জার্মানি ইহুদিদের জন্য কত বড় মৃত্যুকূপ তা বিশ্ববাসী দেখেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসী বাহিনীর কর্মকান্ডে। এর ফলে তারা ফিলিস্তিনে অবৈধভাবে বসতি গড়ে বর্তমানে আরো বিস্তৃত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব তাই লেগেই থাকে।
এই দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিম জার্মানিতে এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ হয়ে যায়, যেই হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় নিরীহ কিছু ইসরায়েলী অলিম্পিক অ্যাথলেট। এই হত্যাযজ্ঞকেই মূলত ‘মিউনিখ হত্যাকান্ড’ (Munich Massacre) বলা হয়। আজকের আয়োজনে এই হত্যাযজ্ঞের কাহিনী বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হবে।
ফাতাহ
সম্পূর্ণ বিষয়টি জানার পূর্বে কারা এই হামলাটি করেছিলেন তাদের সম্পর্কে জানতে হবে। জানা যায়, ফিলিস্তিনের ‘ফাতাহ’ নামের এক গ্রুপ মিউনিখ অলিম্পিকে অংশ্রহণকারী ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের হত্যা করে। ফাতাহ মূলত একটি গেরিলা বাহিনী যারা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এরা প্যালেস্টেনিয়ান লিবারেল মুভমেন্ট-এর জন্যও পরিচিত। ইয়াসির আরাফাত এবং খালিল আল ওয়াজির এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৫০ সালের দিকে এই সংস্থার প্রতিষ্ঠা হয়। আস্তে আস্তে এটি বিস্তার লাভ করতে শুরু করলে এটি এক ধরণের রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে শুরু করে।
সিরিয়ার দামাস্কাস হতে পরিচালিত হওয়া এই সংগঠনটি ১৯৬৪ সালের ইসরায়েলি ওয়াটার পাম্প ইন্সটলেশন-এ হামলা, ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধ এবং ১৯৬৮ সালে জর্ডানের এক গ্রামে তাদের সাথে ইসরায়েলের লড়াইয়ের দরুণ মোটামুটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেলেছিল। পরবর্তীতে এটি ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা-এর নিয়ন্ত্রণও নেয় বলে জানা যায়।
হত্যাকান্ড
আগেই জেনেছি যে হত্যাকান্ডটি পশ্চিম জার্মানির মিউনিখে সংঘটিত হয়। উল্লেখ্য, তখন জার্মানি পশ্চিম এবং পূর্বে ভাগ ছিল। এক অংশ শাসন করতো সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অপরটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
নাৎসী বাহিনীর সেই নৃশংস ইতিহাসের পর এই প্রথম ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক জার্মান মাটিতে অনুষ্ঠিত হয়। ১২০-এরও অধিক দেশ এবং সাত হাজারের অধিক অ্যাথলেট অংশগ্রহণ করে। প্রথম সপ্তাহে অলিম্পিক গেমস স্বাভাবিক গতিতেই চলে। কিন্ত হঠাৎ ৫ই সেপ্টেম্বর ভোরে ঘটে যায় অলিম্পিক ইতিহাসের অন্যতম এক কালো ঘটনা। ফিলিস্তিনি গ্রুপ ফাতাহ অলিম্পিক ভিলেজে ঢুকে ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের হত্যার জন্য। আক্রমণকারীদের ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ নামে ডাকা হয়। জানা যায় যে, তারা সাধারণ পোশাকেই ছিল বিধায় কেউ সন্দেহ করতে পারেনি।
আক্রমণকারীরা যখন ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের এপার্টমেন্টে আসে তখন রেসলিং রেফারি ইয়োসেফ গুৎফ্রিউন্ড (Yossef Gutfreund) এবং কোচ মোশে ভেইনবার্গ (Moshe Weinberg) প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মোশে ভেইনবার্গ ফিলিস্তিনি সেই আক্রমণকারীদের ধরাশয়ী করে ফেলেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে ও ইয়োসেফকে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। উল্লেখ্য, ইসরায়েলের মোট এগারোজন সদস্য ছিল। বাকি নয় জনকে ফাতাহের সেই দলটি জিম্মি করে ফেলে।
আক্রমণকারীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলের কারাগারে থাকা দুইশতের অধিক ফিলিস্তিনি এবং জার্মান কারাগারে রেড আর্মি ফ্র্যাকশনের আন্দ্রেয়াস বাদের ও উইলরাইক মারি মাইনহফকে মুক্ত করা।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, ইসরায়েল কখনোই এই ধরণের দাবিতে আপোষ করেনি। অর্থাৎ ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনিদের ছাড়তে রাজি হয়নি। এতে করে পশ্চিম জার্মান সরকারের উপর অনেক চাপ আসে। ইসরায়েলের সামরিক সংস্থা বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করতে চাইলে জার্মান সরকার সেটিও নাকচ করে দেয়।
এর পরিপেক্ষিতে, ফিলিস্তিনি আক্রমণকারীরা বুঝে যায় যে তাদের মূল উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। ফলস্বরুপ তারা তাদের কৌশল বদলে ফেলে। তারা হেলিকপ্টার দাবি করে যাতে অ্যাথলেটদের নিয়ে পালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যেতে পারে। জার্মান সরকার সেই দাবিতে একমত হয়। কেননা,তাদের লক্ষ্য ছিল পালিয়ে যাওয়ার সময় ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরকে আক্রমণ করা হবে।
কথা মতো অ্যাথলেট এবং আক্রমণকারীদের জন্য হেলিকপ্টার পাঠানো হয়। তাদেরকে অলিম্পিক ভিলেজ থেকে পনেরো মাইল দূরে ফ্রাস্টেনফেল্ডব্রুক (Fürstenfeldbruck) বিমান ঘাটিতে নেওয়া হয়। আক্রমণকারীদের হটিয়ে দেওয়ার জন্য ছদ্মবেশে জার্মান পুলিশ ছিল। অনেকে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার না করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। আবার কেউ কেউ পুলিশ দ্বারা অপারেশনে যথাযথ অস্ত্র ব্যবহার না করা নিয়েও সমালোচনা করেন।
যাই হোক, পরিকল্পনা মোটামুটি ভালোভাবেই এগোচ্ছিল। কিন্ত এক পর্যায়ে আক্রমণকারীদের একজন হেলিকপ্টার নিরীক্ষণ করতে নামলে হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী জার্মান পুলিশের এক অংশ জিম্মিদের উদ্ধার করার কথা ছিল। কিন্ত আশ্চর্য হলেও সত্য যে তারা জ্যামে আটকে পড়ার কারণে সেখানে পৌঁছাতেই পারেনি।
ফিলিস্তিনি দলটি অবস্থা বেগতিক বলে উপলব্ধি করে। তারা বুঝতে পারে যে তাদের আর জীবন নিয়ে ফিরে যাওয়া হবে না। এর প্রেক্ষিতে তারা সব অ্যাথলেটদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা জিম্মিদের দিকে গ্রেনেড মেরে সবাইকে হত্যা করে। জার্মান পুলিশ আক্রমণকারীদের মধ্যে তিনজন ব্যতিত বাকিদের হত্যা করতে সক্ষম হয়।
আর এভাবেই শেষ হয় ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর গ্রুপ কর্তৃক জার্মান মাটিতে ইহুদি তথা ইসরায়েলকে ঘায়েল করার এক নৃশংস ঘটনা।
মিউনিখ হত্যাকান্ডের মাত্র দুই মাসের মধ্যে সিরিয়া থেকে জার্মানি গমনকারী লুফ্টহানজা ৭২৭ বিমানকে হাইজ্যাক করা হয়। জার্মান পুলিশ কর্তৃক আটককৃত সেই তিনজন ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর মেম্বারদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় জার্মান সরকার। উক্ত তিনজন ফিরে এলে তাদেরকে বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়।
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
একে তো এত অ্যাথলেটের মৃত্যু আবার তার সাথে আটককৃতদের মুক্তি! মিউনিখ হত্যাকান্ডের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল শক্ত অবস্থান নিয়েই ছাড়ে। তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার ‘অপারেশন র্যাথ অফ গড’ (Operation Wrath of God) এর ঘোষণা দেন। এর মূল লক্ষ্য ছিল মিউনিখ হত্যাকান্ডের মাস্টার মাইন্ডদের ধরে হত্যা করা।
ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার অন্যতম সদস্য এবং ইয়াসির আরাফাতের ভাই ওয়াইল জোয়েটারকে অক্টোবরেই ইতালির রোমে হত্যা করা হয়। এরপর মাহমুদ হামশারিকে প্যারিসে এবং বাসির আল কুবাইসি, জাইদ মুকাসিদের মতো সদস্যদের মোসাদ হত্যা করে।
যদিও ১৯৭৩ সালে নরওয়েতে মোসাদ একজন নিরীহ ব্যক্তিকে হত্যা করে বসে। নরওয়েজিয়ান পুলিশ পাঁচ মোসাদ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এভাবেই কয়েক বছর ধরে ‘অপারেশন র্যাথ অফ গড’ অব্যাহত থাকে। অপারেশনগুলোর জন্য মোসাদ অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হলেও তারা কোন আন্তর্জাতিক চাপ পরোয়া না করেই এগোতে থাকে।
মিউনিখ হত্যাকান্ডকে ভিত্তি করে ২০০৫ সালে স্টিভেন স্পিলবার্গ ‘মিউনিখ’ নামের এক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এছাড়াও, ‘ওয়ান ডে ইন সেপ্টেম্বর’ নামের অস্কারজয়ী সিনেমা তো আছেই।
এই হত্যাকান্ড নিয়ে অনেক তথ্যই বের হয়ে এসেছে। পঞ্চাশ বছর পূর্তির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই হত্যাকান্ডের সাথে লিবিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফী জড়িত ছিলেন। জানা যায়, উক্ত সময়ে হত্যাকান্ডটি পরিচালনার জন্য ১ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং-এর ফান্ডিং দেওয়া হয়; যা বর্তমানের মূল্যে দাঁড়ায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অলিম্পিকের ইতিহাসে মিউনিখ হত্যাকান্ড এক নৃশংস অধ্যায়। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিষয়টি যুক্তিসংগত হলেও ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর কর্তৃক অপারেশনটিকে নৈতিকভাবে সমর্থনের ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়। এছাড়াও, পরবর্তীতে মোসাদের অপারেশনগুলো পরিস্থিতি স্থিতিশীল না করে বরং অস্থিতিশীলতার দিকেই নেওয়া হয়েছে যার দরুণ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব আজও নিউজের বুলেটিনে থেকে যায়।
Feature Image: History.com
References: