পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যার কারণে কোন একটি দেশের বা পারিপার্শ্বিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হতে দেখা গেছে। তন্মধ্যে জাপান কর্তৃক পার্ল হারবার আক্রমণ অন্যতম।
জাপানের এই আক্রমণ শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়নি, তার সাথে সাথে আধুনিক বিশ্ব রাজনীতির কাঠামোতে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিল রাতারাতি। পার্ল হারবারে ছিল আমেরিকান সামরিক ঘাঁটি। এই ঘাঁটিতে আক্রমণের দ্বারা জাপান আমেরিকাকে সরাসরি যুদ্ধে যোগ দেওয়ার উস্কানি দেয়। এবং এর ফলাফল হিসেবে আমেরিকাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যোগ দেয়।
কেন জাপান পার্ল হারবারে আক্রমণ করলো? এই আক্রমণই কি অক্ষ শক্তিকে পরাজয়ের মুখ দেখালো? আক্রমণটি না হলে কি বা ঘটতো? -আলোচনা হবে এই বিষয়গুলো নিয়েই।
জুলাই ১৯৪১, জাপান পরিকল্পনা করলো বর্তমান ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং পার্ল হারবারে একযোগে আক্রমণ করা হবে। জাপানের তৎকালীন নৌবাহিনী প্রধান ধরেই নিয়েছিল যে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জাপানের যুদ্ধ অনিবার্য। তাই যত দ্রুত সম্ভব, সামরিক বাহিনীর জ্বালানি শেষ হওয়ার পূর্বেই আমেরিকাকে ঘায়েল করতে হবে।
যদিও অনেকে বলে থাকেন যে, সরকার এই আক্রমণ চায়নি। নৌ এবং সেনাবাহিনীর ইচ্ছাতেই এই আক্রমণ হয়। সে যাইহোক, জাপানিজ ইম্পেরিয়াল নেভি তাদের ব্যাটেলশিপ আর্নাডাকে প্রস্তত করে। যাতে ছিল ছয়টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এবং ৪১৪টি এয়ারক্রাফট।
উল্লেখ্য, এই আক্রমণ এমনভাবে করা হয় যেন আমেরিকা আক্রমণ সম্পর্কে একটুও আন্দাজ করতে না পারে। কোন আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বেই এডমিরাল ইয়ামামোতো পার্ল হারবারে অবস্থিত আমেরিকান প্যাসিফিক ফ্লিটকে আক্রমণ করতে যায়। আক্রমণের মাত্র ত্রিশ মিনিট পূর্বে জাপানিজ কর্তৃপক্ষ আমেরিকানদের একটি নোটিশ দিলেও সেটি হাই কমান্ডে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না।
৭ই ডিসেম্বর সকাল সাড়ে সাতটার দিকে জাপানিক ইম্পেরিয়াল নেভি প্রথম ধাপের আক্রমণ করে। এরপরে টানা ২ ঘন্টা যাবৎ আক্রমণ চলতে থাকে। আক্রমণে প্রায় দুইশত এয়ারক্রাফট এবং আটটি ব্যাটেলশিপ ধ্বংস হয়ে যায়। যদিও ঐ দিন অন্যান্য এয়ারক্রাফট এবং সাবমেরিন আমেরিকান ঘাঁটিতে ছিল না এবং অনেক সদস্যও ছুটিতে না থাকলে সংখ্যাটি আরো বৃদ্ধি পেতো।
এত কিছুর পরও জাপানের এই আক্রমণে দেড় হাজার জনের মৃত্যু এবং প্রায় এক হাজার মানুষ আহত হোন। আমেরিকা তো যুদ্ধে লিপ্ত ছিল না, তবে কেন এই আক্রমণ? এই প্রশ্ন উঠে আসা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। জাপানের হঠাৎ এই আক্রমণের কারণ জানতে হলে ফিরে যেতে হবে অনেক আগের ইতিহাসে।
জাপানের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব
জাপানের শাসক মেইজি ক্ষমতায় থাকাকালে জাপান অনেক উন্নতি লাভ করতে থাকে। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, এই সময়টাতেই আমেরিকাসহ পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এশিয়া প্যাসিফিক এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের কলোনি এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য অনুকূল পরিস্থিতি গড়ে তোলে।
তারা এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের নিকট নজর দেয়। আবার, জাপানও আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে এই সম্পদের জন্য কৌশল অবলম্বন করতে থাকে।
প্রথমত, জাপান চাইতো না যে এশিয়া অঞ্চলটিকে অন্য কেউ শাসন করুক। এবং দ্বিতীয়ত, চীনা বাজার নিয়ন্ত্রণে আমেরিকার সাথে তাদের দ্বন্দ্ব লেগে ছিল। অর্থাৎ আমেরিকা এবং জাপান পূর্বের থেকেই এই অঞ্চলে প্রভাব রাখতে শুরু করে।
এরই জের ধরে ১৯৩১ সালে জাপান চীনের মাঞ্চুরিয়া অঞ্চল দখল করে নেয়। সেখানে তারা একটা পুতুল সরকার গঠন করে যেটা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে।
এর পাশাপাশি জাপান তৎকালীন “লীগ অফ নেশনস” থেকে সরে যায়। ফলাফল হিসেবে জাপানকে আন্তর্জাতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দুস্কর হয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪০ সালে তারা ফ্রান্সের কলোনিগুলোতেও আক্রমণ চালাতে থাকে। এই কলোনিগুলো ছিল আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে।
এখানে আক্রমণ করার মাধ্যমে জাপান মিত্র শক্তি চীনের নিকট আসা জ্বালানি এবং অস্ত্র সরবারহ বন্ধ করে দেয়। যদিও এই অঞ্চলটি তারা বেশিদিন দখলে রাখতে পারেনি।
ফ্রান্সের কলোনিগুলোতে আক্রমণ করার দরুণ আমেরিকা-জাপান সম্পর্ক আরো বেশি সঙ্কাটপন্ন হয়ে পড়ে। এছাড়াও জাপান ইতালি ও জার্মানির সাথে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি (Tripartite Pact) করে বসে। এই চুক্তিতে রাষ্ট্রগুলো পরস্পরকে রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক এমনকি সামরিক সহায়তার নিশ্চয়তা দেয়।
আসলে এসবের মূল কারণ হচ্ছে অর্থনীতি। জাপানের শিল্পায়নের জন্য যেসব সামগ্রী ও সম্পদ দরকার ছিল তার বেশিরভাগই ছিল আমদানি নির্ভর।
বর্তমানের চীন যেমন একটি রপ্তানি নির্ভর একটি দেশ ঠিক তেমনি জাপানও রপ্তানিতে জোর দিচ্ছিল। তবে ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় তাদের পরিকল্পনায় ভাটা পড়ে।
ট্যারিফ খরচ বৃদ্ধি এবং আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতিতে অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। এই অসামঞ্জস্যতা জাপানের সরকারকে চিন্তিত করে ফেলে। এর থেকে বাঁচতেই তারা ইন্দো-চীন, ডাচ ইস্ট ইন্দো এবং মালয় অঞ্চলে একটি সাম্রাজ্য স্থাপনের পরিকল্পনা সাজায়।
মোদ্দা কথা, অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দিতে জাপান সাম্রাজ্যবাদের পথ বেছে নেয়। তারা যদি পার্ল হারবারের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যেতো, তাহলে প্যাসিফিক অঞ্চলের সম্পূর্ণটা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতো। কিন্তু পার্ল হারবার আক্রমণের পর প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের যুদ্ধ ঘোষণা তা আর হতে দেয়নি।
আমেরিকান পলিসি
আমেরিকানরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রথমে অংশগ্রহণ না করলেও তারা জার্মানি এবং ইতালিকে পরাজিত করতে চাচ্ছিল। এজন্য তারা পেছন থেকে অক্ষশক্তিকে আঘাত করছিল। জাপানের রপ্তানি পণ্যের কাঁচামালের ৮০ শতাংশ পণ্য আমেরিকা থেকে সরবরাহ হচ্ছিল।
১৯৪০ সাল নাগাদ তারা আয়রন, স্টিল, বিমানের জ্বালানি সরবারহ বন্ধ করে দেয়। এবং ১৯৪১ সালের দিকে কপার, নিকেল, ব্রোঞ্জ-এর রপ্তানিও তারা বন্ধ করে দেয়। এর সাথে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ ডাচ ইন্দিজ কোম্পানিগুলোকেও সরবারহ বন্ধ রাখতে বলে।
এতে করে জাপানের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপদে পড়ে। তারা আমেরিকাকে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে আরো দৃঢ় হয়ে উঠে।
এসব কারণ ছাড়াও দেখা যায় যে, জাপানের সাথে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর শান্তি চুক্তিগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী আচরণ এবং দক্ষিণ চীন দখল নিয়ে কোন মীমাংসা হয়নি। এসব কারণেই জাপান আক্রমণ করার পথ বেছে নেয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন যে,
পার্ল হারবারের আক্রমণ কৌশলবিহীন ও অর্থহীন একটি আচরণ।
হয়তো তারা ভেবেছিল যে আমেরিকাকে আক্রমণ করলে আমেরিকানরা তাদের আচরণ পরিবর্তন করবে এবং ব্রিটেন, ফ্রান্সও তাদের ক্ষমতার জানান পাবে।
পার্ল হারবার আক্রমণ কি অক্ষশক্তির পরাজয়ের কারণ?
কিংস কলেজের অধ্যাপক চার্লি ল্যাডারম্যানের মতে, পার্ল হারবারের এই আক্রমণ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি তথা আমেরিকাকে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তৈরি করতে বাধ্য করেছে।
আবার অনেকে বলেন যে, পার্ল হারবারের এই আক্রমণের চেয়ে আক্রমণের পর হিটলারের আচরণ অক্ষশক্তির জন্য আরো ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে আমেরিকা সরাসরি জার্মান নেভির সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে যায়।
জাপানের এই আক্রমণের জন্য অক্ষশক্তির পরাজয় হয়েছে কিনা তা নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। তবে এই আক্রমণের মাধ্যমেই যে বিশ্বে নিউক্লিয়ার অস্ত্রের যুগ শুরু হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আক্রমণ না হলে কি হতো?
জাপান আক্রমণ না করলে হয়তো আমেরিকাও হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে আক্রমণ করতো না এটা অনেকেই নিশ্চিতভাবে ধরে নেয়। আবার, একপক্ষ মনে করে যে দুই দেশ তবুও যুদ্ধে লিপ্ত হতো। কেননা, জাপানের সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব আমেরিকাকে টেক্কা দেওয়ার জন্যই ছিল; যা পরবর্তীতে দুই দেশকে সরাসরি বিরোধে জড়াতে পারতো।
এছাড়াও আক্রমণ না হলে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি না জড়িয়ে পেছন থেকে পশ্চিমাদের সহায়তা দিতো। অর্থাৎ তাদের “আইসোলেশন” বহাল থাকতো। পার্ল হারবার আক্রমণ না হলে অনেক কিছুই ঘটতে পারতো। কিন্ত এই আক্রমণ হওয়ার ফলে যে আমেরিকা নামক ঘুমন্ত সিংহকে জাপান জাগিয়ে তুলেছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
বিশ্ব রাজনীতির সিংহভাগই তাদের দখলে। এমনকি সেই জাপানও আজ তাদের সামরিক সহায়তার উপরই নির্ভরশীল। একটি ঘটনা সম্পূর্ণ দুনিয়ার প্রেক্ষাপট বদলে দেওয়ার অন্যতম উদাহরণ এই আক্রমণ।
Feature Image: brittanica.com References: 01. Axis powers miscalculated. 02. Did the Attack on Pearl Harbor Cost the Axis Powers the War? 03. Why Did Japan Attack Pearl Harbor? 04. Alternate history: what if Japan hadn't attacked Pearl Harbor? 05. 75 years ago, what if Japan never attacked Pearl Harbor? 06. America after the pearl harbor attack.