ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড-এক অঞ্চল এক পথ

356
0
Obor China Vector Illustration. One Belt One Road Initiative Design

২০২৩ সালে এসে ‘One Belt One Road’ বা ‘এক অঞ্চল এক পথ’ উদ্যোগ তার দশ বছর পূর্তি উদযাপন করতে যাচ্ছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের এই উদ্যোগের সুবিধার্থে জন্য নির্মাণ করা হয়েছে রাস্তা, বন্দর, ব্রিজসহ বিভিন্ন অবকাঠামো।

কিন্তু দশ বছর পূর্তির পেছনে ফিরে তাকালে একটা লাখ টাকার প্রশ্ন উদয় হয়, বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলারের এই প্রজেক্ট কী তাহলে সফল হয়েছে?

Image source: stock.adobe.com

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রজেক্ট কী?

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড হচ্ছে ২০১৩ সালে চীন সরকারের নেওয়া একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আসিয়ান ও মিডল ইস্টের দেশগুলোতে সফর করার পর যৌথভাবে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রজেক্ট শুরু করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

এই প্রজেক্টের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, চীনের ঐতিহাসিক সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করে চীনের সাথে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক সংযোগ ঘটানো।

এই প্রজেক্টে চীনের ২০০০ বছরের পুরোনো প্রাচীন সিল্ক রুটের মাধ্যমে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার সাথে স্থলভাগ এবং সমুদ্রের মাধ্যমে সাউথইস্ট এবং সাউথ এশিয়ার সাথে যুক্ত করা হয়। এর লক্ষ্য ছিল চীন সিল্ক রুটের ছয়টি পথ দিয়ে সারাবিশ্বের সাথে যুক্ত থাকবে:

  • দ্য ইউরোশিয়ান ল্যান্ড ব্রিজ, যেটা পশ্চিম চীনের সাথে পশ্চিম রাশিয়াকে যুক্ত করবে।
  • চায়না-মঙ্গোলিয়া-রাশিয়া করিডোর। যেটা উত্তর চীনের সাথে মঙ্গোলিয়া হয়ে পূর্ব রাশিয়ার সাথে যুক্ত করবে।
  • চায়না-সেন্ট্রাল এশিয়া করিডোর এর মাধ্যমে চীন তুরস্কের মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়ার সাথে যুক্ত হবে।
  • চায়না-ইন্দোনেশিয়া করিডোর। এর মাধ্যমে দক্ষিণ চীন ইন্দো-চীন হয়ে সিঙ্গাপুরের সাথে যুক্ত হবে।
  • চায়না-পাকিস্তান করিডোর। এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিম চীন পাকিস্তানের সাথে যুক্ত থাকবে।
  • বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মায়ানমার করিডোর। এর মাধ্যমে দক্ষিণ চীন, ভারত ও বাংলাদেশ হয়ে মায়ানমারের সাথে যুক্ত হবে।
২০০০ বছর আগের ঐতিহাসিক সিল্করুট। Image source: ghoghnos.net

কেন এমন প্রজেক্টের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল?

২০১১-১২ সাল চীনের জন্য অর্থনৈতিক ও কুটনৈতিক দিক দিয়ে বেশ বাজে সময় যাচ্ছিল। এমনকি তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথেও সম্পর্ক খুব বাজে ছিল চীনের। দক্ষিণ চীনা ও পূর্ব চীনা সাগরের সামরিক সংঘাতও এর জন্য দায়ী।

এসব মন্দা কাটাতে ও বহির্বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক তৈরী করতে চীন সরকার এক অঞ্চল এক পথ এর উদ্যোগ নেয়। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করে, মার্কিন প্রভাব ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক অঞ্চল এক পথ একটি চাল।

সফলতা ও ব্যর্থতা

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগের মূল লক্ষ্যগুলো হচ্ছে-

  • নীতির সমন্বয়।
  • সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অবকাঠামোগত সংযোগ।
  • বাণিজ্যিক সহায়তা।
  • অর্থনৈতিক সহযোগিতা।
  • দেশগুলোর মানুষদের মধ্যে সংযোগ।

পরিসংখ্যানগত দিক দিয়ে দেখলে, এক অঞ্চল এক পথ একটি সফল প্রজেক্টই। ২০১২ সালে যেখানে চীনের বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ৮২ বিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০২০ সালে এসে চীনের বিদেশী বিনিয়োগ ঠেকেছে প্রায় ১৫৪ বিলিয়ন ডলারে। যা কিনা চীনকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোতে চীনের ইনভেস্টমেন্ট বৃদ্ধির হারও লক্ষ্যণীয়।

২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চায়নার ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের গ্রাফ। Image Source: statista.com

অবকাঠামোগত উন্নয়নে চোখ থাকায় উক্ত প্রজেক্টের ফলে দারুণ অবকাঠামোগত প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে সহযোগী দেশ ও সিল্ক রুটের দেশগুলোতে। প্রজেক্টের স্বার্থে সহযোগী দেশগুলোতে ব্রিজ, হাইওয়ে, পোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজনীয় কাজের জন্য বিপুল পরিমাণে লোকবলের প্রয়োজন হয়, যার ফলে সহযোগী অনেক দেশের মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টিও হয়েছে। বেকারত্ব ঘোঁচাতেও অবদান রেখেছে এই উদ্যোগ।

২০১৩ সালে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড এর যাত্রা শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চীন অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশের মানোন্নয়নের ক্ষেত্রেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে এই উদ্যোগে। বিশ্লেষকরা ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রজেক্টে এনার্জি সেভিংসের শক্ত প্রমাণ পেয়েছে। এই প্রজেক্টে এনার্জি সেভিং এর হার ৩৪.৫%, যেখানে কার্বন নিঃসরণের হার ৩৬.৪%।

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রজেক্টে শুরু হওয়ার পর থেকে সারা বিশ্বের ৩৯% ভূমি, ৩১% জিডিপি, ৬২% জনসংখ্যা এর আওতায় এসেছে। এসব দেশগুলো শুধু বিশাল পরিমাণে জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনই নয় সেই সাথে মিডিয়াম বা একেবারে কম এনার্জি খরচের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই প্রজেক্ট কম এনার্জি খরচের মাধ্যমে অধিক জিডিপি অর্জনে প্রাধান্য দেয়।

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগে ব্যবহৃত নতুন সিল্ক রুট। Image source: thelancet.com

তবে এই উদ্যোগের সফল সফল দিক থাকলেও পাশাপাশি এর ব্যর্থতাও আছে। এর অনেক প্রজেক্ট অলাভজনক, অনুপযুক্ত, অদূরদর্শি। ‘দ্য ইকোনমিকস’ পত্রিকার তথ্যমতে, পাকিস্তানে ৮০%, মায়ানমারে ৫০%, মধ্যপ্রাচ্যে ৩০% প্রজেক্ট ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। এর অনেক প্রজেক্টই কোনো পরিকল্পনা ছাড়া, ভবিষ্যতের সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, কিরগিজস্তানে চাইনিজ এসইও (SOE) এর নির্মিত বিশাল তেল পরিশোধনাগার এখনো ৬% ক্যাপাসিটি নিয়েই চলছে। অনুন্নত দেশগুলোতে নির্মিত তাদের এরকম অনেক প্রজেক্ট কাঁচামালের অভাবে অকার্যকর বা নিম্ন পরিসরে কার্যকর হয়ে পড়ে আছে।

ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড উদ্যোগের আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে, দুর্নীতি। ইতোমধ্যেই মালয়েশিয়া ও কিরগিজস্তানে বিভিন্ন প্রজেক্টে বিপুল পরিমাণে অর্থ আত্মসাৎের কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছে। অনেক প্রজেক্টে চাইনিজ কর্মকর্তারা নিজেদের সুবিধার্থে সর্বোচ্চ সুযোগ নেয়।

চীনের সুপ্রিম পিপলস প্রকিউরেটর দ্বারা পরিচালিত এক ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, বিভিন্ন প্রকল্পের সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে শুরু করে পরীক্ষা, অনুমোদন, জমি অধিগ্রহণ সহ সব ধাপে পর্যাপ্ত পরিমাণে দুর্নীতি হয়।

নতুন সিল্ক রোডের মানচিত্র। Image Source: monthlyreview.com

সিল্ক রুটের দুর্নীতি ও সমস্যাগুলো যদি কমিয়ে আনা যায়, তাহলে এটি অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হবে। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক বা সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই উদ্যোগের বেশ ভূমিকা। স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে দেখলে, এই উদ্যোগ বেকারত্ব হ্রাস করছে, অনুন্নত-উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগের হার বাড়াচ্ছে, টার্গেট ইকোনমিক অঞ্চলে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাচ্ছে।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে দেখলে এটি সিল্ক রুটের অবকাঠামো উন্নয়ন করছে যা স্থল বাণিজ্য সহজ করছে, বাণিজ্য খরচ হ্রাস করেছে, সহজে ছোট অর্থনীতির দেশের ক্লাইন্টের সাথে বড় অর্থনীতির দেশের ক্লাইন্টের যোগাযোগ করতে পারছে, জ্বালানি খরচ কমিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রাখছে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য স্থানীয় বা অঞ্চল ভিত্তিক উদ্যোক্তারাও বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে।

তবে এর ভবিষ্যত সফলতা নির্ভর করবে কিভাবে এবং কতটা স্বচ্ছভাবে এর প্রজেক্টগুলো সম্পাদন হয় এবং রাজনৈতিক সমস্যাগুলোতে কতটা ভালো উপায়ে পাশ কাটাতে পারে তার উপর। যথাযথ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক সহাবস্থানের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতিতে বেশ শক্ত ভূমিকা রাখতে পারবে এই উদ্যোগ। আর যদি সেটা না হয়, তবে এই উদ্যোগ হয়তো একটা ‘শ্বেতহস্তী’তে পরিণত হবে।

 

 

Feature Image: vectorstock.com 
References: 

1. Ten Years of The Belt and Road Reflections and Recent Trends.  
2. One Belt One Road. 
3. How does the one belt one road initiative affect the green economic growth?
4. China Faces Resistance to A Cherished Theme of its Foreign Policy. 
5. The Domestic Consequences of Chinas One Belt One Road Initiative.