বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার রেভিনিউ অর্জন করা এবং মানুষের তৈরী আশ্চর্য পানামা খাল – এক অবাক বিস্ময়েরই নাম। মানুষের ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ক্ষমতার এক আশ্চর্য উদাহরণ এই পানাম খাল। এটি তৈরি করা হয়েছিল এক দুর্গম এলাকায়। ক্রস করতে হয়েছিল প্রায় ৮০ কিলোমিটারের ঘন জঙ্গল। যেখানে শ্রমিকদের ফেস করতে হয়েছিল বিষাক্ত মশা এবং মাকড়সাদের এবং ২৫ হাজার মানুষের বলিদানের পর তবেই এই খাল তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল।
বর্তমানে প্রায় ১০০ বছর পর এটি পৃথিবীর দুটি মহাসাগরকে একে অপরের সাথে যুক্ত করে এবং প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী জাহাজের একটি সুরক্ষিত জলপথ প্রদান করে। তা সত্ত্বেও, এটি সব সময়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যায়।
প্রায় ষোড়শ শতাব্দী থেকে মানুষ এই খাল তৈরি করার স্বপ্ন দেখেছিল। সেই সময় আমেরিকার পূর্ব উপকূল থেকে পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত যাওয়ার জন্য দক্ষিণ আমেরিকার কেপ হর্ন থেকে ঘুরে যেতে হতো। আর এর জন্য পথ অতিক্রম করতে হতো ১৫ হাজার কিলোমিটার। সেই সময়ের জাহাজগুলোর এই পথ অতিক্রম করতে দুই মাস সময় লেগে যেতো। এই কারণেই মানুষ সেই সময় থেকে মনে করতো যদি এই খাল তৈরি করা যায় তাহলে ১৫ হাজার কিলোমিটারের ভ্রমন মাত্র ৮২ কিলোমিটারের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব। এবং যে টাকা ইনকাম করা যাবে সেটা একটা সোনার খনি থেকে কম না।
শুধুমাত্র জাহাজগুলোকে চার্জ করা হবে সেটাই নয় বরং পৃথিবীর প্রান্তের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে যার রাজনৈতিক গুরুত্ব হবে অদ্বিতীয়। ঠিক যেমন এর সুবিধাগুলো চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো ছিল সেভাবে একে তৈরি করার কাজটাও ছিল অনেক ঝক্কি-ঝামেলার।
পৃথিবীর অনেক দেশ চেষ্টা করে খাল তৈরি করার। এমনকি দুটো দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায় এবং হাজার হাজার মানুষ নিজের প্রাণ হারায়। শেষ পর্যন্ত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পানামা খালের কনস্ট্রাকশনের কাজ প্রায় ষোড়শ শতাব্দীতে শুরু হয়। একজন স্পেনের অনুসন্ধানকারী যার নাম ছিল ভাস্কো নুনিয়েজ দ্যা ভালভোয়া তিনি প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন পানামা একটি গভীর সরু জায়গা যেটা প্রশান্ত মহাসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরকে আলাদা করে রেখেছে। তিনি প্ল্যান করে রেখেছিলেন কিভাবে এই খালটি তৈরি করা যেতে পারে এবং তিনি সেই প্ল্যান নিয়ে চার্লস দ্য ফিফথ অর্থাৎ সেই সময়কার স্পেনের রাজার সাথে পরামর্শ করেন।
তিনি একটি সার্ভে করে দেখার চেষ্টা করেন এই খালটি তৈরি করা সম্ভব কিনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্ল্যানটি ব্যর্থ হয়। তারপর প্রায় তিনশ বছর লেগে যায় ওই খাল নির্মাণের আইডিয়াটি আবার মানুষের মাথায় আসতে। আর সেই সময় এই বুদ্ধিটা আসে ফ্রান্সের একজন ব্যক্তির মাথায়। কারণ সবেমাত্র ফ্রান্স এমন একটি প্রজেক্ট তৈরি করেছিল যার নাম সুয়েজ খাল। এক খাল ভূমধ্যসাগরকে লোহিত সাগর পর্যন্ত যুক্ত করেছিল।
সুয়েজ খাল সুপারভাইজ করেছিলেন একজন ফ্রেন্স ডিপ্লোম্যাট ফার্দিনান্দ ডি ল্যাসেপস এবং তার হাতে পানামা খালের ডিজাইনটি প্রথম দেওয়া হয়। তিনি ডিজাইনটি দেখেন এবং দেখে মনে করেন এই খালটি সুয়েজ খাল থেকে অনেক সহজ হবে। এরপর ফ্রান্স সরকারের অনুমোদন পাওয়ার পর ১৮৮১ সালে খালটি তৈরির কাজ করা শুরু হয়। কাজগুলি পরের বছর বন্ধ হয়ে যায় কারণ একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প পুরো ইস্টমাসকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রকল্পের অর্থায়ন ১৮৮৮ সালে বন্ধ হয়ে যায় এবং এটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়। এরপরেই আমেরিকানরা বিংশ শতাব্দীর প্রকল্পটি আবার চালু করতে হস্তক্ষেপ করেছিল এবং পানামানিয়ান সরকারের মতে ১৯১৪ সালে এটি খালের দরজা খুলেছিল।
পানামা খালের দৈর্ঘ্য ৬৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৩০ থেকে ৯০ মিটার পর্যন্ত। তবে গভীর জলভাগ থেকে এর দৈর্ঘ্য হিসেব করলে এর দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৮২ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮৫ ফুট উঁচু ভূপৃষ্ঠ অতিক্রম করে পানামা খাল প্রবাহিত হয়েছে এবং অপর পাশের বিশাল জলরাশিকে করেছে একত্রিত। এত উঁচু দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণেই বহু চ্যালেঞ্জ নিয়ে এটি নির্মাণ করতে হয়েছে এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত এর রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত জটিল। এমনকি এখান দিয়ে জাহাজ পারাপার করার সময় অনুসরণ করা হয় এক বিশাল প্রক্রিয়া।
পানামা খাল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপ, এশিয়া এবং অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে এক অন্য রূপ দান করেছে। পানামা খাল যেহেতু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৫ ফুট উঁচু তাই অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে যে এত উপরে কীভাবে পানি ধরে রাখা হয় আর কীভাবেই বা এর উপর দিয়ে জাহাজ চলাচল করে।
এখানকার পানি ধরে রাখা থেকে জাহাজ চলাচল পর্যন্ত সকল প্রক্রিয়াই কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। পানামা খালে মোট তিন জোড়া জলকপাট রয়েছে যেগুলো পানামার খালকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ধাপে ধাপে ৮৫ ফুট পর্যন্ত ধাপে ধাপে উপরে তুলে দিয়েছে। প্রত্যেক জলকপাট দুটি ধাতব কব্জার দ্বারা তৈরি। প্রতিটি কব্জা সাত ফুট মোটা এবং অবস্থান অনুযায়ী ৪৭ থেকে ৮২ ফুট পর্যন্ত উঁচু। জাহাজ চলাচলের সময় এসব কব্জা খুলে বা বন্ধ করে পানির স্তর জাহাজ চলাচলের উপযোগী করা হয়।
পানামা খালে গার্টন লেক এবং গাইলার্ড কাট নামে দুটি চ্যানেল রয়েছে। এই চ্যানেল দুটিতেই মূলত জল কপাটগুলো কাজ করে। জাহাজ পানামা খালে ঢুকা বা প্রবেশ করার পূর্বে জাহাজগুলোকে ছাড়পত্র গ্রহণ করতে হয়। কারণ এই খাল দিয়ে বর্তমানে একইসঙ্গে মাত্র দুটি জাহাজ চলাচল করতে পারে। যদিও ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত এই খাল দিয়ে মাত্র একটি জাহাজ চলাচল করতে পারতো।
চ্যানেল দিয়ে জাহাজ চলাচলের জন্য চ্যানেলের উভয় পাশে অত্যন্ত শক্তিশালী ক্রেন কাজ করে। এছাড়া পানি অপসারণ এবং যোগান দিয়ে পানির স্তর সমান করার জন্য কাজ করে অত্যন্ত শক্তিশালী কয়েকটি পাম্প। চ্যানেলের প্রস্থ মাত্র ১১০ ফুট হওয়ার কারণে ১১০ ফুটের কম প্রশস্ত জাহাজই কেবলমাত্র প্রবেশ করতে পারে এই খাল দিয়ে। তবে ১১০ ফুট প্রস্থবিশিষ্ট বা তার বেশি প্রস্থবিশিষ্ট জাহাজ খুব কমই রয়েছে।
পানামা খাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব-পশ্চিম উপকূলে জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে আট হাজার কিলোমিটার পথ কমিয়ে দিয়েছে। একইভাবে উত্তর আমেরিকার উপকূল থেকে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে যাওয়ার ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার পথ কমিয়ে দিয়েছে। এই খাল দিয়ে বছরে প্রায় ছয় হাজার জাহাজ চলাচল করে এবং দৈনিক গড়ে ৫০ থেকে ৬০টি জাহাজ চলাচল করে।
পানামা খালের মাধ্যমে ট্র্যাফিক বিশ্ব বাণিজ্যের একটি ব্যারোমিটার, যা বিশ্ব অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সময়ে বাড়ছে এবং মন্দার সময়ে হ্রাস পাচ্ছে। ১৯১৬ সালে সর্বনিম্ন ৮০৭টি ট্রানজিট থেকে, ১৯৭০ সালে ১৫৫৬৩টি ট্রানজিটের উচ্চ বিন্দুতে ট্র্যাফিক বেড়েছে। সেই বছর খাল দিয়ে মালবাহী পণ্যের পরিমাণ ছিল ১৩২.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন (১৩৪.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন)। যদিও তখন থেকে বার্ষিক ট্রানজিটের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে, খালটি আগের চেয়ে বেশি মাল পরিবহন করে কারণ জাহাজের গড় আকার বেড়েছে। ২০১৩ সালে খালের মধ্য দিয়ে প্রায় ২১০ মিলিয়ন মেট্রিক টন (২১৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন) কার্গো ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল এবং পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য আন্তর্জাতিক খাল ট্র্যাফিককে প্রাধান্য দেয়। খালের মধ্য দিয়ে বহন করা প্রধান পণ্য গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে মোটর গাড়ি, পেট্রোলিয়াম পণ্য, শস্য, এবং কয়লা এবং কোক।
Featured Image: britannica.com References: 01. Panama Canal. 02. 7 Fascinating Facts About The Panama Canal.