নেপিদো: মানুষের নাকি ভূতের জন্য নির্মিত শহর?

193
0

শহর বা রাজধানী বলতেই আমাদের চোখে ভাসে, একগাদা লোক, উঁচু উঁচু বিল্ডিং, ট্র‌্যাফিকের ক‌্যাকোফোনি, বিলাসিতার জন‌্য নিয়ন সাইনের কিছু রেস্টুরেন্ট। কিন্তু প্রায় জনমানবহীন রাজধানী কিন্তু সবার কাছে পরিচিত না। তবে একটা শহর যেটা প্রায় জনমানবহীন, মানুষজন মনে করে বোধ হয় এটা ভূতের শহর। শহরটির নাম নেপিদো। 

মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্র। প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে জনগণের ধারণা হয়তো খুব একটা বেশি নয়। তবে বাংলাদেশে মিয়ানমার নাম শুনতেই সকলে মনে করে রোহিঙ্গাদের আবাস্থল। কিন্তু এই প্রতিবেশী দেশের রাজধানী সম্পর্কে পৃথিবীর অনেকেই রাষ্ট্রই হয়তো জানে না। 

সাধারণ জ্ঞানে মিয়ানমারের রাজধানীর নাম ইয়াঙ্গুন জানলে তা পরবর্তীতে পরিবর্তন হয়ে নেপিদো শহরকে রাজধানী করা হয়। বলা হয়ে থাকে লন্ডনের থেকে বড় শহর হলেও এই শহরের জনসংখ‌্যা লন্ডনের সমান নয়। এই নেপিদো শহরকে মিয়ানমারের ভূতের রাজধানীও বলা হয়। 

উপ্পাতাসান্তি প‌্যাগোডা, নেপিদো। Image Source: wikipedia.org

বার্মা থেকে মিয়ানমার

নেপিদো সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই বার্মা-মিয়ানমার, রেঙ্গুন-ইয়াঙ্গুন সম্পর্কে সামান‌্য ধারণা রাখতে হবে। নেপিদো যেমন শুরুতে মিয়ানমারের রাজধানী ছিল না, তেমনই আজকের মিয়ানমারও একসময় মিয়ানমার ছিল না।  মিয়ানমারের পুরনো নাম ছিলে বার্মা। মিয়ানমারের সর্ববৃহৎ সম্প্রদায় ‘বামার’ থেকে বার্মা নামটি এসেছে। সাম্প্রদায়িকতা যে দেশটির রন্ধ্রে রন্ধে মিশে আছে তা এর নাম থেকেই বোঝা যায়।

এককালে একাধিক ছোটো ছোটো স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল বার্মা বা আজকের মিয়ানমার। রাজা অনরথ পাগান ১০৪৪ সালে রাষ্ট্রের সিংহাসনে বসেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলোকে তিনিই প্রথম একত্রিত করে একত্রিত রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। পাগান প্রদেশটিকে করা হয় তার রাজধানী।

বার্মার রাজা অনরথের রাজত্বকালকে তাই স্বর্ণকাল বলা চলে। বৌদ্ধধর্মে অতিমাত্রায় অনুরক্ত ছিলেন এই রাজা অনরথ পাগান। তাই তিনি শহরজুড়ে অনেক মন্দির ও প্যাগোডা নির্মাণ করেন। এছাড়া এই রাজত্বকে তিনি শিল্প, সংস্কৃতি ও শিক্ষায় অনেক সমৃদ্ধ করেন। তবে রাজতন্ত্রে রাজ্য বেশিদিন টিকিয়ে রাখাটাও একটা অনিশ্চিত ব্যাপার। ফলে পাগান রাজত্ব ভেঙ্গে পড়ে ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে।

রাজা অনরথ পাগান-এর ভাস্কর্য। Image Source: alchetron.com

পাগান সাম্রাজ্য একদিক থেকে ‘শন’ ও আরেকদিক থেকে ‘মঙ্গল’ জাতি দখল করে। একে একে ভেঙ্গে পুনরায় ছোট ছোট রাষ্ট্রে পরিণত চারটি অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে পড়ে-উচ্চ বার্মা, নিম্ন বার্মা, শন প্রদেশ ও আরাকান প্রদেশ। স্বাভাবিকভাবেই এসব প্রদেশের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকতো। রাজা থালুন ১৬৩৫ সালে বিশৃঙ্খল অঞ্চলগুলোর দখল নিয়ে দেশটিকে একক সীমারেখার ভেতর নিয়ে আসেন।

তবে বার্মায় তার অধীনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে। আর তা দীর্ঘদিন বিরাজ করে। তবে এরপরও যুদ্ধবিগ্রহ থেমে থাকেনি। অবশ্য পরবর্তী রাজবংশগুলো ক্ষমতার সাথে যুদ্ধেরও উত্তরাধিকারিতা লাভ করে। এর পরবর্তী সময়ে রাজা বোধপায়া যিনি ছিলেন কংবং রাজবংশের রাজা। তারপর তার নাতি অলংপায়া সফল শাসক হিসেবে বার্মার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হোন। 

রেঙ্গুন থেকে নেপিদো

বর্তমান মিয়ানমারের নাম ইউনিয়ন অব বার্মা থেকে ইউনিয়ন অব মিয়ানমারে পরিবর্তন করা হয় ১৯৮৯ সালে। অতীতে বার্মা রাজ্যের রাজধানী ছিল রেঙ্গুন। তখন দেশের রাজধানীর নাম পরিবর্তন করা হয়। দেশটির রাজধানীর নাম রেঙ্গুন থেকে হয়ে যায় ইয়াঙ্গুন।

নেপিদোর ম‌্যাপ। Image Source:nytimes.com

এর পরবর্তীতে শুধু নামে নয়, ভৌগোলিকভাবেও দেশটির রাজধানী পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমান মিয়ানমারের রাজধানী আবারও পরিবর্তন হয়। বর্তমান রাজধানীর নাম হলো নেপিদো। 

 

নতুন রাজধানী অত্যন্ত গোপনে গড়ে তোলা হয়েছে। নেপিদো শহরটি শূণ্য থেকে গড়ে তোলা হয়েছে। ২০০২ সাল থেকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার নতুন রাজধানী নির্মাণের কাজ শুরু করেন।

কিন্তু মিয়ানমারের নেতারা তাদের রাজধানী বাতিলের সিদ্ধান্ত জনগণকে আরও পরে জানায়। ২০০৫ সালে তখনো নতুন রাজধানীর নাম গোপন রাখা হয়। 

সেই ঘোষণার ৪ মাস পরে জানানো হয়, নতুন রাজধানীর নাম। সেই নতুন নামটি হলো নেপিদো যার অর্থ রাজাদের বাসভূমি। মিয়ানমার সরকার নেপিদোকে রাজধানীর মর্যাদা দেয় ২০০৬ সালের মার্চ মাসে। তবে ২০১২ সালে শহরটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়।

কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল নামের একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক বিভাগে নেপিদো শহরটির অবস্থান। মিয়ানমারের আধুনিক রাজধানী নেপিদো শহরের আয়তন প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। যা মূলত লন্ডন শহরের প্রায় চার গুণ বড়। নেপিদো শহরটি খুবই পরিকল্পিত একটি শহর এবং অত্যন্ত সাজানো-গোছানো।

মিয়ানমারেই প্রথম কিন্তু রাজধানী পরিবর্তনের বিষয়টি ঘটেনি। নানা কারণে অতীতেও নতুন শাসকের হাত ধরে বহু সাম্রাজ্যের রাজধানী পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের রাজধানী পরিবর্তনের আদৌ কোনো সঠিক কারণ জানা যায় না। অনেকেই মনে করেন পুরাতন রাজধানী ইয়াঙ্গুন সমুদ্রের কাছে অবস্থিত। সে কারণে সামরিক নেতারা সমুদ্রপথের রাজধানীতে হামলা হওয়ার আশঙ্কা করছিল। যদিও এর চেয়েও অনেক জোরালো কারণ এর সাবেক রাজধানীতে আছে। 

নেপিদোতে অবস্থিত জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্স। Image Source : nationsonline.org

রেঙ্গুনের তুলনায় নেপিদোতে সেভাবে কোনো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এখনও পর্যন্ত মিয়ানমারের জনগণ বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নেপিদোর পরিবর্তে রেঙ্গুনকেই বেছে নেয়। শুরুর দিকে নেপিদোতে বিলাসবহুল হোটেল, সরকারি ভবন, এ‌্যাপার্টমেন্ট, বিমানবন্দর ছাড়া তেমন কিছু ছিল না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নেপিদোতে বসবাস করলেও তাদের পরিবার বাস করত রেঙ্গুনে। বিপণী বিতান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট তেমন সুলভ ছিল না শুরুর দিকে। তবে শহরে সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে৷

ভূতের শহর বলা হয় কেন?

মিয়ানমারের নতুন রাজধানী নেপিদো শহরে সবকিছু থাকলেও একটি জিনিসের ঘাটতি বা নেই বললেই চলে, তা হলো জনসংখ‌্যা। নেপিদোতে মাত্র ১০ লাখেরও কম লোক বসবাস করে। আবার রাজধানীর আশপাশের উপশহরে মোট জনস‌ংখ‌্যার অধিকাংশই বাস করে। লোকজন এখানে আবাস্থল গড়তে না চাওয়ার মূল কারণ হল স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি ও উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি। 

অবকাঠামোগত ও অন‌্যান‌্য সুযোগ সুবিধার দিক থেকে যথেষ্ট উন্নত হলেও অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার অভাবে মিয়ানমারের অধিকাংশ লোক তাদের নতুন রাজধানী শহরে বসবাস করতে চায় না। জনমানবহীন হবার কারণে এই শহরটি ভূতের শহর হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। এখানকার জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মাত্র ১৩১ জন। 

নেপিদোর জনশূন‌্যতা। Image Source: southchinamorningpost.com

নেপিদোর সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো এখানকার রাস্তা। অধিকাংশ রাস্তায় প্রায় ২০ লেনের প্রশস্ত হাইওয়ে কিন্তু এখানে গাড়ি চলাচল হয় না বললেই চলে। অনেক ক্ষেত্রেই শহরের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে প্রায় ঘন্টা খানেক সময় লাগে।

নেপিদো শহরে যে একটিমাত্র বিমানবন্দর আছে এই বিমানবন্দরটির প্রতিবছর প্রায় ৩৫ লক্ষ যাত্রীকে সেবা দিতে পারবে। কিন্তু ব্যস্ততার মধ্যেও হাতে গোনা মাত্র ১০-১২ জন লোক বিমানবন্দরটি ব্যবহার করে।সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের যাতায়াতের কাজে নেপিদোর বিমানবন্দর ব্যবহৃত হয়। 

এখানকার শপিংমল, বিলাসবহুল হোটেল একইরকম ফাঁকা থাকে। যদিও অনেকেই নেপিদোতে উন্নত ভবিষ্যৎ দেখছেন। এর মূল কারণ শহরটি তৈরি করা হয়েছে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে। জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটলে অদূর ভবিষ্যতে যেন শহরটি মিয়ানমারের জন্য বেশ সহায়ক হতে পারে। হয়তো নেপিদো তখন ভূতের শহর বলার হাত থেকে মুক্তি পাবে।

 

 

 

Feature Image: kiwi.com
References:
01. Naypyidaw – Ghost Town or Metropolis of the Future?
02. THE REAL NAYPYIDAW: INSIDE MYANMAR’S ‘GHOST CITY’ CAPITAL.