলত দুইজন এবং তাদের কারো নামই ‘রাজকুমারী কাজার’ নয়। তারা উভয়েই পারস্যের কাজার রাজবংশের রাজকুমারী ছিলেন। কাজার রাজবংশ তুর্কি বংশোদ্ভূত ইরানি রাজবংশ, বিশেষ করে কাজার উপজাতি ১৭৮৯ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত ইরান শাসন করেছে।

ছবিতে দেখানো দুই নারীর চেহারা, তাদের ঠোঁটের নিচের হালকা গোঁফের আবরণ এবং অনেকটা পুরুষালি চেহারা সকলের হাস্যরসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, তারা তাদের কাজ দিয়ে ভিন্ন অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিলেন। বাহ্যিক সৌন্দর্য থেকে তারা অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন।

দুঃখজনক বিষয়, সেই সত্যতা না জেনেই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এই দুই নারীকে নেহায়েত কৌতুকের বিষয় বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরুষশাসিত সমাজের এটিও একটি বৈশিষ্ট্য, যেখানে নারীর বাহ্যিক রূপই প্রাধান্য পায় সবার আগে।

১৩ জন ব্যক্তির আত্মত্যাগেরও কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া যায়নি। কেননা, ছবির প্রথমজন ফাতেমেহ খানুম এসমাত আল-দৌলাহের পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয়েছিল ৯-১০ বছর বয়সে। পারস্যের ঐতিহ্য অনুযায়ী, এরপর কোন প্রেমিক থাকা বা ১৩ জন পাণিপ্রার্থী থাকাটা অসম্ভব।

ভাইরাল হওয়া মিম। Image source: AhSeeit

রাজকুমারী ফাতেমেহ খানুম এসমাত আল-দৌলাহ

নাসের আল-দীন শাহের দ্বিতীয় কন্যা, ফাতেমেহ খানুম এসমাত আল-দৌলাহ মূলত মিমটাতে প্রাধান্য পান। তার জন্ম ১৮৫৫ অথবা ১৮৫৬, তার মা তাজ আল-দৌলাহ। সেই সময়ের সবচেয়ে বেশি ছবি তোলা হয়েছে, এমন নারী সম্ভবত এসমাত। তার স্বামী দাস্ত মুহাম্মাদ খান মুয়াইর আল-মামলিকের তোলা ছবিটিই অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে।

এসমাতকে তার বাবা যথেষ্ট বিশ্বাস করতেন এবং যোগ্য মনে করতেন। তাকে বিদেশি নারী অতিথিদের আতিথেয়তার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তার বাবা। তিনি পিয়ানো বাজাতে পারতেন, সূচিকর্ম শিখেছিলেন এবং বাড়িতে নিজের স্টুডিওতে ফটোগ্রাফার হয়েছিলেন, যা তখনকার পারস্য সংস্কৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ ছিল।

তিনি পারস্যের সাংবিধানিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সমর্থক ছিলেন এবং নারী অধিকারের একজন কর্মী ছিলেন। তিনি ধর্মীয় সভায় যোগ দেওয়ার অজুহাতে গোপন বৈঠকের আয়োজন করতেন। সংসদে নারী অধিকারের জন্য একটি পদযাত্রার নেতৃত্বও দিয়েছিলেন তিনি।

রাজকুমারী এসমাত। Image source: Thread Reader App

রাজকুমারী জাহরা খানম তাজ এস-সালতানেহ

তার পুরো নাম জাহরা খানম তাজ এস-সালতানেহ (১৮৮৩-১৯৩৬)। তিনি পারস্যের রাজা নাসের আল-দিন শাহের কন্যা। তিনি ছিলেন কাজার রাজবংশের ইতিহাস সংরক্ষণকারী। তার স্বামী আমির হোসেন খান, তাদের চার সন্তান, দুই মেয়ে এবং দুই ছেলে।

তিনি রাজপরিবারের প্রথম নারী যিনি তার স্বামীকে তালাক দিয়েছিলেন, যা সম্পূর্ণভাবে পারস্য ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে ছিল। তারপর, তিনি সংক্ষিপ্তভাবে দুবার বিয়ে করেছিলেন। প্রথমটি বিবাহবিচ্ছেদে শেষ হয়েছিল, তবে দ্বিতীয়টির ফলাফল অজানা। বলাবাহুল্য, এই কারণে তাকে নিয়ে অনেক গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। কথিত আছে, পার্সিয়ান কবি আরেফ কাজভিনির কবিতা ‘আই তাজের’-এর বিষয়বস্তু ছিলেন জাহরা।

জাহরা তার যুগের নারীবাদের একজন পথপ্রদর্শক। তিনি ‘আঞ্জিমান হোরিয়াত নেসেভান’ (সোসাইটি অফ উইমেনস ফ্রিডম)-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন। এছাড়াও, তিনি একজন বুদ্ধিজীবী, লেখক, চিত্রশিল্পী এবং একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।

জাহরা ইরানে নারীদের অধিকারের জন্য কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়। আদালতে হিজাব খুলে পাশ্চাত্য পোশাক পরে আসা প্রথম নারী তিনি। এছাড়াও, তার স্মৃতিকথা ‘ক্রাউনিং অ্যাঙ্গুইশ: মেমোয়ার্স অফ আ পারসিয়ান প্রিন্সেস ফ্রম দ্য হারেম টু মডার্নিটি (১৮৮৪-১৯১৪)’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। জাহরা তার পিতা, তার ভাই মোজাফফর ডি-ল-দিন শাহ এবং রাজতন্ত্রের সমালোচনা করে ঘোষণা করেছিলেন যে, তাদের অযোগ্য শাসন সেই সময়ে পারস্যের অনেক সমস্যা যেমন দারিদ্র্য এবং শিক্ষার অভাবের জন্য দায়ী ছিল।

রাজকুমারী জাহরা। Image source: Wikimedia Commons

স্মৃতিকথায় জাহরা তার লালন-পালনের বিষয়ে তিক্ততা প্রকাশ করেছিলেন। কারণ, তার মায়ের সাথে তার খুব বেশি যোগাযোগ ছিল না। তিনি বলেছিলেন যে, শিশুদের মঙ্গলের জন্য মায়েদের উচিত নিজের শিশুর যত্ন নিজেই নেওয়া। তিনি রাজনৈতিক কৌশলগতভাবে সাজানো বিয়েরও বিরোধিতা করেছিলেন এবং একটি বিয়ে বা একগামিতার প্রচার করেছিলেন। জাহরা ঘোষণা দিয়েছিলেন,

যখন আমি নারীদের মুক্তি এবং আমার দেশকে উন্নতির পথে দেখব, তখন আমি স্বাধীনতার রণাঙ্গনে নিজেকে উৎসর্গ করবো।

হাতে লেখা এই ঘোষণাপত্র ইরানের ন্যাশনাল লাইব্রেরির আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। জাহরা মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার মেয়ে তুরান ডুলাহর সাথে ছিলেন। তিনি তার নাতনী তাজ ইরানকে পড়ালেখা এবং লালনপালনের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। জাহরাকে তাজরিশের জাহির ওদ-দৌলাহ কবরস্থানে দাফন করা হয়।

কাজার রাজকুমারী ও ইতিহাসবিদ

আজ পর্যন্ত জাহরা খানম তাজ এস-সালতানেহ-এর লেখা এবং একজন নারীবাদী হিসাবে তার ভূমিকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়নের বিষয় হিসেবে পড়ানো হয়। ২০১৫ সালে, তাজ সালতানেহের জীবন, পারিবারিক ছবি, লেখা এবং গল্প হার্ভার্ডে তাদের আর্কাইভে সংরক্ষিত করা হয়।

ড. আফসানাহ নাজমাবাদী, একজন ইরানি-আমেরিকান ইতিহাসবিদ এবং লিঙ্গ তাত্ত্বিক, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হিস্ট্রি অফ স্টাডিজ অফ উইমেন, জেন্ডার অ্যান্ড সেক্সুয়ালিটির একজন অধ্যাপক। তার বেশ কিছু কাজ প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘উইমেন উইথ মাস্টেচস অ্যান্ড মেন উইদাউট বিয়ার্ডস: জেন্ডার অ্যান্ড সেক্সুয়াল অ্যাংজাইটিস অফ ইরানিয়ান মডার্নিটি’ শিরোনামের একটি বই।

এই বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন যে, পারস্যে সেই সময়ে নারীদের চেহারায় কিছুটা পুরুষালি ভাব থাকাটা স্বাভাবিক এবং প্রচলিত ছিল। সৌন্দর্যের সংজ্ঞা সব সময়ে, সব স্থানে এক নয়। কিন্তু, কাজার রাজকুমারীদের কেউই এই নিয়ম শুরু করেননি। মূলত, কাজার রাজবংশে, হেরেম এবং দরবারে তারা যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন। নারী অধিকার এবং সুযোগের জন্য তারা কাজ করেছেন। বাহ্যিক রূপ নিয়ে তারা ভাবেননি। বরং, শুধু একটি বিষয়ে তাদের আবদ্ধ করা তাদের ভূমিকার অপমান করা হয়।

ড. নাজমাবাদীর বই। Image Source: University of California Press

তারা কাজার রাজবংশের রাজকন্যা ছিলেন। তারা কখনই ‘রাজকুমারী কাজার’ উপাধি বহন করেননি। তাদের পরিচয় নিয়ে জানার চেষ্টা না করে, বরং কাজার রাজকুমারী নাম দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, তারা ছিলেন পারস্যের নারীবাদী বিপ্লবের অগ্রদূত, হেরেমের ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী দুই নারী। বিশেষ করে জাহরা, নারীদের একটি কণ্ঠস্বর দেওয়ার পথ উন্মুক্ত করার জন্য দুর্দান্ত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।

ভাইরাল মিম অথবা ইন্টারনেটের হাজারো ভুল তথ্যের মাঝে, কাজার রাজকুমারীদের ভূমিকা হারিয়ে যাওয়া দুঃখজনক। তারা তাদের সময় থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। তারা পুরনো নিয়ম ভাঙতে পেরেছিলেন। তাই উচিত হবে, তাদের কাজ আর ভাবনা সম্পর্কে জানা। কাজার রাজকুমারীরা মিম নয়, বাহ্যিক রূপ নিয়ে কৌতুকের পাত্রী নয়। তার থেকেও তারা অনেক এগিয়ে, নিজেদের পরিচয়ে পরিচিত এবং গুণান্বিত।

 

Feature Image: All That's Interesting 
References:

01. tadj-es-saltaneh-persian-princess-qajar. 
02. untold-truth-of-a-beauty-symbol-of-Persia-princess-Qajar.