জলদস্যু শব্দটি শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে অতীতের রাজা বাদশার আমলের গল্পগুলি যা এখনো আমাদের মনে গেঁথে আছে। এমন গল্প বা ঘটনা অনেক ছিল সত্য আবার অনেকটা রূপকথার বানানো গল্প। আধুনিক যুগে এখনো বিশ্বের এমন একটি অঞ্চল রয়েছে যেখানে জলদস্যুরা সমুদ্র শাসন করে। আর সেই দেশটির নাম সোমালিয়া৷ আমাদের আজকের টপিক সোমালিয়ান জলদস্যুতা।
১৯৯১ সালে সোমালিয়ান সরকারের পতন, ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ এবং অদক্ষ নতুন সরকারের জন্মের পর, সোমালিয়া দেশটি জলদস্যুতার নতুন যুগের জন্মস্থান হয়ে ওঠে। মাঝ সমুদ্রে বিদেশি জাহাজ লুট করার সময় তাদের নৃশংসতা এখন সর্বত্র প্রচারিত। কিন্তু তারা এমন হিংস্র ছিলেন না। গরীব দেশের গরীব মানুষ তারা, অর্থাভাবেই এমন নৃশংসতার পথ বেছে নিতে হয়েছে আজ।
সোমালিয়ান জলদস্যুতার কারণ
লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের কারণে মিশর ও ভারতের সাম্রাজ্যের মধ্যে নৌ-বাণিজ্যের পথ সংযুক্ত হওয়ার কারণে সোমালিয়ায় প্রাচীনকাল থেকেই জলদস্যুতা ছিল। রোমান সাম্রাজ্য (মিশরকে সংযুক্ত করার পর) এই বিশাল নৌ বাণিজ্য রক্ষার জন্য লোহিত সাগর জুড়ে সামরিক ফাঁড়ি স্থাপন করে। ফলস্বরূপ সোমালিয়ার নিজেরই একাধিক বাণিজ্য শহর ছিল।ফলে জলদস্যুতা এবং হানাদারদের বিপদ সত্ত্বেও বাণিজ্যের উন্নতি হয়েছিল। ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ায় বৈরী উপজাতি থাকা সত্ত্বেও তাদের অভ্যন্তরীণ অঞ্চল থেকে হাতির দাঁত, গন্ধরস এবং অন্যান্য আফ্রিকান পণ্য রপ্তানি করেছিল।
সোমালিয়ানরা পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র জাতিগুলির মধ্যে একটি যারা ক্রমাগত দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য এবং রাজনৈতিক অনৈক্যের সাথে জীবন অতিবাহিত করছে। এডেন উপসাগর বাণিজ্য জাহাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান কারণ এটি ভারত মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে বাণিজ্যের জন্য অনুমতি দেয়। জাহাজের এই ট্র্যাফিক এখান থেকে বড় বড় মাছ ধরে নিয়ে চলে যেতো।এই এলাকার জেলেরা যে কারণে মাছ পেতো না ও বেকার হয়ে পড়েছিল এবং প্রতিশোধ হিসাবে এই জাহাজগুলিতে আক্রমণ শুরু করেছিল।
১৯৮৬ থেকে সোমালিয়ান বিপ্লবের সময় শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত এখানে গৃহযুদ্ধ চলছে । গৃহযুদ্ধে জড়িত ও বিদ্রোহী বাহিনী দ্বারা বিভক্ত জাতিকে নিয়ে এই সন্ত্রাসীরা তাদের যুদ্ধে অর্থায়নের জন্য এডেন উপসাগরে জলদস্যুতা শুরু করে।
বেআইনি ভাবে যে সমস্ত ইউরোপীয় জাহাজ সোমালিয়ার সমুদ্র উপকূল থেকে মাছ ধরত এবং বর্জ্য ফেলত, তাদেরকে বিতাড়িত করতে সোমালিয়ান উপকূলবাসী ট্রলার এবং স্পিডবোট নিয়ে নিজেরাই সাগরে নেমে পড়ে।
কিন্তু এসব জাহাজগুলিকে তারা তাড়াতেও পারছিলেন না এবং শুল্কও বসাতে পারছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে বর্জ্য ফেলতে আসা কিছু জাহাজকে আটকে ফেলে ঐ উপকূলবাসী সোমালিয়ানরা।এর পর থেকে তাদের মনে জলদস্যুতার নতুন ধারণার জন্ম হয়।এরকম ধারণা থেকে কতিপয় জেলে হাতে অস্ত্র তুলে নেন । আর এর থেকেই আধুনিক যুগের সোমালিয়ান জলদস্যুদের উত্থান।
সমুদ্রে মাছ ধরার সুবাদে জেলেরা সাগরের আদ্যোপান্ত জানত।আর তাদের সাথে যোগ দেয় সোমালিয়ান কিছু কোস্ট গার্ড বা সেনাবাহিনী।এদের সমন্বয়ে জলদস্যু দল তৈরি হয়।
জলদস্যুরা আজও বিদ্যমান এবং তাদের ক্ষমতা বেড়ে চলছে, তাদের জলদস্যুতা ছড়িয়ে পড়ছে ভারত পর্যন্ত। যেহেতু সোমালিয়ায় কোনো একক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নেই, তাই ‘সোমালি জলদস্যু’ শব্দটি যে কোনো সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহী বাহিনীকে বোঝাতে পারে।যদিও সবচেয়ে শক্তিশালী বলে মনে করা হয় আল-শাবাব বাহিনীকে যার সেনাবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা প্রায় ১৫,০০০ ।২০১১ সালে তারা দখল করে নিয়েছে সোমালিয়ার দক্ষিণ দিকের অর্ধেক।
এসব সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহী বাহিনীদের জনগণের উপর আরও ভালো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ফলে সোমালিয়ায় সহিংসতা কয়েক বছর ধরে বেড়েছে এবং সোমালিয়াকে বিশ্বের সবচেয়ে অস্থিতিশীল সরকারগুলির মধ্যে একটি করে তুলেছে। যদিও জলদস্যুতা একটি অপরাধ তবুও এর মাধ্যমে প্রচুর অর্থের যোগান হয়।কারণ জলদস্যু বাহিনীগুলো আন্তর্জাতিক ক্র্যাকডাউন থেকে কোনো না কোনোভাবে বেঁচে গেছে আর তাদের শীঘ্রই যে কোনও সময় মারা যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
সোমালি জলদস্যুদের হামলা
সোমালি জলদস্যুদের দ্বারা পরিচালিত প্রথম সংগঠিত জলদস্যু আক্রমণটি ২০০৫ সালে সোমালি গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হওয়ার পরপরই শুরু হয়েছিল। যদিও সেই আক্রমণের সঠিক কারণ জানা যায়নি। কেউ কেউ দাবি করে যে জেলেরা তাদের জলকে বিদেশী জাহাজ থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল অথবা যে বিদেশী বিষাক্ত ডাম্পগুলি সমুদ্রের প্রাণীদের ব্যাপক ক্ষতির সৃষ্টি করেছিল যা জেলেদের সহিংসতায় বাধ্য করেছিল।
সময়ের সাথে সাথে জলদস্যুরা আরও বেশি সুয়েজ থেকে ভারতগামী শিপিং লেন আক্রমণ করতে শুরু করে। যেহেতু আন্তর্জাতিক যুদ্ধজাহাজগুলি আরও বেশি উপস্থিত হতে থাকে,এর বিপরীতে সোমালি জলদস্যুরা আরও বেশি উন্নত কৌশল ব্যবহার করতে শুরু করে। এখন পর্যন্ত তারা নৌ-মাদার জাহাজ ব্যবহার করে যা তাদের খোলা সমুদ্রে দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে বড় আকারের আক্রমণ সংগঠিত করতে সাহায্য করে।
সোমালিয়াতে শক্তিশালী সরকারের অভাব, দারিদ্র্য এবং সর্বদা অপরাধ এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে সেখানে জলদস্যুরা কোস্ট গার্ড হিসাবে কাজ করার আড়ালে স্থানীয় গডফাদারদের জন্য কাজ করে। সফল জলদস্যুরা দেশের বাকি জনগণের তুলনায় অনেক ভালোভাবে জীবনযাপন করে, যা অন্যান্য দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত সোমালিয়ানদের এ পথে আসাকে উতসাহিত করে।বিভিন্ন মতানুসারে, স্থানীয় সোমালি জনসংখ্যার ৭০ শতাংশেরও বেশি তাদের জলদস্যু বহরকে দেশের মাছ ধরার ক্ষেত্রগুলির অন্যতম প্রধান রক্ষাকর্তা হিসাবে সমর্থন করে।
জলদস্যুতা বৈধ না অবৈধ
জলদস্যুতাকে আমরা সাধারণত অবৈধ পেশা হিসেবেই ধরি।কিন্তু সোমালিয়ায় এ পেশা এতই আকর্ষণীয় যে ওখানকার মানুষ স্বপ্ন দেখে জলদস্যু হওয়ার।এ কারণে সোমালিয়ায় এ পেশাটি বৈধ।এর কারণ হিসেবেও তারা বলে যে বিদেশী জাহাজগুলো দ্বারা অবৈধভাবে মাছ ধরা এবং বর্জ্য ফেলার বিরুদ্ধে লড়াই করতে তারা জলদস্যুতা করছে।এসব কারণে বহু অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরাও জলদস্যুদের দলে যোগ দিতে শুরু করে।
অবশ্য এই অভিযোগগুলি বেশ গ্রহণযোগ্য । কারণ জাতিসংঘ অনুমান করে যে ইউরোপ এবং এশিয়া থেকে অবৈধ মাছ ধরার কোম্পানিগুলি বছরে সোমালি উপকূলরেখা থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি হলুদ টুনা লুট করে । এছাড়া জাহাজ থেকে নিঃসৃত বর্জ্য সাগরের পানি দূষিত করছে।আর এসব বর্জ্য সোমালিয়ার উপকূলে গিয়ে জড়ো হয়ে উপকূল ভরে ফেলছে।তাই নিজেদের এলাকা তথা পরিবেশ দূষণ রোধে বর্জ্য নিঃসরণকারী এসব জাহাজের বিরুদ্ধে এটা একটা প্রতিবাদ। এদিক থেকে বিবেচনা করলে সোমালিয়ান জলদস্যুরা বৈধ কাজ করছে।
মূলত উভয় পক্ষই এসব অপরাধ নিজেদের স্বার্থে করছে।ক্ষেত্র বিশেষে কখনও তা হয়ে ওঠে বৈধ আবার কখনও হয়ে যায় অবৈধ।
জলদস্যুদের পরিণতি
সোমালিয়ার জলদস্যুরা হয়ত সারা পৃথিবীবাসীর ক্ষতি করছে না,কিন্তু কোন নির্দিষ্ট দেশের ক্ষতি করছে।আবার এসব ক্ষতি করতে তারা অন্যের এলাকায়ও যায় না।বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের অঞ্চলে অনুপ্রবেশকারীদের উপর হামলা করছে।এজন্য জলদস্যু মোকাবিলায় পৃথিবীর সব দেশের মাথাব্যথা নেই যতটা ভুক্তভোগী দেশগুলোর আছে।
তবে জাতিসংঘ এ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখছে। জাতিসংঘের পাশাপাশি ইইউ এবং ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপের চেষ্টা সত্ত্বেও সোমালিয়ায় জলদস্যুতা বন্ধ হচ্ছে না। দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের অভাবের কারণে, কোনও অভ্যন্তরীণ কর্তৃত্ব জলদস্যুদের কাজে হস্তক্ষেপ করেনা। বিশেষ করে আল-শাবাব, আল-কায়েদার সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি ইসলামি বিদ্রোহী গোষ্ঠী যা সোমালিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ট্রানজিশনাল ফেডারেল সরকারের সাথে গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, সোমালিয়ার বৃহৎ উপকূলরেখা বরাবর এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জলদস্যুতা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সমর্থন পেয়েছে।
সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যুতা দীর্ঘদিন ধরে মিডিয়া এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু এ বছর মার্চে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের (UNSC) কাউন্টার-পাইরেসি রেজুলেশন 2608-এর মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে জলদস্যুতার খবর অতটা প্রচার হয়নি। ২০০৮ সালের পর এই প্রথম (UNSC) এই অঞ্চলের জলদস্যুতার রেজোলিউশন পুনর্নবায়ন করেনি।
জলদস্যুতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অন্যান্য দেশের যুদ্ধজাহাজকে সোমালিয়ার জলে টহল দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য কয়েক বছর ধরে সোমালিয়া জাতিসংঘের অনুমোদনের বিরোধিতা করে আসছে।কারণ সোমালিয়া সেই জলের উপর পূর্ণ সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিল।
সোমালিয়া পাল্টা বলেছে যে জলদস্যুতার অনুপস্থিতির অর্থ জাতিসংঘের ম্যান্ডেটের আর প্রয়োজন নেই।
(UNSC) কাউন্টার-পাইরেসি রেজুলেশন 2608 ছিল সোমালি জলসীমায় জলদস্যুতার বিরুদ্ধে আটলান্টে নামে একটি ইউরোপীয় অভিযানের অধীনে প্লেন এবং জাহাজ দিয়ে পরিচালিত লড়াই। এটি ২০০৮ সালে শুরু হয়েছিল এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদনের অধীনে ইউরোপীয় কর্মকর্তারা ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত বর্ধিত করেছিলেন।
এখন যদিও জাতিসংঘের অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।তবুও সোমালিয়ার দাবি সেই জাহাজ এবং বিমানগুলি এখনও জলদস্যুদের তাড়াতে এবং তাড়া করতে পারে তবে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক আকাশ ও জলসীমায়, সোমালিয়ায় নয়।
পরিশেষে আমরা দেখছি সোমালিয়ার গৃহযুদ্ধ এখনও চলমান রয়েছে।তবে বৃহৎ কার্গো এবং ক্রুজ বোটের বিরুদ্ধে জলদস্যুতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে কারণ বিদেশী নৌবাহিনী এই অঞ্চলে তাদের জাহাজগুলিকে আরও ভালভাবে রক্ষা করছে এবং বড় জাহাজগুলি আত্মরক্ষার জন্য ভারী সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়োগ করা শুরু করেছে।তাছাড়া আন্তর্জাতিক চাপও রয়েছে জলদস্যুদের উপর।
Feature Image: inquirejournal.com References: 01. Somali pirates.History of piracy. 02. Is-somali-piracy-finally-under-controIs-somali-piracy-finally-under-control. 03. Somali-piracy-causes-and-consequences.