ইউরোপের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর নাম আসলে স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স কিংবা রাশিয়ার কথা উঠে আসে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা গোটা ইউরোপে এমন কিছু দেশ রয়েছে যাদের নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়ে থাকে। তন্মধ্যে ইউরোপের পূর্বাংশে অবস্থিত শিল্প ও সংস্কৃতিতে প্রাচুর্যময় একটি দেশ পোল্যান্ড।
গত বিশ বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে খুব ভালোভাবেই পোল্যান্ড তার অবস্থান জানান দিচ্ছে। বর্তমানে পোল্যান্ডকে ইউরোপের টাইগার ইকোনমি বা গ্রোথ মেশিন বলা হচ্ছে। কিভাবে পোল্যান্ড সফল হচ্ছে? এর কারণ কি?
তবে সেসব জানার আগে পোল্যান্ডের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন। দেশটি মূলত লিথুনিয়াকে নিয়ে একসময় পোল্যান্ড-লিথুনিয়া সম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল।
ইউরোপের মধ্যস্থলের এই দেশটি কখনোই তেমন একটা স্থিতিশীল পরিবেশে থাকতে পারেনি। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর দিকে একে অনেকবার হামলার শিকার হতে হয়। আবার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও পোল্যান্ড খুব মর্মান্তিকভাবে আক্রান্ত হয়েছিল।
বলা হয়ে থাকে, এই যুদ্ধে পোলিশ নাগরিকদের মৃত্যুর সংখ্যা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ থেকে অনেক বেশি ছিল। কেননা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ড জার্মানি ও রাশিয়ার প্লে গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার হয়েছে।
বিশ্বযুদ্ধের পর স্টালিন তথা রাশিয়া এই দেশে প্রভাব খাটাতে শুরু করে। যার ফলস্বরুপ, পোল্যান্ডকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই সময়ে রাষ্ট্র সবকিছুর মালিকানা বহন করার দরুণ দেশটির কোন উন্নতি হয়নি।
প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো যখন ১০ হাজারের অধিক ডলার বার্ষিক আয় করতো তখন পোল্যান্ডের শ্রমিকরা মাত্র কয়েক হাজার ডলার আয় করে ইউরোপের সবচেয়ে কম বেতনভুক্ত দেশের তালিকায় নাম লেখায়।
অর্থাৎ, পোল্যান্ডের পূর্বের ইতিহাস তেমন সুখকর ছিল না বলাই যায়। তবে এটিই ইউরোপের প্রথম রাষ্ট্র যারা কমিউনিজমকে প্রত্যাখ্যান করে মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হয়। মূলত এখান থেকেই পোল্যান্ডের নতুন ইতিহাসের জন্ম।
১৯৮৯ সালে পোল্যান্ড মুক্তবাজার অর্থনীতির পথ বেছে নেয়। এর ফলেই তারা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বাণিজ্য ও প্রতিষ্ঠান চালু করতে পারে। কিন্ত হঠাৎ এই পরিবর্তন মানিয়ে নেওয়া সহজ ছিল না।
পোল্যান্ড তখন একটি শক থেরাপি নীতি গ্রহণ করে। অর্থাৎ, ধীরে ধীরে অগ্রসর না হয়ে দুর্বার গতিতে সবকিছু পরিবর্তন করে অর্থনীতির উন্নয়ন করা ছিল তাদের লক্ষ্য। যেমন–একদামের জিনিস বিক্রয় করা বন্ধ, মুদ্রার মূল্যহ্রাস, অপর্যাপ্ত প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি বন্ধ ইত্যাদি।
তবে এই শক থেরাপি সাথে সাথে কাজ করেছিল তা কিন্ত নয়। কেননা, ভারী শিল্পের শ্রমিক, সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি ও কৃষি খামার থেকে কর্মী ছাটাইয়ের দরুণ তাদের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়ে।
এই সমস্যার মূলে রয়েছে ম্যাক্রো ও মাইক্রো ইকোনমির নীতিগুলোর অসামঞ্জস্যতা। কিন্ত পোল্যান্ডের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক ছিল কোন ধরণের বিশেষ গোষ্ঠীশাসন বা অলিগার্কের প্রভাবে তারা পড়েনি, যেমনটা রাশিয়ায় হয়েছিল।
এতে করে সরকার স্বাধীনভাবে তাদের নীতি প্রণয়ন করতে পারছিল কোন ধরণের পিছুটান ছাড়াই। এর পাশাপাশি পোল্যান্ড সরকার পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্কের উন্নয়নে নজর দেয়।
তারা বুঝতে পারে যে, দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চাইলে পশ্চিমাদের আইন, সম্পত্তির অধিকার এবং বিধি বা নিয়ম কার্যকরের মতো বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে তারা ২০০৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত হয়। বলা যায়, ইইউ এর সদস্যপদ পাওয়ার মধ্য দিয়ে পোল্যান্ডের অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করে যা আজও চলমান।
তাহলে প্রশ্ন উঠে কি কি সুবিধা আদায় বা নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে পোল্যান্ড এই সদস্যপদের সুবিধাকে কাজে লাগিয়েছে?
ফান্ড আদায়
ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ ফান্ড প্রদান করে থাকে। পোল্যান্ড ইইউ এর অন্যসব সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে কম উন্নত হওয়ায় সবচেয়ে বেশি ফান্ড পেয়েছে।
বলা হচ্ছে, ২০১৮ সালের ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোট জিডিপির ৩ শতাংশ ফান্ড পোল্যান্ড গ্রহণ করেছে যা খুবই বেশি।
সঠিক নীতি প্রণয়ন
ফান্ড পাওয়ার পর উক্ত অর্থ যে ইচ্ছামতো খরচ হয়েছে তা কিন্ত নয়। পোল্যান্ড একে যথার্থ জায়গায় বিনিয়োগ করেছে।পূর্বে এর অর্থনীতি কৃষিনির্ভর হলেও তারা এখন শিল্পনির্ভর অর্থনীতিতেও মনোযোগ দিয়েছে। এখনো কৃষি প্রধান হলেও তারা তাদের অর্থনীতিকে বিচিত্রভাবে সাজিয়েছে।
উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রতিরক্ষা ও আকাশযান তৈরি, অটোমোটিভ ও আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিতে তারা গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করছে।
এর ফলস্বরূপ আমেরিকার মতো রাষ্ট্র ইউক্রেন যুদ্ধে পোল্যান্ডের মাধ্যমে অস্ত্র ব্যবসা করছে। অপরদিকে, পোল্যান্ডকে এখন এভিয়েশন ভ্যালি বলা হচ্ছে কেননা খুব অল্প খরচেই এখানে উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
পোল্যান্ড সরকার তার দেশকে বৈদেশিক বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ দিয়েছে। এতে করে নর্থভোল্ট তাদের সর্ব বৃহৎ কারখানা পোল্যান্ডে বানিয়ে ৫০০ এর অধিক মানুষকে কর্মসংস্থান দিয়েছে। এছাড়াও, মাইক্রোসফটের ১ বিলিয়নের বিনিয়োগ, গুগলের ডেটাহাবও পোল্যান্ডে রয়েছে।
পোল্যান্ডের জনশক্তি ব্যবহার
ইইউ এর সদস্যপদ পাওয়ার কারণে পোল্যান্ড ফ্রিতেই ইউরোপের অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্য করতে পারছে। এছাড়াও, পোল্যান্ডের কর্মীগণ আগের থেকেই দক্ষ হলেও এখন আরো বেশি পরিমাণ শিক্ষিত তরুণ বের হচ্ছে।
এতে করে এসব দক্ষ তরুণরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চাকরী করে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছে। প্রায় ২৫ লক্ষের মতো তরুণ এখন পোল্যান্ডের বাইরে কর্মের সাথে যুক্ত রয়েছে।
অপরদিকে বড় বড় কোম্পানি পোল্যান্ডের কর্মীদের খুব অল্প বেতনে কাজ করানোর ফলেও পোলিশরাই অন্যান্য দেশের নাগরিকদের থেকে এগিয়ে আছে।
২০১৩ সালের এক তথ্য অনুযায়ী পোল্যান্ডের বিনিয়োগে বিদেশী কোম্পানিদের পরিমাণ এক চতুর্থাংশ এবং রপ্তানি থেকে যা আয় আসছে তার অর্ধেকই এইসব কোম্পানি করছে।
জাতীয়করণ
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, পোল্যান্ডের পূর্বের ব্যবস্থা অর্থাৎ সরকারের মালিকানাধীন ব্যবস্থা এখন আর নেই। তবে কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম রয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে জিডিপি বৃদ্ধি পেলেও জনগণের মধ্যে অর্থের অসাম্যতা রয়েছে।
এরই ভিত্তিতে তারা তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংককে ৫০ শতাংশ ন্যাশনালাইজড বা জনগণের মালিকানা করেছে যাতে করে ধনী-গরিবের ব্যবধান বিশেষ করে দেশের পূর্বাংশে হ্রাস পায়।
কিছু সমস্যা ও এর সমাধান
বর্তমানে পোল্যান্ডে দক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা বেশি থাকায় অদক্ষ কিংবা আধা-দক্ষ কর্মীরা পিছিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিগণ এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এজন্য পোল্যান্ড সরকার ফ্যামিলি ৫০০ প্লাস (Family500+) নামক প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে।
এছাড়াও, তরুণরা বিদেশমুখী হওয়ায় তাদের আকর্ষণ করতে ২৫ বছরের নিচের ব্যবসায়ীদের ট্যাক্স কমিয়ে আনা হচ্ছে যা ইউরোপের মধ্যে সর্বনিম্ন। তরুণদের দেশে আনার সাথে সাথে পোল্যান্ডই সর্বোচ্চ সংখ্যক সাময়িক ভিসা দিচ্ছে শ্রমিকদের জন্য। এতে করে এশিয়া, আফ্রিকার শ্রমিকগণও সে দেশে কাজ করতে যেতে পারছে।
এটিই একমাত্র দেশ যেটি ২০০৮ সালের মন্দাতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি তো বটেই, করোনা মহামারীতেও সর্বনিম্ন অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে।
পোল্যান্ডকে নিয়ে ব্রিটেনের বিরোধী দলীয় নেতা শঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, তাদেরকে পোল্যান্ড ছাড়িয়ে যাবে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত আয়ের ক্ষেত্রে ২০৪০ সাল নাগাদ তারা জার্মানীর সমান হবে বলা হচ্ছে। পোল্যান্ডের এই গর্জন ইউরোপের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে নতুন দিকে নিবে তা নিয়ে কোন শঙ্কা নেই।
যেই দেশটিতে ৯০ এর দশকে প্রতি হাজারে ১৩০টির মতো ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল আজ তা সাড়ে পাঁচশতের কোটায়। এতেই বুঝা যায় সময় লাগলেও পোল্যান্ড ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হতে চলেছে।
Feature Image: ING Think References: 01. Why are Poles unimpressed with Poland’s economic achievements? 02. Poland home to “happiest” generation of Poles. 03. Poland’s rise is not about our faults. 04. Poland Is Europe’s Growth Champion. Can This Continue? 05. Why is Poland’s economy emerging so strongly? 06. How Poland Became Europe’s Growth Champion. 07. Is Poland a rising power and what are the implications? 08. Poland’s transformation.