১৯৪৩ সালের ১৩ই অক্টোবর। চারদিকে যুদ্ধের দামদামাতে ভরপুর। ফ্রান্স মিত্রশক্তিতে থাকলে ও জার্মানরা ফ্রান্সের অনেক এলাকা দখল করে নিয়েছে। তেমন এক দখলকৃত স্থান প্যারিস, ৮৪ এভিনিউ, ফচে্ এস ডি সদরদপ্তর।
তখন প্রায় রাত দুটো। জার্মান পুলিশ গেস্টাপোর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। চারপাশে এলার্ম বাজছে অর্থাৎ গভীর রাতে কোনো কয়েদী সেল ভেঙে পালিয়েছে। বেশ খোঁজাখুঁজির পরে কয়েদীরা ধরা পড়ল। তিনজন ব্রিটিশ গুপ্তচর। দু’জন পুরুষের পাশাপাশি অপর কয়েদীটি ছিল অসম্ভব সুন্দর এক ব্রিটিশ নারী গুপ্তচর!
২৫শে নভেম্বর আবারও রাতের বেলা এলার্ম বেজে উঠল। জার্মান পুলিশ হস্তনস্ত হয়ে আবার দৌড়ঝাপ শেষে কয়েদীকে ধরে দেখে আবারো সেই ব্রিটিশ নারী গুপ্তচর। এতো আচ্ছা ঝামেলা! এবার জার্মান গেস্টাপো নড়েচড়ে উঠে। পুনরায় পালানোর চেষ্টা না করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে চুক্তিপত্রে সই করাতে চাইলো সেই নারী গুপ্তচরকে। কিন্তু তিনি সই করতে অস্বীকৃতি জানালেন আর নিজের বিশ্বাসে অটল রইলেন।
উপায় না দেখে ২৭ নভেম্বর সঙ্গোপনে এই ব্রিটিশ নারী গুপ্তচরকে জার্মানিতে ডাশাউ কনসেনট্রেশন্স ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হল। একা একটি সেলে তাকে বেধে রাখা হয়। রাতের অন্ধকারে শৃঙ্খলবন্দি হয়ে চিৎকার করে কাঁদতেন এই নারী। প্রচুর অত্যাচারের পরেও তার মুখ থেকে একটা শব্দও বের করতে পারেনি জার্মানবাহিনী। শেষে জার্মানীর কুখ্যাত ফর্টস্হাইমের একটি সেলে হাতে-পায়ে শেকল দিয়ে দশমাস বন্দী করে রাখে অত্যন্ত বিপজ্জনক এই গুপ্তচরকে!
১৯৪৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ডাশাউ কনসেনট্রেশন্স ক্যাম্পে গেস্টাপো (জার্মান পুলিশ বাহিনী) গুলি করে হত্যা করে তাকে। মৃত্যুর আগে তাঁর বলা শেষ কথা ছিল লিবের্তে অর্থাৎ স্বাধীনতা! তাঁর নাম নূর ইনায়েত খান! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম মুসলিম নারী গুপ্তচর।
নূর ইনায়েত খানের জন্ম মস্কোতে। তাঁর বাবা ছিলেন ভারতীয়, মা মার্কিন নাগরিক। একবার আমেরিকায় সফরকালে নূরের বাবা ইনায়েত খানের সাথে আলাপ হয়েছিল মা ওরা রে বেকারের। পরে দু’জনে বিয়ে করেন। ওরা-র নতুন পরিচয় হয় পিরানি আমিনা বেগম। লন্ডন এবং প্যারিসে কিছু দিন থাকার পরে তাঁরা পৌঁছায় মস্কো শহরে।
১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে মস্কোতেই জন্ম নেয় তাঁদের প্রথম সন্তান, নূর। পরে আমিনার কোলে এসেছিল আরও তিন সন্তান। দুই ছেলে বিলায়ৎ, হিদায়ৎ এবং মেয়ে খায়র-উন-নিসা।
নূরের বাবা এসেছিলেন এক ভারতীয় রাজ পরিবার থেকে। পুরো নাম ইনায়াত রেহ্মাত খান। তিনি ছিলেন উত্তর ভারতের স্বনামধন্য এক ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পী।
তিনি হায়দারাবাদের নিজামের কাছ থেকে ‘তানসেন’ উপাধি ও লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং নূরের জন্মের বছরেই সপরিবারে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমায়। যেখানে গিয়ে ইনায়েত খান এক সুফি সংঘও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
ইনায়াত রেহ্মাত খানের মা খাতিজাবি ছিলেন ভারতের বিটোফেন খ্যাত ওস্তাদ মাওলা বক্স খানের কন্যা। আবার মাওলা বক্সের স্ত্রী অর্থাৎ ইনায়েতের দিদিমা কাসিম বিবি ছিলেন ইতিহাসের বিখ্যাত বীর যোদ্ধা মহিশূরের শাসনকর্তা টিপু সুলতানের নাতনী। কাজেই মহীয়সী এই নারী গুপ্তচর নূর ইনায়াত খান যে রক্তের প্রবাহে বিপ্লবের চেতনা পেয়েছিল, তা বলাবাহুল্য।
নুর ইনায়েত খানের বয়স যখন মাত্র তের, তখন তার বাবা ইনায়েত খান মারা যান। এরপর নিজের মা এবং অন্য ভাইবোনদের সাহায্য করতে তাকে দায়িত্ব নিতে হয়।
সঙ্গীতে তার ভীষণ আগ্রহ ছিল। নূর কবিতা লিখতে ভালবাসত আর সেই সঙ্গে জড়িত ছিল শিশুদের জন্য লেখালেখিতে। এসব লেখা প্রকাশিত হয়েছিল ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনে। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বই ‘টোয়েন্টি জাতকা টেলস’। বৌদ্ধধর্মের জাতককাহিনী অনুসরণে লেখা বইটি প্রকাশিত হয়েছিল লন্ডনেই। পাশাপাশি, তিনি পিয়োনা ও হার্পবাদনেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত।
জার্মানি যখন ফ্রান্স দখল করে নেয় তখন নুর এবং তার পরিবার ইংল্যান্ডে পালিয়ে আসেন। ১৯৪০ সালের নভেম্বরে তিনি যোগ দেন উইমেন্স অক্সিলারি এয়ারফোর্সে (ডাব্লিউএএএফ)। সেখানে ওয়্যারলেস অপারেটর হিসেবে ছয় মাস প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এক বছর পরে নূর গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত উইনস্টন চার্চিল বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন মহিলাদের গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করার ক্ষেত্রে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়াতে ব্রিটেনেও তার জন্য সহজ ছিলনা। উল্লেখ্য, ভারতে তখন ব্রিটিশদের থেকে মুক্তি পেতে স্বাধীনতা সংগ্রামও চলছিল। নূরকে ইন্টারভিউ বোর্ডে সরাসরিই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ভারতীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে।
কিন্তু নূর বাইরে যেমন অভাবনীয় সৌন্দর্যে ভরা ছিল, ভেতরে ঠিক ততটাই ইস্পাতের মত দৃঢ়। বাবার কাছ থেকে পাওয়া সব সময় সত্য বলার শিক্ষা তার ভেতরে এমন শক্তির সঞ্চার করেছিল যে তিনি অকপটেই স্বীকার করে নেন, এখন হয়তো তাকে ব্রিটিশদের হয়েই লড়তে হচ্ছে; তবে যুদ্ধ শেষ হলে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্যই লড়বেন। তার এই সততা তাকে ঠিকই পুরস্কৃত করেছিল।
১৯৪২ সালের ১০ নভেম্বর এসওই থেকে আবার ডাক আসে নূরের। আরেকটি ইন্টারভিউ নিয়ে সেদিনই তাকে এসওই-তে যোগ দিতে বলা হয়। কর্মক্ষেত্রে নিজের পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তার ছাপ রেখে নূর অল্প কিছুদিনের মাঝেই নিজের মেধাকে তুলে ধরেন। নূরের সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্বে কর্মক্ষেত্রের অনেকে তার প্রতি পোষণ করত তীব্র আকর্ষণ!
ফরাসি ভাষায় সহজাত এবং ব্যক্তিত্বে সপ্রতিভ নূরকে পাঠানো হয় নাৎসি অধিকৃত ফ্রান্সে। রেডিয়ো অপারেটর হিসেবে কাজ করার জন্য। তিনি প্রথম মহিলা রেডিয়ো অপারেটর যাঁকে আন্ডাকভার এজেন্ট হিসেবে ফ্রান্সে পাঠানো হয়েছিল। প্রথমে মনে করা হয়েছিল তিনি দেড় মাসের বেশি কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু সকল আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে নূর তিন মাস কাজ করেছিলেন। অক্ষশক্তির অবস্থান, পরবর্তী পদক্ষেপ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংক্রান্ত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এইসময়ে তিনি ফ্রান্স থেকে ব্রিটেনে পাঠাতেন।
পরিবারকে ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে নূরের কাছে সব থেকে কঠিন কাজ ছিল তাঁর মাকে জানানো। মাকে নূর জানায় আফ্রিকা যাচ্ছে। পাশাপাশি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে তাঁর অবস্থান ও কাজ যেন মাকে কোনওভাবেই জানানো না হয়। একমাত্র তাঁর মৃত্যুর পরই মাকে খবর দেওয়া হয়।
ফ্রান্সে থাকার সময় নূর বাচ্চাদের নার্স হিসেবে ছদ্মপরিচয়ে থাকত । তাঁর ছদ্মনাম ছিল ‘জেন মারি রেইনিয়ের’। তাঁর পা রাখার দিন দশেকের মধ্যে ফ্রান্সে কর্মরত ব্রিটেনের প্রায় সব গুপ্তচর ধরা পড়ে যায়। শত্রুপক্ষের মধ্যে তিনি অত্যন্ত বিপদগ্রস্ত জেনেও নূর ফ্রান্স ছেড়ে ব্রিটেনে পালাতে চাননি। অন্য গুপ্তচর বা স্পেশাল অপারেশনস এগজিকিউটিভদের কাছে তাঁর কোড নাম ছিল ‘মাদেলেইন’।
তিন মাস ধরে অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে কাজ করার পরে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন নূর। তাঁর কথা গেস্টাপো বাহিনীকে জানিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে দু’জনের নাম শোনা যায়। সেই নাম দু’টি হল অঁরি দেরিকোর এবং রেনে গ্যারি। মনে করা হয়, এই দুই এজেন্টের মধ্যে অন্তত একজন নূরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন।
এজেন্ট অঁরি-র সাঙ্কেতিক নাম ছিল গিলবার্ট। ফরাসি বিমানবাহিনীর প্রাক্তন এই পাইলট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়। অর্থাৎ অক্ষ এবং মিত্রশক্তি, দুই তরফেই তিনি ছিলেন গুপ্তচর। অন্যদিকে রেনে ছিলেন এমিল অঁরি গ্যারির বোন। কাজের সূত্রে নূর এবং এমিল পরিচিত ছিলেন। নূরকে মূলত এমিলের বাসা থেকেই আটক করে গেস্টাপো। পরে এমিলকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
ব্যক্তিগত জীবনে অসাধারণ মেধা আর সৌন্দর্যের জন্য নূরকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করতেন রেনে। আর এক এসওই এজেন্ট ফ্রাঁ অঁতেলমে-এর ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। কিন্তু নূরের কাজে ফ্রাঁ-এর মুগ্ধতা মেনে নিতে পারতেন না রেনে। অভিযোগ উঠে ৫০০ পাউন্ড অর্থের বিনিময়ে রেনে নূরের গোপনীয়তা ফাঁস করে দিয়েছিল। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পরাজয়ে পরে রেনেও বিচারের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
পরবর্তী সময়ে নূরের জীবনীকার আর্থার ম্যাগিডা সংবাদমাধ্যমে একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান। নূরকে গ্রেফতার করার পরে গেস্টাপো বাহিনী নিশ্চিত হতে চেয়েছিল তাঁর পরিচয় নিয়ে। নূরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিলাসবহুল শৌখিন দোকানে। বলা হয়েছিল, পছন্দসই জিনিস কিনতে। এখানে কিন্তু গেস্টাপোর ধূর্ত চোখকে ফাঁকি দিতে পারেননি নূর। তিনি যা যা পছন্দ করেছিলেন, সব ছিল নীল রঙের। এ বার নাৎসিদের সন্দেহ নিরসন হয়। কারণ তাঁরা জানতেন, নূরের প্রিয় রং নীল। নীল রঙের প্রতি দুর্বলতা শেষ অবধি তাঁকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
বাইরে জগতের কাছে নূর মাদেলেইন ছিলেন; আর মায়ের কাছে আদরের নোরা। মেয়ের মৃত্যুর পরে পাঁচ বছর ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে বেঁচে ছিলেন আমিনা বেগম। গুপ্তচর হলেও নূরের জীবন অনুচ্চারিত থাকেনি। ১৯৪৯ সালে তাঁকে মরণোত্তর ‘জর্জ ক্রস’-এ সম্মানিত করা হয়। ফ্রান্সের তরফে ভূষিত করা হয় ‘ক্রোয়া দ্য গ্যের’ সম্মানে।
২০১২ সালে তাঁর আবক্ষ মূর্তি স্থাপিত হয় লন্ডনে। ২০২০ সালের অগস্টে নূরকে সম্মানিত করা হয় ব্রিটেনের ‘ব্লু প্লেক’ সম্মানে। সেখানেও নীল; কারণ নীল রঙ ছিল ভীষণ পছন্দ। প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিসেবে তিনি এই সম্মান লাভ করেন।
নূরের জীবন বার বার বই এবং সিনেমার উপজীব্য হয়েছে। শ্রাবণী বসুর লেখা নূরের জীবনী ‘স্পাই প্রিন্সেস’ মুক্তি পেয়েছিল ২০০৬ সালে। তাঁর জীবন তুলে ধরা হয়েছে ‘এ কল টু স্পাই’ ছবিতে। নূরের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রাধিকা আপ্টে। তাকে নিয়ে তথ্যচিত্র রবার্ট এন্ড দ্য শ্যাডোস: ফ্রান্স, এনিমি অফ দ্য রেইচ: নূর ইনায়েত খান, উইশ মি লাক উল্লেখযোগ্য।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত, জন্মস্থল মস্কো, বেড়ে উঠা ফ্রান্সে আর পরিচয় ব্রিটেনে; আসলে কোন দেশকে মাতৃভূমি বলে মনে করতেন, নূর?
তাঁর বাবার সুফিবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বমানবতাই ছিল নূরের দেশ। ডাকাউ ক্যাম্পে নূরের শেষ উচ্চারিত শব্দ ছিল ‘লিবার্তে’। তুমুল সৌন্দর্যের অধিকারী টিপু সুলতানের এই উত্তরসূরি নূর ইনায়েত খান কার মুক্তি চেয়েছিলেন! সে উত্তর বিশ্বমানবতার মাঝেই নিহিত।
Feature Image: MensXP
References:
- Nur Inayat Khan: The forgotten muslim princess who fought Nazis
- Nur Inayat Khan: How British spy’s love for blue betrayed her
- Nur Inayat Khan (1914-1944)
- Nur Inayat Khan- SOE
- Musician, Author, Princesss, spy: Nur Inayat Khan
- নূর ইনায়াত খান মুসলিম শান্তিবাদী, ব্রিটিশ গুপ্তচর, জাতীয় বীর: By গ্যাবি হ্যালবাস্টার্ম, অনুবাদ: রওশন জামিল, প্রকাশনা: প্রথমা