মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক: আধুনিক তুরস্কের জনক

302
0
Source: turkicstates.org

স্বাধীনতাই সকল সমস্যার সমাধান।

উক্তিটি করেছিলেন তুরস্কের জাতির পিতা মোস্তফা কামাল। ধর্মকেন্দ্রিক একটি রাষ্ট্র কিভাবে সেক্যুলার রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সবার প্রথমেই কামাল আতাতুর্কের নাম চলে আসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পর বর্তমান তুরস্ক রাষ্ট্রটির এমন এক নাজেহাল অবস্থায় পতিত হয়েছিল যে, দ্বিতীয় কোন রাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই এর সীমানার অংশ নিজেদের বলে চালিয়ে দিচ্ছিল। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে আধুনিক তুরস্কের অন্যতম কর্ণধার মোস্তফা কামাল।

আতাতুর্ক সম্পর্কে জানতে হলে তুরস্কের ইতিহাস সম্পর্কে জানা আবশ্যক। বর্তমানে তুরস্ক বলতে যে রাষ্ট্র বিশ্ববাসী চেনে, সেটি পূর্বে আরো বড় অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। তাদের সাম্রাজ্যকে অটোম্যান সাম্রাজ্য বলা হতো। ১৩ শতকের দিকে এই সাম্রাজ্যের আবির্ভাব ঘটলে এটি আস্তে আস্তে গোটা ইউরোপ ও এর আশেপাশের এলাকা দখল করে নেয়।

বলা হয়ে থাকে, ১৭ শতাব্দীর দিকে অটোম্যান সাম্রাজ্যে ৩২টি প্রদেশ এবং অনেকগুলো ভ্যাসাল রাষ্ট্র ছিল যা দ্বারা পৃথিবীর এক বিরাট অংশ তারা শাসন করতো। এই সাম্রাজ্য ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত পরম রাজতন্ত্রের অর্থাৎ, Absolute Monarchy এর দ্বারা পরিচালিত হলেও এর পরে সেটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে রুপ নেয়।

File:Ottoman empire map.jpg - Wikipedia
অটোম্যান সাম্রাজ্যের মানচিত্র। Image Souce: Wikimedia

উক্ত শাসন ব্যবস্থায় খলিফা কিংবা সুলতান যা নির্দেশ দিতো সেটিই কার্যকর হতো। এতে করে ব্যক্তিস্বাধীনতার গুরুত্ব ছিল না বলে জানা যায়। ১৮৮১ সালে জন্ম নেওয়া কামাল আতাতুর্কের বাবা ছিলেন আধুনিক চিন্তাধারা সম্পন্ন একজন ব্যক্তিত্ব। এরই জের ধরে কামাল আতাতুর্কের মনের মধ্যে সবসময় মানবাধিকার, বাস্তববাদী চিন্তাধারা, সমতা ইত্যাদি বাসা বাধে।

প্রাথমিক শিক্ষা ধর্মকেন্দ্রিক হলেও উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি আধুনিক শিক্ষার দিকে মনোযোগ দেন। ভর্তি হোন মিলিটারি হাই স্কুলে। এখানে থাকা অবস্থায় তিনি স্বজ্ঞানে বৈষম্য সম্পর্কে অভিজ্ঞতা পান। তিনি দেখতে পান যে মিলিটারির মধ্যে ভেদাভেদ করা হয়।

নিয়মিত সেনাবাহিনীতে যোগদানের পরে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক সেখানে খুব অল্প সময়েই পদোন্নতি লাভ করেন। তবে, তার স্পষ্টভাষী আচরণের জন্য সিনিয়রদের চাপে নানা জায়গায় বদলি হতে হয়। উপরের পদের অফিসারগণ তার স্পষ্টভাষী হওয়ার জন্য বিব্রত বোধ করলেও অপছন্দ করতেন না। এর ফলে, তিনি মিলিটারির মধ্যে খুবই জনপ্রিয় এক মুখে পরিণত হোন।

Mustafa Kemal Ataturk | The Founder of Turkish Republic
সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় মোস্তফা কামাল। Image Source: travelatelier.com

সেনাবাহিনীতে যোগদানের পরেই তিনি সংস্থার মধ্যে দুর্নীতি, বৈষম্য দেখে এটিকে অরাজনৈতিক হিসেবে চালানোর প্রস্তাব দেন। তার এই প্রস্তাব রাজনৈতিক নেতারা পছন্দ করেননি। কিন্ত তার বিরুদ্ধেও কেউ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। কেননা, কামাল আতাতুর্ক ছিলেন এক বীর সৈনিক যাকে কেউই কখনো হারাতে পারেনি।

ইতালো-তার্কিশ যুদ্ধে অটোম্যান সাম্রাজ্যের হার হলেও তার বিগ্রেড ইতালিয়ানদের হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। এই যুদ্ধে হারের পর পরই প্রথম বলকান যুদ্ধ শুরু হয় যেখানে অটোম্যানরা আবার পরাজয় বরণ করে। তবে, তৃতীয় বলকান যুদ্ধে অটোম্যান আর্মি আতাতুর্কের বীরত্বের কারণে জয়লাভ করে। এতে করে তিনি ১৯১৪ সালে কর্ণেল পদ লাভ করেন।

ঠিক একইভাবে, ব্যাটেল অফ গ্যাল্লিপলিতে ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ নেভিকে তুখোড় আক্রমণের মাধ্যমে কামাল আতাতুর্কের বাহিনী তাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করে। আসলে তিনি ইউরোপিয়ানদের আক্রমণের কৌশল সবার আগেই আঁচ করতে পারতেন। ফলস্বরুপ গুরুত্বপূর্ণ সব যুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিতেন।

Italo-Turkish War (1911-1912) - About History
ইতালো-তার্কিশ যুদ্ধের একটি চিত্র Image Source: About History

মিলিটারির একজন সদস্য হিসেবে কামাল আতাতুর্কের বীরত্বের কথা বলে শেষ করা যাবে না। যাইহোক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পক্ষ নেওয়ার কারণে অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি কমতে শুরু করে। অর্থাৎ, মিত্র শক্তি নিজেদের ইচ্ছামতো এর অঞ্চলগুলো ভাগাভাগি করা শুরু করে। এতে করে অ্যানাতোলিয়ার নানা অংশ তুরস্কের হাতছাড়া হতে থাকে।

এছাড়া, সরকারও ব্রিটিশদের অনুসারী হওয়ায় কোন ধরণের বাধা প্রদান করেনি। তারা সেভ্রে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এতে করে রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। সাথে সাথে আর্মেনিয়া, গ্রিসের বাহিনীরা তুরস্কের নানা অঞ্চল দখল করতে আরম্ভ করে।

নিজ মাতৃভূমির এই অবস্থা দেখে কামাল আতাতুর্ক মিলিটারি থেকে পদত্যাগ করে দেশের স্বাধীনতার ডাক দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এটিই প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হয়।

Anatolia - Wikipedia
হাতছাড়া হয়ে থাকা অ্যানাতোলিয়া অঞ্চল Image Source: Wikimedia

আতাতুর্ক তুরস্কের জনগণকে জাগ্রত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি তার নিজের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি তৈরি করেন এবং খলিফার বাহিনী এবং মিত্রশক্তিকে পরাজিত করেন। তাদের তুমূল আক্রমণে গ্রিক লাইন থেকে গ্রিস আর্মি এবং মারসাহ থেকে ফেঞ্চ আর্মি পিছু হটে যায়। পশ্চিমা বিশ্ব বুঝতে পারে যে, এখন তুরস্ককে স্বাধীনতা দেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।

এতে করে ট্রিটি অফ লুজিয়ান স্বাক্ষরের মাধ্যমে তুরস্কের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতার পর কামাল আতাতুর্ক প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন।  দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই তিনি রাষ্ট্রটির সংস্কারে নেমে পড়েন। তবে এই সংস্কার সামান্য কোন সংশোধন ছিল না।

ছোটবেলা থেকে লালন করা চিন্তাকেই সংস্কারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে শুরু করেন। তার সংস্কারগুলোকে দুইভাবে ভাগ করা যেতে পারে।

  • ধর্মভিত্তিক ও রাজনৈতিক
  • সামাজিক
Turkiye: Post Lausanne Treaty - Global Village Space
লুজিয়ান চুক্তির পরবর্তী এক চিত্র Image Source: Global Village Space

ধর্মভিত্তিক বা রাজনৈতিক সংস্কার

সবচেয়ে বড় সংস্কার ছিল এই ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কার। তিনি ইসলামিক রাষ্ট্রকে সেক্যুলার রাষ্ট্রে পরিণত করেন। এতে করে কামাল আতাতুর্ক ইসলামী আইনের বদলে ইউরোপীয়ান সেক্যুলার আইনের প্রবর্তন করেন। তবে সেক্যুলারকরণের কারণে অনেক বাধাও দেখা গিয়েছে। কেননা, ধর্মের কিছু নিয়মকে অনুসরণ করেই পূর্বের তুরস্ক পরিচলিত হতো।

এজন্যই তিনি সুলতানাতের বিলুপ্তি ঘটান। গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির মাধ্যমে তিনি সুলতান ষষ্ঠ মোহাম্মদকে পদচ্যুত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় দুই বছর পর অনেক বিরুদ্ধতার মুখে পড়লেও তিনি খেলাফতেরও বিলুপ্তি ঘটান। আতাতুর্কের মূল উদ্দেশ্য ছিল তথাকথিত ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রের মতো আচরণ করা।

প্রগতশীল চিন্তাভাবনার ফলে তিনি ইসলামকে তেমন ভালো চোখে দেখেননি বলে অনেকে মত দেন।। তার সংস্কারকর্মে প্রত্যেকটি জায়গায় ইসলামের নানা রীতিনীতিকে পরিহার করেছেন। এর মধ্যে ইসলামি ক্যালেন্ডার বিলুপ্ত করাও ছিল অন্যতম।

kainatingunesi.com
অটোমান সাম্রাজ্যের সর্বশেষ সুলতান ষষ্ঠ মোহাম্মদ Image Source: kainatingunesi.com

সামাজিক সংস্কার

যেহেতু আতাতুর্ক ধর্মকেন্দ্রিক রীতিনীতি পরিবর্তন করেছেন। স্বভাবতই সেটি সামাজিক সংস্কারের মধ্যেও পড়বে। এর মধ্যে দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটেছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। কামাল আতাতুর্ক শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন করেন। আগে মাদ্রাসা কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা থাকলেও আতাতুর্ক সেটিকে ইউরোপের আদলে পরিবর্তন করার পদক্ষেপ নেন। এর ফলে তুরস্কে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং শিক্ষার হারও সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায়।

এই সংস্কার নারীদের জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। তিনি নারীদের পর্দাকরণের বাধ্যবাধকতা তুলে নেন। এছাড়াও, ১৯৩৫ সালে তুর্কি নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। মোস্তফা কামাল ইউরোপীয়ানদের দ্বারা এতটাই প্রভাবিত ছিলেন যে, তিনি তাদের মতো পোশাক পরিধান করতেন। এর ফলে তিনি তুরস্কের পুরষদের জন্য ‘ইউরোপিয়ান হ্যাট’ এর প্রচলন করেন।

এছাড়াও উপাধি বিলুপ্তি, রবিবারে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা, আরবির পরিবর্তে ল্যাটিন অক্ষরে ভাষার প্রচলনসহ নানা ধরণের সংস্কার আতাতুর্কের সময় হয়েছে। তিনি বৈষম্যহীন একটি বিচারব্যবস্থার প্রচলন ঘটান। তবে পরবর্তীতে দেখা যায় যে, আতাতুর্ক নিজেই বিরোধীদের মতামত দমনে কাজ করেন।

Today in History: Atatürk, who came to Kastamonu, started the Hat and Clothing Revolution
ইউরোপীয়ান হ্যাট হাতে আতাতুর্ক Image Source: Railly News

তুরস্কের এই জাতির পিতা অনেকের কাছেই ত্রাণকর্তা। আবার অনেকেই তাকে চরম সংস্কারবাদী বলে দাবি করেন। দেখা যায়, তার সংস্কারগুলো ইউরোপীয়ান রাষ্ট্রগুলোর আদলে গড়ে উঠা। হয়তো তিনি উক্ত অঞ্চলের উন্নতিকেই মূল হিসেবে দেখেছেন।

যার দরুণ, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি পশ্চিমাদের মতোই উন্নত এক তুরস্কে স্বপ্ন বুনেছেন। এসব কারণে হয়তো বলা যেতে পারে তৎকালীন সময়ে এই ধরণের সংস্কারবাদী মনোভাব অনন্য দর্শনের ইঙ্গিত দেয়।

 

 

 

Feature Image: turkicstates.org 
References

01. Mustafa Kemal Pasha. 
02. ATATURK'S REFORMS. 
03. Who is Atatürk and why is he so important to Turkish people? 
04. The Surname Law. 
05. We Remember: the anniversary of Atatürk’s abolition of the Ottoman Caliphate.