নেদারল্যান্ডস কথাটির আক্ষরিক অর্থ নিম্নভূমি। সেক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, উত্তর ও পশ্চিমের নিম্ন ও সমতলভূমি, আর নদীসমূহের ব-দ্বীপ নিয়ে, দুই ভাগের ভূপ্রকৃতির মিশেলে গঠিত নেদারল্যান্ডস পৃথিবীর একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে অন্যতম।
নেদারল্যান্ডসের পূর্ব নাম হল্যান্ড, যদিও এটি নিউজিল্যান্ডের ঐতিহাসিক একটি অঙ্গরাজ্যের নাম। উত্তর আর পশ্চিমে উত্তর সাগর, পূর্বে জার্মানি এবং দক্ষিণে বেলজিয়াম অবস্থিত। ভৌগোলিকভাবে নেদারল্যান্ডস তার টিলা ও ডাইকের সুরক্ষা হারালে দেশটির অতি ঘনবসতি পূর্ণ অংশটির প্লাবিত হবার সম্ভাবনা আছে। দেশটির আয়তন ৪১ হাজার ৫৪৩ বর্গকিলোমিটার।
নেদারল্যান্ডসের রাজনৈতিক দিকের কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে বলতে হবে, নেদারল্যান্ডসের রাজনীতি, ১৯৪৮ সাল থেকে দেশটি সংসদীয় প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, এবং একটি বিকেন্দ্রীকৃত ঐক্যমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামোতে পরিচালিত।
দেশটির আইনসভা দু’কক্ষ বিশিষ্ট। এটি বিশ্বের ৩য় প্রাচীনতম সংসদীয় সরকারব্যবস্থা। নেদারল্যান্ডসের রাজা রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান। নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে দ্বিকাক্ষিক আইনসভা, মন্ত্রীসভা ও সর্বোচ্চ আদালত অবস্থিত।
নেদারল্যান্ডস ১২টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত। এদেরকে প্রভিয়েন্স বলা হয়। এই প্রত্যেকটি প্রভিয়েন্স একজন গভর্নর দ্বারা শাসিত, যাকে কমিশনার অব দ্য কুইন বা কমিস্যারিস ভ্যান দ্য কোনিগিন বলা হয়। শুধুমাত্র লিমবার্গ প্রভিয়েন্সের প্রধানকে গভর্নর বলা হয়।
নেদারল্যান্ডসের অর্থনীতি একটি মিশ্র ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত। যা বাজার ব্যবস্থার অর্থনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যার বেশিরভাগ হালকা ও ভারি শিল্প এবং বাণিজ্যের উপর ভিত্তি করে গঠিত। যুক্তরাষ্ট্রের পর কৃষি ও খাদ্য পণ্য রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে ২য় অবস্থানে আছে নেদারল্যান্ডস।
দেশটির পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এর জনসংখ্যার জীবনযাপনকে করেছে সমৃদ্ধশালী। রটারডাম বন্দরটি ইউরোপের মধ্যে যেমন বৃহত্তম বন্দর, তেমনি এশিয়ার বাহিরেও এটি বৃহত্তম। নেদারল্যান্ডসের মুদ্রার একক ইউরো। নেদারল্যান্ডস আজ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলির মধ্যে একটি।
দেশটির জনসংখ্যা এক কোটি ৭১ লাখ ৬৪ হাজার ৮০০। যদিও সামগ্রিকভাবে জনসংখ্যা দ্রুত ‘ধূসর’ হচ্ছে, অর্থাৎ ৬৫ বছরের বেশি বয়সের উচ্চ শতাংশসহ, আমস্টারডাম আন্তর্জাতিক যুব সংস্কৃতির জীবন্ত কেন্দ্রগুলির মধ্যে একটি হয়ে আছে। সেখানে, সম্ভবত দেশের অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে বেশি, সামাজিক সহনশীলতার ডাচ ঐতিহ্য সহজেই সম্মুখীন হয়।
পতিতাবৃত্তি, গাঁজা, স্বেচ্ছায় মৃত্যু, গর্ভপাত এবং ইথানেশিয়া সবই আইনি কিন্তু সাবধানতার সাথে নেদারল্যান্ডসে নিয়ন্ত্রিত।নেদারল্যান্ডসই প্রথম এক দেশ যেখানে সমকামী বিবাহ, ২০০১ সালে আইনসিদ্ধ হিসেবে গণ্য করে।
নেদারল্যান্ডস ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউরোজোন, জি১০, ন্যাটো, ওইসিডি, এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রাষ্ট্র গুলোর একটি। এছাড়া এটি শেনজেন এলাকা ও ত্রিপাক্ষিক বেনেলাক্স ইউনিয়নের অংশ।
দেশটিতে রাসায়নিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ সংস্থা, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অপরাধ অনুসরণ সংস্থা, জাতিসংঘ আটক ইউনিট অবস্থিত। ‘সীমান্তহীন সংবাদ প্রতিবেদক’ নামক সংস্থার প্রকাশিত সংবাদপত্র স্বাধীনতা সূচকে দেশটি বিশ্বে ২য় স্থান অধিকার করেছে।
নেদারল্যান্ডসের জনগণ তাদের সংস্কৃতিকে দুটি প্রধান উপবিভাগের মধ্যে পার্থক্য করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো রান্ডস্টেড এবং নন-রান্ডস্টেড সংস্কৃতির মধ্যে। রান্ডস্টেড সংস্কৃতি স্পষ্টভাবে শহুরে,আর নন-রান্ডস্টেড সংস্কৃতি প্রিন্টেস্ট্যান্ট উত্তর এবং ক্যাথলিক দক্ষিণে ঐতিহাসিক বিভক্তির সাথে মিলিত হয়, যা রাউন নদীর দ্বারা বিভক্ত।
ডাচদের সংস্কৃতির কিছু বৈচিত্র্যময়তা ফ্রিজিয়ান সংস্কৃতি, ব্র্যাবান্ট এবং লিম্বুর্গ সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। নেদারল্যান্ডস শত শত বছর ধরে বৈষম্য এবং নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে।
বিংশ শতাব্দীতে ভূমধ্যসাগর থেকে অতিথি শ্রমিকদের আগমন, পূর্ব ডাচ উপনিবেশ থেকে অভিবাসীরা এবং যুদ্ধবিমুখ দেশগুলির শরণার্থীদের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল। নেদারল্যান্ডস সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যতা, সহনশীলতা, এবং বৈদেশিক প্রভাব গ্রহনযোগ্যতা জোর দেয়।
নেদারল্যান্ডসের সরকারি ভাষা হলো স্ট্যান্ডার্ড ডাচ। এই ভাষাটি সরকারি বিষয়াদি, মিডিয়া, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যবহার হয়। এছাড়াও ডাচদের প্রায় ২৫টি উপভাষা আছে।
ডাচদের দুগ্ধজাত খাবার প্রচন্ড পছন্দের। তাদের এই দুগ্ধজাত খাবার কতটা প্রিয় সেটা আলকমা ও ওয়েরডান শহরে গেলে বুঝতে পারবে যে কেউই। এছাড়া সামুদ্রিক খাবার, মাংসও তাদের প্রিয় খাবার।
ডাচ বাসিন্দারা সাধারণত প্রাতঃরাশ ও মধ্যাহ্নভোজনে টোস্ট, চা, মিষ্টি ও কফি খেয়ে থাকে। ডাচ সুশি হিসেবে পরিচিত, হেরিং ডাচদের অন্যতম প্রধান খাবার। এছাড়া নাস্তায় বিভিন্ন ঠান্ডা ও গরম স্যান্ডউইচ, ক্যানাপস ইত্যাদি তাদের প্রচলিত খাবার।
ডাচরা খুবই মিষ্টান্নপ্রিয় জাতি। তাদের কিছু মিষ্টি জাতীয় খাবার খুবই লোভনীয় ও অদ্ভুত হয়ে থাকে। মোটাদাগে বলা যায়, ডাচদের খাদ্যাভ্যাস তেমন জটিল নয়। কিন্তু পুরোদস্তুর খাদ্যরসিক একটি জাতি হিসেবে, ডাচরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
নেদারল্যান্ডসের জাতীয় পতাকাটি লাল, সাদা এবং নীল রঙের তিনটি আনুভূমিক রেখাচিত্রে গঠিত। জাতীয় সংগীত হলো উইলহেলমাস, যা ১৯৩২ সালে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহন করা হয়েছিল। নেদারল্যান্ডসের জাতীয় ফুল টিউলিপ। জাতীয় পশু সিংহ।
খেলাধুলার বিষয়াদি নিয়ে বলতে গেলে, বলা যায়, নেদারল্যান্ডসের জাতীয় খেলা ফুটবল ও কেইবো। ফুটবলে নেদারল্যান্ডসের রেংকিং ১০। নেদারল্যান্ডসের ক্রিকেট ক্লাব নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়ার ক্লাবের চেয়েও পুরনো। ১৯৬৬ সাল থেকে দলটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল এর সহযোগী সদস্যভুক্ত দেশ।
নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম শহর প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক আকর্ষণ করে। এছাড়াও, ম্যাষ্ট্রিচটের আর্টগ্যালারি, স্কাইলাইট, সুন্দর গির্জা; রটারডামের সমৃদ্ধ উদ্ভিদ, প্রাণীজন্তুসহ পরাবাস্তব গন্তব্য; আইডহোভেনের আগ্নেয়গিরি, ঝরঝরে ঝর্ণা এবং সুন্দর উদ্যান; রিজক্সসিয়ামের বৃহৎ আর্ট মিউজিয়াম, মাদুরোদাম থিম পার্ক নেদারল্যান্ডস, ডেলফ্ট হল্যান্ড,যেখানে শৈল্পিকতার সম্ভার বিদ্যমান।
Feature Image: dutchreview.com References: 01. Netherlands. 02. Netherlands country profile. 03. Netherlands.