নবরত্ন: সম্রাট আকবরের রাজসভার নয়জন মনীষী

1116
0

মানুষ সংস্কৃতির বাইরের কেউ নয়। জীবনযাপনের সময় যে সংস্কৃতিগুলো মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তার পেছনের ইতিহাসটাকে বাদ দিলে আজকে জীবনের উপাদানগুলো অন্যরকমও হতে পারতো; অবশ্য সে কথা কয়জনই বা ভাবে। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা সালের প্রথম দিন যে পালন করা হয় উৎসবমুখর পরিবেশে, এর পেছনে মোঘল আমলের ইতিহাসটা মুছে ফেললে এই উৎসবটাও আজকে থাকতো না। বর্তমানে বাঙালি সংস্কৃতির এরকম আরও অনেকগুলো আচারের সুত্র খুঁজতে গেলে ইতিহাস মোঘল সাম্রাজ্যের দিকে ইঙ্গিত করে। প্রভাবের দিক থেকে বিচার করলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্তপূর্ণ সময় হিসেবে সম্রাট আকবরের রাজত্বকাল উঠে আসে।

সম্রাট আকবরের পূর্বে সম্রাট বাবর এবং তাঁর পুত্র হুমায়ূনের রাজত্বের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, দুজনের কারোর পক্ষেই একটা বড় সময় ধরে রাজ্য পরিচালনার সুযোগ হয়নি। পানিপথের যুদ্ধে ১৫২৬ সালে ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করার পর ১৫৩০ সালের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাবরের হাতে খুব অল্প সময়ই ছিল শাসনকার্য পরিচালনার ভার। পুত্র হুমায়ুন তার শাসনামলের শুরু থেকেই ছিল উত্তর ভারতের রাজপুত ও আফগানিদের আক্রমনের স্বীকার। ১৫৪০ সালে আফগান নেতা শেরশাহর কাছে দিল্লির নিয়ন্ত্রন হারানোর আগ পর্যন্ত মাত্র দশ বছর সিংহাসনে ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ১৫৫৫ সালে আফগান গভর্নর সিকান্দার শুরকে পরাজিত করে দিল্লি ও আগ্রার শাসন ফিরে পাবার পর আর এক বছর মাত্র বেঁচে ছিলেন।

সেদিক থেকে দেখলে আকবরই প্রথম মুঘল সম্রাট হিসেবে একটা লম্বা সময় ধরে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। সম্রাট আকবর ছিলেন একজন বিচক্ষন শাসক। তিনি নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও জ্ঞানীর কদর করতে জানতেন। তার উদাহরণস্বরূপ, সম্রাট আকবরের সভার নবরত্নের কথা উল্লেখ করা যায়।

https://1.bp.blogspot.com/-Lh-_vREqPTU/XyJ7JVBz5KI/AAAAAAAASNs/FW6Z1zRdyoMcgqtfE4yuHuMVdDgWz9fAQCPcBGAYYCw/s1600/akbar-with-his-nine-courtiers.webp
সম্রাট আকবর তার নবরত্নের সঙ্গে। Image Source: salar jung museum

‘নবরত্ন’ ধারনাটি ভারত উপমহাদেশে নতুন নয়। এর আগে রাজা বিক্রমাদিত্যের ‘নবরত্নের’ কথা অনেকেই শুনে থাকবে ইতিহাসের কল্যাণে। সভাসদে নয়জন বিশেষ ব্যাক্তির উপস্থিতির কারণেই নবরত্ন নামকরন। আকবরের নবরত্নের মধ্যে কবি, দার্শনিক, সংগীতশিল্পী, অর্থশাস্ত্রবিদ কিংবা যোদ্ধা, কে ছিল না সেখানে? সম্রাট আকবর যেহেতু ছিলেন জ্ঞানবিজ্ঞান ও সাহিত্য-সংস্কৃতি উভয় ক্ষেত্রেই আগ্রহী তাই তাঁর সভাসদেও ছিল সকল ধরনের মানুষের উপস্থিতি।

আবুল ফজল

পুরো নাম আবুল ফজল ইবনে মুবারাক। জন্ম আগ্রায়। বাবা শেখ মুবারাক ছিলেন শিক্ষক। আবুল ফজল আরবি ভাষায় শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী থাকার কারণে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে লিখতে ও পড়তে শিখে গিয়েছিলেন। ১৫৭৫ সালে তেইশ বছর বয়সে তিনি সম্রাট আকবরের সভাসদে পরিচিতি পান এবং পরবর্তীতে আকবরের প্রধানমন্ত্রী পদে উপনীত হন। আকবরের ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ ধর্মের প্রবর্তনের পেছনে তাঁর ভূমিকা ছিল অশেষ।

আবুল ফজল ইবনে মুবারাক। Image Source: britishlibrary.com

তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার রচিত ‘আকবরনামা’ গ্রন্থের জন্য। যা সম্রাট আকবরের জীবনের উপর তিন খণ্ডের রচনাবলী। এছাড়া, তিনি ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থেরও লেখক; যা তখনকার শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে একটি পরিস্কার দলিল হিসেবে কাজ করে। তিনিই প্রথম পারস্য ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। যা আদর্শিকগত দিক থেকে তার পরমত সহিষ্ণুতার পরিচয় বহন করে। তিনি দক্ষিন ভারত থেকে ফেরার পথে ১৬০২ সালে বীর সিংহ বুন্দেলার হাতে নিহত হন।

রাজা টোডরমল

সম্রাট আকবরের অর্থমন্ত্রী ছিলেন রাজা টোডরমল। তিনি একাধারে একজন লেখক, যোদ্ধা, প্রশাসক এবং একজন দক্ষ ব্যবস্থাপক ছিলেন। শৈশবে যখন বাবাকে হারান তখন তার হাতে জীবিকা অর্জনের কোন উপায় ছিল না। পেশা হিসেবে যখন লেখালেখিকে বেছে নেন তখন তার বয়স খুব কম। পরবর্তী জীবনে আফগান নেতা শেরশাহ তাকে পাঞ্জাবে দুর্গ নির্মাণের দায়িত্ব দেন। শুর সাম্রাজ্যের অবসানের পর পরবর্তীতে আবার মোঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হলে তিনি সম্রাট আকবরের অধীনে আগ্রা রাজ্যের দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি গুজরাটের গভর্নর পদেও নিয়োজিত হন।

রাজা টোডরমল। Image Source: royalark.net

তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য ১৫৮২ সালে সম্রাট আকবর তাকে ‘দিওয়ানী-আশ্রাফ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তার সময় যে ভূমি জরিপ, ভূমি কর এবং রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল তা পরে ব্রিটিশ আমলের প্রশাসনিক কাঠামোকেও প্রভাবিত করেছিল।

আব্দুল রহিম খান-ই-খানা

সম্রাট আকবরের অভিভাবক বৈরাম খানের পুত্র ছিলেন আব্দুল রহিম খান-ই-খানা। ১৫৬১ সালে বৈরাম খান গুজরাট যাবার পথে আফগানদের হাতে নিহত হবার পর সম্রাট আকবর আব্দুল রহিমকে তার সভায় নিয়ে আসেন এবং একজন অভিজাত মোঘল কন্যার সাথে তাকে বিবাহ দেন। পরে বৈরাম খানের দ্বিতীয় স্ত্রীকে আকবর বিয়ে করেন এবং আব্দুলকে নিজের সৎপুত্র হিসেবে স্বীকার করেন।

আব্দুল রহিম খান-ই-খানা। Image Source: famouspeople.com

ভারতীয় সাহিত্যে আব্দুল রহিমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি তার কবিতায় রামায়ন, মহাভারত, পূরাণ এবং গীতা থেকে উদ্ধৃতি দেন। যার দ্বারা তখনকার ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া, তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর দুটি বই ও আকবরের স্মৃতিকথা এবং অসংখ্য দোহা রচনা করেছেন।

রাজা বীরবল 

নবরত্নের মধ্যে যাকে স্বয়ং সম্রাট আকবর সবচেয়ে আলাদা চোখে দেখতেন তিনি ছিলেন বীরবল। আসল নাম মহেশ দাস। তিনি ছিলেন বিচক্ষন এবং উপস্থিতবুদ্ধিসম্পন্ন। যা তাকে শুধুমাত্র উজির-এ-আজমই নয় আকবরের একজন কাছের বন্ধুতেও পরিণত করেছিল। ব্রাহ্মন পরিবারে জন্ম নেওয়ায় অল্প বয়েসেই কবিতা ও সাহিত্যের সাথে পরিচিত হন। এর আগে তিনি রাজা রাম চন্দ্রের সভাসদেও কাজ করেছিলেন।

Birbal ~ Detailed Biography [Age,Family,History]
রাজা বীরবল। Image Source: thehanindia.com

আঠাইশ বছর বয়সে তিনি আকবরের সভাসদে আসেন। তার সাথে আকবরের সম্পর্কের কথা ইরা মুখতি’র ‘দ্য গ্রেট মুঘল’ বইতে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি আকবরের ধর্মীয় ও সামরিক বিষয়ে উপদেষ্টা হিসেবে ৩০ বছর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি একমাত্র সনাতন ধর্মের হয়ে আকবরের ‘দিন-ই-ইলাহি’ ধর্মে দিক্ষিত হন। ১৫৮৬ সালে উত্তর ভারতে একটি সামরিক যুদ্ধে তিনি গুরুতর আহত হন এবং পরে মৃত্যুবরণ করেন। বীরবলের বিচক্ষনতার কথা এখন পর্যন্ত অসংখ্য লোককথায় উল্লেখ পাওয়া যায়।

মোল্লা দো-পিয়াজা 

সম্রাট আকবরের সময়ের সরাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন মোল্লাহ দো-পিয়াজা। পছন্দের খাবার মোরগা দো পিয়াজা হবার কারনে আকবর তার নাম রেখেছিলেন ‘মোল্লাহ দো-পিয়াজা’। তিনি মোঘল সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রনের দায়িত্বে ছিলেন।

মোল্লা দো পিয়াজা। Image Source: pinterest.com

যদিও তার আদৌ অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। তার শের ও সায়েরির বিষয়ে সুখ্যাতি থাকার জন্য তাকে আকবরের নবরত্নের মধ্যে তাকে স্থান দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া, তার সম্পর্কে বেশিরভাগই অনুমান ভিত্তিক গল্প।

ফাইযি

তার আসল নাম শেখ আবু আব্দুল্লাহ আল-ফাইয ইবনে মুবারাক। ফাইযি শুরুতে ছিলেন সম্রাট আকবরের ছেলের গনিতের শিক্ষক। পরবর্তীতে তাকে আকবর নবরত্নের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি ছিলেন আবুল ফজলের বড় ভাই। স্বাধীন দার্শনিক চিন্তা তার কবিতার মূল উপাদান ছিল।

ফাইযি। Image Source: alamy.com

তিনি দরিদ্রদের প্রতি সদয় ছিলেন। তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত ভারতীয় গণিতবিদ ভাস্করাচার্য্যের ‘লিলাবতি’র ফারসি ভাষায় অনুবাদের জন্য।

ফকির আযিয়াও-দিন 

আকবরের সভার ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন ফকির আযিযাও-দিন। তার জন্ম, মৃত্যু সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। তিনি মরমিবাদে বিশ্বাস করতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে সম্রাট আকবরের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ফকির আযিযাও-দিন। Image Source: wikimedia.commons

তানসেন 

পূর্বনাম ছিল রামতনু মিশ্র। আবার কোথাও উল্লেখ আছে, রাম পান্ডে হিসেবে। সঙ্গীত শিক্ষা হয় মধ্যপ্রদেশে। শুরুতে শিক্ষক ছিলেন স্বামী হরিদাস পরবর্তীতে তাতে হযরত মুহম্মদ ঘাউসের নামও যোগ হয়। সঙ্গীত জীবন শুরু করেন রামচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। ১৫৬২ সালে আকবরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি তাকে তাঁর সভায় যোগদানের জন্য দূতের মাধ্যমে আহবান জানান। শুরুতে তানসেন সম্মতি না দিলেও রামচন্দ্রের অনুপ্রেরনায় বৃহৎ পরিসরের পরিচিতির জন্য তিনি আকবরের সভাসদে যোগ দেন।

তানসেন। Image Source: wikimedia.commons

তিনি একাধারে ছিলেন গায়ক, সুরকার, বাদক এবং সর্বোপরি উত্তর ভারতীয় ধ্রুপদি সঙ্গীতের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন। তার রচিত ধ্রুপদি সঙ্গীত সম্পর্কিত বই ‘সঙ্গিতা সারা’ এবং ‘শ্রী গনেশ স্তোত্রা’র জন্য তিনি সমাধিক পরিচিত। ধ্রুপদি সঙ্গীতের অনেকগুলো নতুন রাগ তৈরির পেছনে ছিল তার কৃতিত্ব। তার এসকল গুণের জন্য তাকে ‘মিয়া’ উপাধি দেওয়া হয়। যার অর্থ জ্ঞানী ব্যাক্তি।

রাজা মান সিংহ 

মোঘল সেনাবাহিনীর সেনাপতি ছিলেন রাজা মান সিংহ। তার জন্ম ১৫৫০ সালে। তার সাথে সম্রাট আকবরের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। তার মায়ের বোনের সাথে সম্রাট আকবর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন তাকে সভাসদে স্থান দেওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ। মান সিংহ মোঘল সেনাবাহিনীর ১৫৭৬ সালে রাজা রানা প্রতাপের বিরুদ্ধে ‘হালদিঘাতি’ যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।

রাজা মান সিংহ। Image Source: wikimedia.commons

এছাড়াও, তিনি ১৫৯৪ সালে সম্মিলিতভাবে ঝারখন্ড, বাংলা, ওড়িশ্যা এবং বিহারের গভর্নর হিসেবে নিয়োজিত হন। তিনি টানা তিন মেয়াদে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার যে কৃতিত্বের জন্য তিনি সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন তা হলো কৃষ্ণ মন্দিরের স্থাপত্যকলা যেটি বৃন্দাবনের উত্তরপ্রদেশে এখনও রয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।

 

Feature Image: Olympia Auction
তথ্যসূত্রসমূহ:
01. Who Were The Nine Gems (Navratnas) Of Emperor Akbar, The Great Mughal Emperor?
02. Navratnas of Akbar.
03. The Fascinating History Behind the Nine Gems of Mughal Emperor Akbar’s Court.