ন্যাট্রন: যে হ্রদের সংস্পর্শে প্রাণি পাথর হয়ে যায়

285
0

গ্রিক পুরাণে এক অভিশপ্ত দেবীর নাম মেডুসা। যে কিনা দেবী থেকে পরবর্তীতে অভিশপ্ত হয়ে দানবে পরিণত। মেডুসার চুলের বদলে ছিল সাপ আর তার সাথে যে কারোর দৃষ্টি মিলে গেলে সেই-ই পাথরে পরিণত হতো। পুরাণে এমন কাহিনী থাকলেও বাস্তবে এমন কিছু নেই বলে বিশ্বাস করাটা স্বাভাবিক বিষয়।

তবে, এই বিশ্বাসকে মিথ্যায় পরিণত করতে পারে প্রাকৃতিক এক হ্রদ। এই বিচিত্র পৃথিবীতে প্রকৃতির এমন অনেক ঘটনাই রয়েছে যা চিরকালের জন্যই রহস্য হয়ে রয়ে যাবে।। তন্মধ্যে ন্যাট্রন নামক একটি হ্রদ; যার সংস্পর্শে এলে পশু-পাখিও পাথরে পরিণত না হলেও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

ন্যাট্রন হ্রদটি একটি হাইপারস্যালাইন এবং অ্যালকালাইন (ক্ষারীয়) একটি হ্রদ; যা পূর্ব আফ্রিকার তানজানিয়ায় অবস্থিত। দেশটিতে চারটি অ্যালকালাইন বা ক্ষারীয় হ্রদ আছে। তবে ন্যাট্রনই সবচেয়ে জনপ্রিয়।

ন্যাট্রন হ্রদের অবস্থান। Image Source: NASA Earth Observatory

অগভীর কিন্ত প্রশস্ত এই হ্রদটির গভীরতা তিন মিটার হলেও এটি ২২ কিলোমিটার ধরে বিস্তৃত। প্লেইস্টোসিন যুগ থেকে একটি দুর্লভ লাভা যেটি সোডিয়াম ও পটাশিয়াম কার্বনেট-এ পূর্ণ ছিল। এই লাভা অল ডোনিও লেঙ্গাই নামক আগ্নেয়গিরি থেকে বের হয় যেটি এই হ্রদের কাছাকাছি অবস্থিত।

বলা হয়ে থাকে, আগ্নেয়গিরিটির বয়স আড়াই মিলিয়ন বছরের মতো এবং উচ্চতা তিন হাজার মিটার। হাজার বছর ধরে আগ্নেয়গিরিটি তার রুপ বদলেছে এবং তারই সাক্ষী হয়ে আছে এই ন্যাট্রন হ্রদ। মূলত এই লাভা ন্যাট্রন হ্রদে গিয়ে পড়ে। যেহেতু এই হ্রদের পানি অন্য কোন সাগর বা নদীর সাথে মিশে যায় না, সেহেতু লাভা সেই হ্রদে থাকে এবং বছরে মাত্র ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কারণে হ্রদটিতে সেই লাভা এবং পানির সংমিশ্রণের তাপে তীব্র বাষ্পীভবন হয় যা হাজার বছর ধরে চলে আসছে।

এই বাষ্পীভবনের কারণে দুটি দ্রব্য তথা সোডিয়াম বায়োকার্বনেট এর মিশ্রণ যাকে ট্রোনা (Trona) বলা হয় এবং হাইড্রেটেড সোডিয়াম কার্বনেট বা ন্যাট্রন একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে বিষাক্ত লবণ তৈরি করে। অর্থাৎ, ন্যাট্রন হ্রদের বিষাক্ত লবণের জন্য ট্রোনা এবং ন্যাট্রনের সংমিশ্রণই দায়ী।

যার ফলে হ্রদটির গড় ক্ষারত্ব ১০.৫ এবং এর পিএইচ ১২ হয়ে থাকে। এছাড়াও, মরুভূমি এবং আগ্নেয়গিরি কাছাকাছি হওয়ায় হ্রদটির পানির তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৬০ ডিগ্রী হয়ে থাকে।

হ্রদে লবণের ঘনত্বের চিত্র Source: Shutterstock

অর্থাৎ, হ্রদটির এই মারাত্নক বিষাক্ততার কারণে বা উচ্চমাত্রার পিএইচ ও ক্ষারের পানি যখন একটি পশু বা পাখি পান করতে যায় তখন সে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। তবে প্রশ্ন উঠে, কেনই বা প্রাণিগুলো সেই পানি পান করতে যায়? এর পেছনে মূলত হ্রদটির লাল বর্ণের ভূমিকা আছে বলে অনেকে মত দেন।

ন্যাট্রন হ্রদের লবণাক্ততার কারণে সায়ানোব্যাকটেরিয়া নামক লবণ ভক্ষণকারী এক অণুজীব বা ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন হয়। এই হ্যালোফিলিক অণুজীবটির বেঁচে থাকার জন্য সালোকসংশ্লেষণ প্রয়োজন। তাই এটি বিভিন্ন রঞ্জক বহন করে, আর এই রঞ্জকের কারণেই আকর্ষণীয় লাল রঙের সৃষ্টি হয়।

বলা হয়ে থাকে, শুধু লাল নয় মৌসুমভেদে এটি গোলাপীও হয়ে থাকে। কিছু প্রজাতির মাছ এবং অমেরুদন্ডী প্রাণি এই পানিতে অভিযোজন করতে পারলেও পাখি কিংবা অন্যান্য সাধারণ পশু পানিটি সহ্য করতে পারে না। হ্রদটির উপরিভাগ আয়নার মতো দেখায় বলে পাখিগুলো ফাঁদে পড়ে এটির পানি পান করতে যায় এবং শেষমেষ এর মধ্যে পড়ে মারা যায় অথবা তাদের শরীরের অংশ পুড়ে যায়।

A mummifying lake - Scienceline
হ্রদে একটি পাখির মমি Source: Scienceline

হ্রদে পড়লে সাথে সাথে মৃত্যু হয় এমন কিন্ত নয়, তবে বেশিক্ষণ থাকলে এটি পাখির দেহকে মমি বা পাথরে পরিণত করে ফেলে। মূলত পানি পান করার সাথে সাথে কার্বনেটগুলো প্রাণির দেহের কোষ ও যকৃতকে আক্রমণ করে যাতে করে শরীরের ক্ষতি করে ফেলে।

ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার নিক ব্রান্ডট ২০১৩ সালে ন্যাট্রন হ্রদের আশেপাশে পাথরে পরিণত হওয়া নানা জীবজন্তুর ছবি তুলে সংবাদপত্রের শিরোনামে জায়গা করে নেন। ভয়ঙ্কর এই ছবিগুলো দেখলে যেন মনে হবে সেই মেডুসার দৃষ্টির জন্যই যেন প্রাণিগুলো পাথর হয়ে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। তিনি এই ছবিগুলো তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন উক্ত এলাকার আবহাওয়ার জন্য।

কেননা, ন্যাট্রন হ্রদের অঞ্চলটি বেশিরভাগ সময়েই শুস্ক থাকায় সেখানের পানি হ্রাস পায়। এতে করে পানির নিচে ও আশেপাশে থাকা মৃত পাখিগুলোকে মমি অবস্থায় দেখা যায়। উল্লেখ্য, এই সোডিয়াম কার্বনেট ও অন্যান্য খনিজ তথা নেট্রো কার্বনেট্রাইট একসময় মিশরীয়রা মমি বানানোর জন্য ব্যবহার করতো। কিন্ত আফ্রিকার এই বিচিত্র প্রকৃতি প্রাণিকে নিজ থেকেই মমিতে রুপান্তর করে মানুষের গবেষণার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

তবে সব প্রাণি কি এই হ্রদের সংস্পর্শে এলে মারা যায়? উত্তরটি দুইভাবে দেওয়া যায়। প্রথমত আগেই বলা হয়েছে যে, ন্যাট্রন হ্রদের সংস্পর্শে এলেই যে নিশ্চিত মৃত্যু হওয়া এমন কিন্ত নয়। গবেষণায় দেখা যায়, কোন প্রাণি যখন বেশি সময় ধরে এর সংস্পর্শে থাকে তারাই কেবল মৃত্যু বরণ করে। আর বাকিদের দেহ পুড়ে যায় কিংবা ত্বক নষ্ট হয়ে যায়।

Nick Brandt - Buffalo in Lake, Lake Natron For Sale at 1stDibs | nick brandt lake natron, nick brandt natron lake, lake natron nick brandt
নিক ব্র্যান্ডটের তোলা একটি ষাড়ের ছবি Source: 1stDibs

২০০৭ সালে এমন এক ঘটনা কিছু ফটোগ্রাফারের সাথে ঘটে। তারা ন্যাট্রন হ্রদের আশেপাশের চিত্র বিশেষ করে ফ্ল্যামিঙ্গোর ছবি তুলার জন্য হেলিকপ্টারে করে সেখানে ভ্রমণ করেন। তাদের সেই আকাশযান হঠাৎ ন্যাট্রন হ্রদে বিধ্বস্ত হয়। এতে করে তারা সবাই বেঁচে গেলেও অনেকের চোখ ও চামড়া পুড়ে যায়। বেশি সময় ধরে সেই পানিতে থাকলে তাদের মৃত্যু হতো নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

দ্বিতীয়ত, কিছু প্রাণি আছে যারা এই মারাত্নক ক্ষারযুক্ত পানির সংস্পর্শে এলেও ক্ষতির সম্মুখীন হয় না। তার মধ্যে অন্যতম একটি প্রাণি হচ্ছে ফ্ল্যামিঙ্গো। ন্যাট্রন হ্রদের আশেপাশে প্রায় আড়াই মিলিয়ন ফ্ল্যামিঙ্গো বাস করে। তারা সায়ানোব্যাকটেরিয়া ভক্ষণ করতে সক্ষম এবং প্রাণিটির মাথার গ্রন্থির মাধ্যম সেই লবণাক্ত পানিকে ফিল্টার করতে পারে। এতে করে পানি পান করতে তারা কোন সমস্যার পড়ে না।

এছাড়াও, এর দেহের চামড়া উষ্ণ তাপমাত্রায় অভিযোজন করতে সক্ষম। বলা হয়ে থাকে, ন্যাট্রন হ্রদের এই অঞ্চলটি ফ্ল্যামিঙ্গোর জন্য স্বর্গ স্বরূপ। কেননা, অন্যান্য পাখিদের সাথে এদের লড়াই করে বাঁচতে হয় না। এতে করে তারা স্বাধীনভাবেই অঞ্চলটির সুবিধা নিতে পারে কোন বাধা-বিপত্তি ছাড়াই।

The Deadly Lake Where 75 Percent of the World's Lesser Flamingos Are Born | Travel| Smithsonian Magazine
হ্রদ এলাকায় ফ্ল্যামিঙ্গো। Source: Smithsonian Magazine

ন্যাট্রন হ্রদ নিয়ে আলোকপাত গত কয়েকবছরেই সবেচেয়ে বেশি হতে দেখা গিয়েছে। এর প্রধান কারণ ফটোগ্রাফার নিক ব্রান্ডটের ছবিগুলো। তিনি তার একটি বইয়ে প্রত্যেকটি ছবি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন।

তিনি এক উক্তিতে বলেছিলেন যে, উক্ত হ্রদের লবণাক্ততা এতই বেশি যে, সেটি তার ক্যামেরার ফিল্মের কালিকে মুহূর্তের মধ্যে নিঃশেষ করে দিতে পারবে।

হ্রদের আশেপাশে ৫৮ জন মানুষের পদচিহ্ন পাওয়া যায় বলে জানা যায়। ধূসর আগ্নেয়গিরি বিশিষ্ট ছাই, শুষ্ক লবণের ভূত্বক দ্বারা ঘেরা এই হ্রদটি যতই বিপদজনক হোক না কেন, এটি প্রকৃতির ক্ষমতা প্রদর্শন এবং বাস্তসংস্থানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Lake Natron: Tanzania's blood red phenomenon | Bradt Guides
ন্যাট্রনে পাশে পদচিহ্ন Source:Bradt Guides

তবে, দুঃখের বিষয় হচ্ছে এই হ্রদটিও ক্যাপিটালিস্টিক ধারণার ফাঁদে পড়ে গিয়েছে। কেননা, হ্রদটির পানির অন্যতম উৎস কেনিয়ার নাইগ্রো নদীতে হাইড্রোইলেক্ট্রিক প্ল্যান্ট তৈরি হচ্ছে। যা ন্যাট্রনের প্রকৃতি ও ফ্ল্যামিঙ্গোর বাস্তসংস্থানের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাস্ত অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও এটিকে টিকিয়ে রাখতে তেমন কোন কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয় না।

 

 

 

Feature Image: Nick Brandt  
References:

01. Lake Natron: Tanzania’s Blood Red Phenomenon. 
02. Lake Natron: Deadly to Most Life, But the Flamingos Love It. 
03. Lake Natron: Tanzania’s Beautiful and Deadly Red Lake. 
04. Does Lake Natron Lake Really Turn Animals into 'Stone'? What's the Truth?