আমরা ইংরেজি নববর্ষ পালন করি যেমন সেভাবেই বাংলা নববর্ষও পালন করি। এছাড়াও স্ব স্ব ধর্ম অনুসারে, জাতি অনুসারেও কয়েক ধরনের নববর্ষ পালিত হয়। যেমন- ইসলামি নববর্ষ কিংবা চাকমা উপজাতিদের নিজস্ব নববর্ষ। অনেক নববর্ষ সম্পর্কে আমরা যেমন জানি, অনেক জাতি-ধর্ম আর তাদের উৎসবও আমাদের অজানা।
ভারতে প্রতি রাজ্যে রয়েছে নানা ধরনের উৎসব। নানা জাতির, নানা বর্ণের আর নানা রঙের এবং নানা উপলক্ষে পালিত হয় সেই উৎসব। আজকের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় দক্ষিন ভারতীয় এক রাজ্যের নববর্ষ সম্পর্কে। কেরালা, ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় রাজ্য এবং এদের নববর্ষ ওনাম উৎসব আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু।
কেরালা
৩৮,৮৬৩ বর্গকিলোমিটারের এই রাজ্য ১লা নভেম্বর ১৯৫৬ সালে সংগঠিত হয়। এখানে বসবাসকারী জাতিতে মালয়লাম জাতি বলা হয়। তাদের ভাষায় একে কেরালাম-ই বলা হয়, কিন্তু অন্য ভাষায় কেরালা নামে ডাকা হয়। মালয়লাম বর্ষপঞ্জী অনুসারে, বছরের এই সময়ে অর্থাৎ, আগস্ট বা সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ধান কাটবার উৎসব পালিত হয়। এটাকেই ওনাম উৎসব বলে।
ওনাম উৎসব
পুরাণ মতে, অসুর রাজ মহাবলী একসময় কেরালা শাসন করতেন। তার দক্ষতা-বুদ্ধিমত্তা আর বিচক্ষণতা সর্বজনবিদীত ছিল। তার শাসনামলকে স্বর্ণযুগ বলা হয়। ধনী-দরিদ্রের অধিকার যেমন সমান ছিল, তেমনই কোন অপরাধ-অন্যায় হতে তার শাসনকালে কেউ দেখেনি। দুর্নীতি ছিল শুণ্যের কোঠায়।
তার জনপ্রিয়তা তুমুল ছিল, আর এই জনপ্রিয়তা একসময় তার কাল হয়ে দাঁড়ায়। অসুর রাজার জনপ্রিয়তা আসমান-জমিন-পাতালে ছেয়ে যায়। অসুর জাতির কারো জনপ্রিয়তা দেবদেবীর চাইতে বেশি হয়ে যাবে, তা কেউ মেনে নিতে পারেনি।
বামুন রূপে এসে হাজির হোন তিনি। যেহেতু মহাবলী কাউকে খালি হাতে ফেরাতেন না, তাই বিষ্ণুর এই বামুন অবতারকেও ফেরাননি। বিষ্ণুর আবদার ছিল, সে তিন পা ফেলে যতটুকু জমি দখল করতে পারবে, ততটুকুই তাকে দিতে হবে। অসুররাজ রাজী হলে, বিষ্ণু তার এক পা আসমান আর এক পা জমিনে ফেলেন।
মহাবলী বুঝে যান ইনি সাধারন কেউ নয়, সে তার তৃতীয় পদক্ষেপ ফেললে জমিন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তাই নিজের মাথা পেতে দেন, হাত জোড় করে। তৃতীয় বারের মতো পা ফেলে মহাবলীকে পাতালে ঠেলে দেন বামুন। এরপর অসুরের অনুরোধে স্বরূপে ফিরে আসেন এবং বর প্রদান করেন।
বরস্বরূপ মহাবলী চিরঞ্জিব হবেন এবং প্রতি বছর একবারের জন্য তিনি নিজ রাজ্য পরিদর্শন করতে পারবেন। আর বছরের এইসময় অর্থাৎ, চিঙ্গম (Chingam) মাসে, ফসল কাটার সময় তিনি পৃথিবীতে ফিরে আসেন। তার আগমন উপলক্ষেই এই বিশাল আয়োজন এবং কেরালাবাসীর প্রধান উৎসব ঘটা করে পালন করা হয়।
কুলাসেখারা পেরুমলের শাসনামলে, আনুমানিক ৮০০ ক্রিস্টাব্দে এই উৎসবের সূচনা হয়। প্রায় ২০০০ বছর আগে, তামিলনাডুতে এই উৎসবের সূচনা হয়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এটি কেরালার প্রধান উৎসব হয়ে ওঠে।
ওনাম উৎসব পালন
১৯৬১ সালে, কেরালার জাতীয় উৎসব হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য! সে বছর ভারত-চীনের যুদ্ধের কারণে এই উৎসব পালন সম্ভব হয়নি। থ্রিক্কারা নামের এক মন্দিরকে ঘিরেই মূলত এই ওনাম উৎসব উদযাপিত হয়। এটি কচি থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানেই ছিল মহাবলী রাজার রাজধানী।
থিরু ওনাম এর দিন দশেক আগে উৎসবের শুরু হয়। যেমন এবারের উৎসব শুরু হবে ২০ আগস্ট থেকে আর শেষ হবে ৩১ আগস্ট। থিরুভোনাম অনুষ্ঠানিত হবে ২৯ আগস্ট, ২০২৩। কেরালায় বাস করে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টানসহ নানান সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রত্যেক ধর্মের মানুষই এই আনন্দ উৎসবে উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে অংশগ্রহণ করে।
উৎসবের দশ দিনের নাম হলো- আথাম, চিথিরা, চোধি, ভিক্সাম, আনিঝাম, থ্রিকেটা, মোলাম, পুরাদাম, উথ্রাদাম এবং থিরুভোনাম। এই দশ দিনের মধ্যে প্রথম, নবম আর দশম দিন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ। কোন কোন এলাকায় এই উৎসব ছয় দিনে হয়। শোনা যায় একসময় পুরো মাসব্যাপী এই উৎসব অনুষ্ঠিত হতো।
এই ওনাম উৎসবের অন্যতম একটা রিচুয়াল হলো ফুল দিয়ে ঘরের সামনে সাজানো। ওনাম পোক্কালাম নামে এই ফুলের সাজানো আল্পনাতে থাকে দশ চক্র। এই দশ চক্র, দশ দিনের প্রতিরূপ। এই উৎসবের সময় নারীরা সাদা শাড়ি পরেন, তাতে থাকে সোনালি পাড়। পুরুষেরা জামা-কুর্তার সাথে পরেন ঘিয়ে রঙ্গা লুঙ্গি বা ধুতি।
অনামসাধ্যা হলো এই দশদিনের মধ্যে আয়োজিত খাবারের আয়োজন বা উৎসব। প্রায় ২৫ থেকে ২৬ রকমের খাবারের আয়োজন করা হয়। কলাপাতায় সাজানো থাকে এসব খাবার। এটা মূলত উৎসবের শেষ দিনে আয়োজন করা হয়।
খাবারের মধ্যে থাকে পাবাক্কা, উল্লিকিটচাদি, কিটচাদি, থোরান, পায়াসাম নামের মিষ্টি, থোরান, পাপড়, ভাত, ডাল, আচারসহ আরো অনেক কিছু। এই সময়ে কেরালায় নৌকাবাইচ উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এটা আরানমুলা পার্থসারথী মন্দিরের পাশে এই আয়োজন করা হয়।
এরপর যে আয়োজন নিয়ে কথা বলন, না হলো পুলিকালি। ভারতীয় অন্যান্য উৎসবের মতো এই উৎসবে নাচ-গানের আসর বসে। একে কাদুভাকালিও বলা হয়। বাজনার তালে তালে রাস্তায় নেমে আসে নাচিয়ের দল। দশ দিনের চতুর্থ দিনে, অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের শিকার এবং বাঘের সজ্জায় সজ্জিত করে।
লাল-হলুদ-কালো রঙে পুরো এলাকা ছেয়ে যায়। পুরুষেরা থাকিল-উদুক্কু গানের সুরে, বাঘ ধরার থিমে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে। কেরালার থ্রিসুর জেলায় এই আয়োজন করা হয় মূলত। ছোট্ট এই শহরে, এই নাচ এনং ওনাম উৎসব দেখতে আসেন বহু পর্যটক।
নারীরাও কাইকোত্তিকালি বা থাম্বি থুল্লাল জাতীয় নাচে অংশগ্রহন করে, পরনে থাকে সোনালি পাড়ের মুন্ডু আর নেরিয়াথু। অনেকে আবার উঁচু দাল থেকে ঝোলা দোলনায় চেপে অনাপ্পাআত্থু অর্থাৎ, ওনামের গান গায়।
থ্রিক্কাকারা মন্দিরে এই দশ দিন ধরে প্রতিদিন কথাকলি নৃত্য, থিরুভাথিরা, ছাক্যার কথু, অত্থাম থুল্লাল, পাতাকামসহ নানা আয়োজন চলতেই থাকে। এছাড়াও, বাজি ফুটিয়েও এই উৎসবে আরো আনন্দ যোগ করে কেরালাবাসী।
প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ এই উৎসব দেখতে কেরালায় আসে। এই উৎসবের আথাছামায়াম শোভাযাত্রা যেন জন-মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। ধীরে ধীরে কেরালার সব জেলায় ওনাম উৎসব বিপুল উৎসাহের সাথে পালন করে। এমনকি কেরালা সরকার এই উৎসবের জন্য আলাদা করে বাজেট বরাদ্দ রাখে।
নানা ভাষা-জাতি-ধর্ম-বর্ণের দেশ ভারত। এখানে এলাকা ভেদে তাদের দেবদেবীকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয় উৎসব। দুর্গাপূজা-লক্ষীপূজা-গণেশপুজা কিংবা দিপাবলী। প্রত্যেক দেবদেবীর জন্য আছে আলাদা আয়োজন।
আশ্চর্য হলেও অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, এই কেরালার উৎসব একজন অসুরকে ঘিরে। দেবতা-অসুরের যুদ্ধের বদলে, বিষ্ণুদেব অসুরকে চিরঞ্জীব হবার আশীর্বাদ করেন, আর বছরে একবারের জন্য নিজের রাজ্য ঘুরে দেখতে পারেন।
ওনাম উৎসব ঘিরে এতো আয়োজন, আবার এটিকে ফসলের উৎসব বলা হয়। মাঠে পরিপূর্ণ রঙ্গিন ফসল কৃষকের মুখে হাঁসি ফোটায়, বাতাসে আনন্দের দোলা দিয়ে যায়। সারা বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম ডানা মেলতে শুরু করে এই সময়ে। রঙ-বর্ণ-গন্ধের মিশেল এই ওনাম উৎসব। ছেলে থেকে বুড়ো, সকল ধর্ম-সকল বর্ণের মানুষ এক কাতারে এসে নামে এই উৎসব পালন করতে।
তারা একদিকে যেমন নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দে ভাসে, তেমনই স্মরণ করে তাদের সর্বকালের সেরা রাজা মহাবলীকে। এত বনাঢ্য উৎসব খুব কমই চোখে পড়ে। ভারতের অন্যতম উৎসব আজকাল বিদেশী পর্যটকদেরও আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
Feature Image: southtourism.in References: 01. Onam Festival. 02. Onam Festival. 03. Onam Festival. 04. All you need to know about the harvest festival. 05. Ten Days of Onam. 06. Onam History. 07. Who-celebrated-onam-first? 08. Onam Celebrations.