বর্তমান সভ্যতায় আমরা জানি যে গ্রহণ কেন হচ্ছে। আদি সভ্যতায় এবং আদি ইতিহাস অনুযায়ী ঘাটাঘাটি করলে তাদের গ্রহণ নিয়ে বেশ খানিকটা ভ্রান্ত ধারণা দেখা যায়। সূর্যগ্রহণ মূলত এক ধরণের জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত ব্যাপার যা পৃথিবীর এবং সূর্যের পাশে চন্দ্রের আবর্তনের ঘটনার প্রতি দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। এই নিয়ে মানুষের মনে পূর্বে থেকে অনেক ধরণের ভ্রান্ত ধারণা উপস্থিত থাকলেও আধুনিক বিজ্ঞান এই ঘটনাটি সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আধুনিক তথ্যানুসারে এই ব্যাপারটির উপর পরিপূর্ণ ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হবে আজকের আর্টিকেলে।
সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে পৌরাণিক ধারণা
প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যার আলোকে কিভাবে আকাশে আংশিকভাবে সূর্যের প্রস্থান ঘটে তা বুঝার চেষ্টা হয়েছে। তাই কেন সূর্যগ্রহণ সংগঠিত হয় তা নিয়ে তাদের ছিল বিভিন্ন মতামত। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সভ্যতায় ধারণা মতে, পারিপার্শ্বিকভাবে পৌরাণিক চিত্রমতে সূর্যকে গলাধঃকরণ করা কিংবা সূর্যকে আটকিয়ে রাখা এমন বিষয়কে বলা হয়েছে সূর্যগ্রহণ। আবার অন্যদিকে সৃষ্টিকর্তার রাগান্বিত রূপ কিংবা মত-বাক্যের রাগান্বিত প্রতীককে সূর্যগ্রহণ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।
সূর্য এবং চন্দ্রের যুদ্ধ পরিস্থিতি
ইনো-ইট লোকগাঁথায় আছে যে, চন্দ্র এনিনগ্যান এর সাথে সূর্যমাতা মেলিনা ঝগড়ার পর তিনি সরে আসেন। আর সেই কারণে ঝগড়ার পর এনিনগ্যান যখন তার বোনের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করে তখন মূলত সূর্যগ্রহণ সংগঠিত হয়। বানিন এবং টোগোতে বসবাসকারী বাটাম্যালিবা সূর্যগ্রহণকে একটি জানার বিষয় হিসেবে বুঝার এবং শেখার চেষ্টা করেছেন। তাদের বিজ্ঞানের মতামত অনুযায়ী সূর্য এবং চন্দ্রের মধ্যে বিদ্যমান বিরোধের জন্য তাদের এক অপরকে রক্ষা করা এবং বিদ্যমান বিরোধের নিষ্পত্তি করার এক ধরন হলো এই সূর্যগ্রহণ।
আধুনিক সভ্যতায় সূর্য নিয়ে অন্ধবিশ্বাস
সূর্যগ্রহণ নিয়ে আতংক এখনো বিরাজ করছে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষজন এখনো সূর্যগ্রহণকে মৃত্যু, ধ্বংস এবং বড় ধরণের প্রলয়ের পূর্বাভাস হিসেবে মনে করে থাকেন। গর্ভবতী নারীদের এবং তাদের অনাগত সন্তানের জন্য একটি বিপদ সংকেত হিসেবে সূর্যগ্রহণকে আখ্যায়িত করা – বড় ধরণের ভ্রান্ত ধারণার এখনো একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ভারতের বিভিন্ন অংশে এখনো মানুষ সূর্যগ্রহণের সময় বিনা খাদ্য এবং পানি পানে বিশ্বাস রাখে। কারণ তাদের মধ্যে এক ধরণের ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে সূর্যগ্রহণের সময় গ্রহণ-কৃত খাবারে বিষক্রিয়া থাকে। তাই সেই খাবার গ্রহণ করা তাদের জন্য ক্ষতির সমতুল্য।
তবে সূর্যগ্রহণকে নিয়ে সকল প্রকার ভ্রান্ত ধারণা মোটেও ধ্বংসের সমতুল্য নয়। ইতালিতে এক ধরণের বিশ্বাস রয়েছে যে, অন্য সাধারণ-দিনে রোপনকৃত ফুলগাছের তুলনায় সূর্যগ্রহণের সময় রোপনকৃত ফুলগাছের ফুল অধিক সুন্দর এবং অধিক উজ্জ্বল হয়ে থাকে।
সূর্যগ্রহণ এবং প্রেমময় উপাখ্যান
অনেক সাংস্কৃতিক ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে জানা যায় যে, সূর্য তার ভালোবাসা চাঁদের জন্য যে লড়াই করেছে তা মাঠ পর্যন্ত গড়িয়েছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এবং ভিন্ন ধরণের প্রেমময় উপাখ্যানের গল্প শোনা যায়। যেমন-
- অস্ট্রেলিয়ান এবোরিগেন্স এর মতে, সূর্যের মধ্যে এক ধরণের নারীর সত্ত্বা বিরাজ করে যা আলো সরবরাহ করে। আর চন্দ্রের মধ্যে বিরাজ করে একজন পুরুষ সত্ত্বা। লুনার সাইকেলের সাথে সমন্বয় সাধনের কারণে, সেই সাথে নারীর ঋতুগত ধাপের ধরণের উপর ভিত্তি করে চন্দ্রের ফার্টালিটি হয়ে থাকে। সূর্যগ্রহণ চন্দ্র এবং সূর্যের মিলনের ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করে থাকে।
- জার্মান মেথডোলজির আলোকে, রুদ্ররূপ ধারণকৃত সূর্য এবং ঠাণ্ডা শীতল রূপ চন্দ্র পরস্পরের সাথে বিবাহ বন্ধনে অবর্ধিত হয়েছে। তাই সূর্য দিনের বেলা প্রভাব বিস্তার করে আর চন্দ্র রাতের বেলা প্রভাব বিস্তার করে। তাদের এই দাম্পত্যময় জীবনে সূর্যগ্রহণের মধ্যে পরস্পরের সাথে পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে।
- আমেরিকানরা এই বিষয়টির সাথে একমত পোষণ করেছেন যে চন্দ্র এবং সূর্য সূর্যগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিষ্পরের সান্নিধ্যে আগমন করে।
- পশ্চিমা আফ্রিকানদের বেনিন এর মতে, বিপরীত লিঙ্গের চন্দ্র এবং সূর্য চলাচলের কক্ষপথ খুব বেশি ব্যস্ত থাকার কারণে যখন তারা পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে তখন তারা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য আলো বন্ধ করে দেয়।
- তাহিতিয়ান সভ্যতার আলোকে, কক্ষপথ প্রেমীদের মতে গ্রহণের কারণে তারা হারিয়ে যায় এবং ফলে আলো এর জন্য তারার মধ্যে প্রতিস্থাপিত হয়।
সূর্যগ্রহণ এবং আবহাওয়া
সূর্যগ্রহণ এবং আবহাওয়ার সাথে সম্পর্ক নিয়ে কিছু চমৎকার তথ্য জেনে নেওয়া যাক-
- কুয়াশা এবং শিশিরের প্রভাবের কারণে সূর্যগ্রহণ কিছুটা বিপদজনক হতে পারে।
- জাপানিজরা ভাবেন যে, সূর্যগ্রহণের সময় আকাশ থেকে বিষাক্ত কণা নিক্ষিপ্ত হবে এবং তা তাদের ঘিরে রাখবে।
- ট্রানসেলভিয়ানারা বিশ্বাস করেন, গ্রহণে প্লেগ রোগের উৎপত্তি ঘটে।
- আলে-কশান এর স্থানীয়দের বিশ্বাস যে, কুয়াশা এবং আদ্রর্তার সমন্বয় এর ফলে তার থেকে সর্দি কিংবা ফ্লু এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। অনেক সময় জিনিসপত্র নিচে পড়ে যায় এবং এর মাধ্যমে প্রচুর শব্দ হয়।
সূর্যগ্রহণ এবং মানুষের ব্যবহার
বর্তমান সভ্যতায় এসেও মানুষের মাঝে সূর্যগ্রহণ নিয়েও এক ধরণের ভয় কাজ করে।
- সম্ভাব্য ২০১০ সালের দিকে, সূর্যগ্রহণের প্রাক্কালে নিজেদের ভয়ের কারণে মানুষেরা নিজেদের ঘরে অবস্থান করে। তবে কিছু কিছু মানুষ রাস্তার বেরিয়েছে হাঁটার জন্য, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য, নিজেদের ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করার জন্য তবে বেশিরভাগ স্কুল কলেজ এই কারণে বন্ধ ছিল।
- ১৯৯৫ সালের দিকে কম্বোডিয়ায় সূর্যগ্রহণের সময় ভয় পেয়ে সৈন্যরা আকাশে গুলি ছুঁড়তে লাগলো যাতে আকাশের ড্রাগনরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। ধারণা করা হয় যে, সেই সময় শুধুমাত্র আকাশে বুলেট নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
- ১৯৯১ সালের দিকে ক্যালিফোর্নিয়ার বাজাতে নভোচারীরা নিজেকে হোটেল স্টাফ এর পোশাক পড়ে নিজেদের হোটেল স্টাফে রূপান্তরিত করে। যার ফলে তখন সে স্থান অন্ধকারে ছেয়ে যেতে থাকে।
সূর্যগ্রহণ এবং গর্ভকালীন সময় নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা
অনেক বিজ্ঞ-ব্যক্তিরা গর্ভকালীন সময়ে সূর্য গ্রহণের কারণে নিজেদের নিয়ে বেশ শঙ্কায় পড়েন। তারা ভাবেন যে, সূর্যগ্রহণের প্রাক্কালে কোন গর্ভবতী নারীর অন্ধত্ব, ঠোঁটে সমস্যা কিংবা জন্মদানের সমস্যা হয়। বর্তমান সভ্যতায় এই নিয়ে বেশ ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে। গর্ভকালীন নারীরা এই সময়ে নিজেদের সতর্ক রাখে, খাবার খায় না, রান্না করে না আবার কোন ভারী জিনিস এর ভর বহন করা থেকে বিরত থাকে সূর্য গ্রহণের প্রাক্কালে।
বর্তমানে মডার্ন ব্লগগুলোতে বলা হয়েছে যে, সূর্যগ্রহণের এই সময়ে নারীরা কোন মেটাল ব্যবহার করে তাদের অনাগত সন্তানকে রক্ষা করার জন্য। আবার অনেকের ধারণা মতে, এজ-টেক সম্প্রদায়ের তারিখ নিয়ে এক ধরণের কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে যে, সেলেস্টিয়াল বিস্ট সূর্যকে কামড়ে ধরে খেয়েছিল। কিন্তু এই ব্যাপারটি পুনরায় হতে পারে যদি কোন নারী গর্ভবতী হয়। তখন তার বাচ্চার সাথে এমনটা হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে অবশ্যই এগুলো কুসংস্কার মাত্র। এগুলো কোনটিই সত্য নয়। তবে সূর্য গ্রহণের ক্ষেত্রে আপনাকে যে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে তা হল এই গ্রহণের প্রাক্কালে আকাশের দিকে তাকানো থেকে বিরত থাকা। তা না হলে আপনার রেটিনার ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। ভারতের কিছু অঞ্চলে গতবছর সূর্যগ্রহণ অবলোকন করার সুযোগ হয়েছিল। সূর্যগ্রহণ ভারতের সাউথ ইন্ডিয়াতে কেরে-লাস চ্যারুবতার নামক স্থানে প্রথমে সূর্যগ্রহণ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। এই সূর্যগ্রহণ প্রায় ৮.০৫ থেকে ১১টা পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
চলুন সূর্যগ্রহণ নিয়ে বিজ্ঞানীদের প্রচলিত কিছু ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ দেখা যাক।
- আমেরিকান স্পেস এজেন্সি নাসার মতে, সূর্যগ্রহণের প্রাক্কালে এক ধরণের ক্ষতিকর রশ্মি নির্গত হয় যা আমাদের চোখের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। যদিও এর পুরোপুরি সত্যতা নেই। সূর্যগ্রহণের সময় পুরো চাঁদটি সূর্যকে ঘিরে রাখে, তখন ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন উৎপন্ন হয়, সাথে সাথে এক ধরণের সবুজাভ আভার দেখা মিলে। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার মতে, সূর্য থেকে উৎপত্তি রশ্মি পৃথিবীতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আলোর পরিমাণ বেশ মৃদু হয়ে উঠে। তাই বিদ্যমান করনাল আলো কখনোই আমাদের আমাদের মহাকাশের ১৫০ মিলয়ন কিলোমিটার অতিক্রম করে বায়ু মণ্ডলে যখন প্রবেশ করে তখন তা আমাদের চোখের উপর বেশ প্রভাব ফেলে। যা অনেক সময় আমাদের চোখে বয়ে আনতে পারে অন্ধত্ব। আর এই কারণে সূর্যগ্রহণের প্রাক্কালে সূর্যের দিকে তাকানোর কথা নিষেধ করা হয়েছে। কারণ বিজ্ঞানীদের দাবী যে, সে আলো আমাদের চোখের রেটিনার উপর বেশ মারাত্মক প্রভাব বয়ে আনতে পারে।
- আরেকটি বেশ প্রচলিত বিষয়ের উপর নাসার বিজ্ঞানীরা ইঙ্গিত করেছেন যে, গর্ভবতী মহিলাদের কখনোই সূর্যগ্রহণ দেখা উচিত নয়। কারণ এটি তার অনাগত সন্তানের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে পূর্বের রেডিয়েশনের নিক্ষেপণের উপর এই ভ্রান্ত ধারণাটি প্রচলিত রয়েছে। তবে বিজ্ঞানীদের মতে, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন করোনার থেকে যে দেখা যায়, তা মূলত আলোর প্রতিচ্ছবি হিসেবে আমরা দেখতে পাই। সেই সাথে এই আলো পুরোপুরি নিরাপদ হিসেবে আমাদের সামনে আসে।
- অনেকেই এই ধারণা করেন যে, সূর্যগ্রহণের সময় যদি কোন আচার অনুষ্ঠানের জন্য খাবার তৈরি করা হয় তাহলে তা খাবারকে বিষাক্ত করে দেয়। কেরালার সাইন্টিস্টদের মতে, এই কথার কোন ধরণের ভিত্তি নেই। বরং সূর্যগ্রহণের সময় কোন খাবার গ্রহণ করা, কোন খাবার পান করা, কিংবা যে কোনো ধরণের কাজকর্ম করা সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ।
- সূর্যগ্রহণের সময় এক ধরণের বিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে যে এই সময় সকল কিছু খারাপ ঘটতে পারে। কিন্তু এটি নিতান্তই একটি ভ্রান্ত ধারণা ছাড়া আর কিছুই না।
- বিজ্ঞানীরা আরও একটি শুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন যে, মানুষ এর মধ্যে এক ধরণের ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত রয়েছে আর তা হল যে অনেকে ভাবেন উত্তর কিংবা দক্ষিণ মেরুতে কোন ধরণের সূর্যগ্রহণ নেই।কিন্তু বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, এমন ধরনের ভ্রান্ত ধারণার কোন অস্তিত্ব বিদ্যমান নেই।
Feature Image: Getty Images/space.com
তথ্যসূত্রসমূহ:
01. Myths and Superstitions Around Solar Eclipses.
02. Solar Eclipse Folklore, Myths, and Superstitions.
03. Solar Eclipse: Myths And Superstitions From Around the World.
04. 5 myths associated with solar eclipse busted by scientists.