রহস্যময় নর্থ সেন্টিনেল দ্বীপ

724
0

মানচিত্রে, উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপটি ভারত মহাসাগরের অন্য যে কোনো সুন্দর স্থানের মতো দেখায়। সমুদ্র সৈকত এবং স্ফটিক কোবাল্ট জলে ঘেরা, এটি বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে অবস্থিত। পুরো দ্বীপ জুড়ে সরু সাদা বালির সমুদ্র সৈকত; যা চোখ জুড়াতে বাধ্য করবে যে কাউকে। 

উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপ অবশ্য অন্য যে কোনো থেকে আলাদা। এটিকে ‘পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন স্থান’, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দ্বীপ’ এবং ‘বিশ্বের সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন উপজাতি’র আবাস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। উপকূল বাদে পুরো দ্বীপটিই বনভূমি। যার কারণে অরণ্য দ্বীপও বলা হয়ে একে। 

এই দ্বীপটিতে বসবাসকারী অধিবাসীদের বলা হয়, সেন্টিনেলিজ। ২০২২ সালের এই দিনে এসে যখন হাতের ছোঁয়ায় বিশ্বের অপর প্রান্ত থেকেও লাইভ প্রিয়জনের সাথে সমস্ত মুহুর্ত শেয়ার করতে পারছেন সেখানে সেন্টিনেল দ্বীপ-এর অধিবাসীরা সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বিহীন জীবনযাপন করছে।

ভৌগলিকভাবে এটি প্রাকৃতিক প্রবাল প্রাচীর দ্বারা ঘেরা এক বন। ২০০৪ সালের ভূমিকম্পের আগে, প্রাচীরগুলি দ্বীপের চারপাশে ৮০০-১২৯০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং একটি দ্বীপ, কনস্ট্যান্স দ্বীপ, দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলরেখা থেকে প্রায় ৬০০ মিটার দূরে অবস্থিত ছিল। ভূমিকম্পের পরে, প্রবাল প্রাচীরের বড় অংশগুলি উন্মুক্ত হয়ে যায়, দ্বীপের সীমানা পশ্চিম এবং দক্ষিণ দিকে ১ কিমি পর্যন্ত প্রসারিত করে এবং মূল দ্বীপের সাথে কনস্ট্যান্স দ্বীপকে একত্রিত করে।

সেন্টিনেলিজ উপজাতি। Image Source: historyofyesterday.com

উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপে আদিবাসীরা এমন এক উপজাতি যারা স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন বেছে নিয়েছে এবং  তাদের সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগ করে তাদের বিচ্ছিন্নতা রক্ষা করে যাচ্ছে আজ পর্যন্ত। সভ্যতার সাথে কোনোভাবে সংস্পর্শে আসতে রাজি না তারা। তাদের জনসংখ্যা আনুমানিক ৫০ থেকে ৪০০।

ভারতের ২০০১ সালের আদমশুমারিতে ৩৯ জন ব্যক্তি (২১ জন পুরুষ এবং ১৮ জন মহিলা) রেকর্ড করা হয়েছে। যেখানে ২০১১ সালের আদমশুমারি শুধুমাত্র ১৫ জন (১২ জন পুরুষ এবং ৩ জন মহিলা) উল্লেখ করেছে।  যাইহোক, যেহেতু জরিপটি দূর থেকে পরিচালিত হয়েছিল, সংখ্যাটি সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম।  

তাদের সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং বায়ু থেকে দ্বীপটি পর্যবেক্ষণ করার অসুবিধার মধ্যে, সেন্টিনেলিজদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং এমনকি তাদের সংখ্যার সঠিক অনুমান সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। আধুনিকতার এই যুগে তারাই সর্বশেষ যোগাযোগ বিহীন উপজাতি। সভ্যতার এত উঁচু অবস্থান সত্ত্বেও এই দ্বীপের মানুষজন আদিমতাই বেছে নিয়েছে।

প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব আর ৭২ কিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপটির মালিক হচ্ছে ভারত। তবে আজ পর্যন্ত এই দ্বীপের স্বাধীনতায় কোনরকম হস্তক্ষেপ করতে পারেনি সরকার। যার মূল কারণ হচ্ছে তাদের সভ্য জগতের প্রতি অনাগ্রহ ও সভ্য সমাজের মানুষের প্রতি হিংস্র মনোভাব। সেন্টিনেলিজরা অত্যন্ত জেনোফোবিক এবং যোগাযোগের কার্যত সমস্ত প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করে চলেছে। আজও প্রায়শই দ্বীপের খুব কাছাকাছি আসা নৌকা এবং হেলিকপ্টারগুলি লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে থাকে তারা। 

সভ্যতার সাথে কোনরকম সম্পর্ক না থাকায় এরা প্রকৃতির সন্তান হিসেবেই থাকে। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠায় স্বাভাবিকভাবেই তারা বর্বর হয়। কথিত আছে, তারা নরমাংসভোজী। বাইরের জগতের মানুষ দেখা মাত্রই এরা আক্রমণ করে। এরা আদিম যুগের মতোই কোন কাপড় পরিধান না করে গাছের ছাল বাকল ব্যবহার করে। 

সেন্টিনেলিজ উপজাতি। Image Source: nat geo collection

তাদের এই সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদের কারণে আকাশ থেকে দ্বীপটি পর্যবেক্ষণ করার একপ্রকার অসম্ভবই বলা যায়। যার ফলে তাদের সংস্কৃতি এবং এমনকি তাদের সংখ্যার সঠিক অনুমান সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না। তাদের কাছে অস্ত্র আছে (সম্ভবত ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরি তীর এবং বর্শা) এবং তারা মাছ ধরার জাল ও তারা মৌলিক আউটরিগার ক্যানো ব্যবহার করে।

তারা মাছ শিকার করে, বন্য গাছপালা সংগ্রহ করে, কিন্তু কৃষি বা এমনকি আগুন তৈরির পদ্ধতির কোনো প্রমাণ নেই। এটি অনুমান করা হয় যে, সেন্টিনেলিজরা আগুনের জন্য বজ্রপাতের অপেক্ষা করে এবং ফলস্বরূপ অঙ্গারগুলি যতক্ষণ সম্ভব একটি ফাঁপা গাছে জ্বলতে থাকে তা কাজে লাগায়। এটাই সম্ভব যে সেন্টিনেলিরা পৃথিবীর শেষ মানুষ যারা আধুনিক সভ্যতার দ্বারা কার্যত অস্পৃশ্য রয়ে গেছে।

কিন্তু তারা কারা এবং কেন তারা এত উগ্রভাবে অন্তরীক্ষ? উন্নত বিশ্বে আমাদের কি তাদের একা ছেড়ে দেওয়া উচিত? এমনকি যদি এটি তাদের শেষ ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়? যোগাযোগ বনাম পশ্চাদপসরণ এর নৈতিক প্রভাব কি? এই প্রশ্নগুলি অন্তত এক শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানী, গবেষক, অনুসন্ধানকারী এবং কর্মকর্তাদের দ্বারা চিন্তা করা হয়েছে। এখানে, আমরা দ্বীপের অসাধারণ টাইমলাইনের দিকে নজর দিই। 

১৮৬৭ সাল। গ্রীষ্মের বর্ষা মৌসুমের শেষের দিকে দ্বীপের কাছে একটি প্রাচীরে বিধ্বস্ত হয় এক বনিক জাহাজ। নিনেভেহ নামক এই জাহাযে ছিল ১০৬ জন বেঁচে থাকা যাত্রী এবং অন্যান্যরা। বিধ্বস্ত হওয়া জাহাজের নৌকায় সমুদ্র সৈকতে নামামাত্রই তাদের আক্রমণ করা হয়। কোনোভাবে তারা সেন্টিনেলিজদের আক্রমণ প্রতিহত করে। অবশেষে একটি রয়্যাল নেভি রেসকিউ পার্টি দ্বারা তাদের খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।  

১৯৮০ মরিস ভিডাল পোর্টম্যান নামের এক সরকারি প্রশাসক তাদের সংস্কৃতি বা রীতিনীতি জানার উদ্যেশ্যে জানুয়ারীর দিকে সেখানে যান। যাওয়ার পথে তারা অনেকগুলো পরিত্যক্ত গ্রাম ও তাদের ঘরবাড়ি খুঁজে পান। সেখান থেকে বড় ছোট ছয়জনকে ধরে পোর্ট ব্লেয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের খাবার-দাবার থেকে শুরু করে  সমস্ত ব্যপারে খুব যত্ন নেয়া হয়।

কিন্তু কিছু জানার আগেই ক্রমশ সবাই অসুস্থ হয়ে যেতে শুরু করে অজানা এক রোগে। এতো যত্নের মধ্যেও তারা সভ্য পরিবেশে কোনো ভাবেই মানায় নিতে পারেনি। যার ফলে এক পর্যায়ে বড় দুজন মারা যায়। পরে ছোটদের বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু এরকমভাবে তুলে নেওয়াতে দুইজন মারা যাওয়ায় সেন্টিনেলিজরা সভ্য সমাজ এর প্রতি আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।  

সেন্টিনেলিজদের সাথে সর্বপ্রথম শান্তিপূর্ণভাবে যোগাযোগ করেন ১৯৯১ সালে ত্রিলোকনাথ পন্ডিত। তিনি ছিলেন ভারতের নৃতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের একজন পরিচালক। তিনি ও তার সহকর্মীরা যদিও সেন্টিনেলিজদেরকে নারিকেল এবং অন্যান্য উপহার দিয়েছিলেন। সেন্টিনেলিজ ভাষা বোঝার ক্ষেত্রেও কোন অগ্রগতি হয়নি। যদিও তাদের উপর কোনোরূপ আক্রমন করা হয়নি তবু সেখানে থাকা অবস্থায় সেন্টিনেলিজরা বারবার তাদের সতর্ক করে দিচ্ছিলো যাতে তারা বেশি সময় না থাকে। 

পন্ডিত এর নেতৃত্বে অভিযান। Image Source: nat geo collection

এরপর ২০০৪ সালের সুনামির পর ভারত সরকার তাদের জন্য ত্রান সামগ্রী পাঠায়। যা তারা প্রত্যাখান তো করেই উল্টো আক্রমণ চালায় সাহায্যকারী দলের উপর। কোনভাবেই তাদের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয় না।  ২০০৬ সালে দুই জেলে মাছ ধরার জন্য অনুমতি ছাড়া সেখানে প্রবেশ করে। সেন্টিলজিরা তাদের হত্যা করে ধরামাত্রই। এমনকি তাদের মরদেহ উদ্ধার করতে হেলিকপ্টার যায় সেটাকেও তীর মেরে আক্রমণ করে! সেই মরদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি আর।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে জন এলেন চাও খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করার উদ্যেশ্য নিয়ে দ্বীপে যান। বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করার কারনে তাকে প্রথমে তীর মেরে হত্যা করা হয়। এরপরে কবর না দিয়ে সমুদ্র তীরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই নৃশংস ঘটনার পর থেকে থেকে ভারত সরকার এই দ্বীপ-এর সাথে বহির্বিশ্বের সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করেন এবং পর্যটন নিষিদ্ধ করেন। যার ফলে দ্বীপটি নিষিদ্ধ দ্বীপ হিসেবে ঘোষণা করা হয়.

Feature Image: indiatimes.com
References:

01. The Worlds Uncontacted Tribe Of North Sentinel Islands, India.
02. North Sentinel Island (A Banned Island).
03. NORTH SENTINEL ISLAND-THE LAND OF THE MOST ISOLATED HUMAN RACE.