দক্ষিণ সুদান, নতুন দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি নাম। সুদান থেকে আলাদা হয়ে দক্ষিণ সুদান হিসেবে পরিচয় পাওয়াটা এতটাও সহজ ছিল না দেশটির জন্য। তাদের এই অর্জনের পিছে রয়েছে ২১ বছরের গৃহযুদ্ধ এবং গৃহহারা হওয়া ২০ লাখ মানুষ ও ১০ হাজার নিরীহ প্রাণ। গৃহযুদ্ধের পর ২০০৫ সালে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা পায় দেশটি। কিন্তু তারা চাইতো পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা। তাই আবারো শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
অবশেষে ২০১১ সালে গণভোটের মাধ্যমে দেশটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা অর্জন করে একটি স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়। এত দীর্ঘসময় গৃহযুদ্ধে থাকার ফলে স্বভাবতই দেশ দুটির সাধারণ জনগণের পাশাপাশি ব্যহত হয়েছে দেশগুলোর আদিবাসীদের জীবন যাত্রা। তবে সব আদিবাসী কিন্তু দেশের রাজনীতির সাথে গা ভাসিয়ে স্রোতের সাথে মিলিয়ে যায়নি। বরং স্রোতের বিপরীতে হেঁটে চলা একদল আদিবাসীর গল্পই শুনাতে চাচ্ছি আপনাদের।
ব্যতিক্রমী মুন্ডারি আদিবাসী, যারা যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও একচুলও ছাড় দেয়নি তাদের গবাদিপশুর সুন্দর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়। দক্ষিণ সুদানের সেন্ট্রাল ইকুয়েটরিয়া অঞ্চলে বসবাস। এদের ধ্যানজ্ঞান পুরোটা জুড়েই শুধু তাদের গৃহপালিত পশু।
মুন্ডারি আদিবাসী
মুন্ডারিদের জন্মস্থান দক্ষিণ সুদানের রাজধানী, জুবার দক্ষিণ পার্শ্বে। কিন্তু তারা এখন সেখানে বসবাস করে না। গৃহযুদ্ধের সময় মুন্ডারি পল্লীতে বসতো জুয়ার আসর। এবং যুদ্ধ পরবর্তীতে তাদের মধ্যে একটি আত্মঘাতী দাঙ্গাও তৈরি হয়; যা তাদের গরুগুলোর জন্য বেশ বিপদজনক ছিল। তাই গরুগুলোর নিরাপত্তা স্বার্থে তারা জুবা ত্যাগ করে ৭৫ কিলোমিটার দূরে নীল নদীর তীরে একটি দ্বীপে আশ্রয় নেয়। যেখানে তাদের জীবন ধারণ করা একটু কষ্টকর হলেও গরুগুলো সুরক্ষিত আছে।
মুন্ডারি আদিবাসী মূলত রাখাল সম্প্রদায়। গরু লালন পালন এদের প্রধান কাজ তো বটেই; তবে একমাত্র কাজ বললেও ভুল হবে না। শান্তিপ্রিয় এই জাতিটি গরুর জন্য জীবন দিতে বা নিতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। তাই তো গৃহপালিত গরুগুলোকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য তারা সবসময় হাতে একটি একে-৪৭ বন্দুক নিয়ে ঘুরে। কেউ গরু চুরি করতে আসলে শেষ রক্ষা নেই তার। তবুও মাঝেমধ্যে হাত ছাড়া হয়ে যায় দুই-একটি গরু।
স্থানীয় প্রভাবশালী দুষ্টচক্র সুযোগ পেলেই সচেতন রাখাল ও বন্দুকের তীক্ষ্ণ গুলি এড়িয়ে চুরি করে নিয়ে যায় গরুগুলোকে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই অপরাধের না আছে কোন শাস্তি, না আছে বিচার। মুন্ডারি সম্প্রদায় এতটাই গরুপ্রেমী যে, গরুর খামারে রাত কাটে মুন্ডারি পুরুষদের। পশুদের থেকে ২ ফুট দূরে বিছানা পাতে তারা। শুধু নিরাপত্তা স্বার্থে যে তারা এমনটা করে, তা না। গরু তাদের জীবনের এতই অবিচ্ছেন্দ্য অংশ ও পরম সঙ্গী যে, পশুদের ডাক ও খচমচ শব্দ ছাড়া তারা ঘুমাতে পারে না।
মুন্ডারিরা ধর্মীয় বিশ্বাসে আধা খ্রিষ্টান, আধা সর্বপ্রাণবাদী (প্রকৃতিধর্মে বিশ্বাসী)। তাই তারা বিশ্বাস করে গরু শুধু তাদের অর্থসম্পদ ও সম্মানই নয়, তাদের সৌভাগ্যেরও প্রতীক। মুন্ডারি পুরুষদের দীক্ষা অর্জনের জন্য একসময় সম্প্রদায় থেকে দূরে গ্রামের বয়স্ক কারো সাথে একা থাকতে হয়। এই সময়টা তারা পুরোপুরি উলঙ্গ হয়ে এবং প্রকৃতির কাছাকাছি থাকে। এই দীক্ষা গ্রহণের সময় তাদের মাথায় ইংরেজি অক্ষর ‘V’ এর মত কয়েকটি দাগ দেওয়া হয় যা তাদের যৌবন লাভের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
দীক্ষা নেওয়ার শেষ পর্যায়ে, তারা নিজ হাতে একটি গরু বলি দেয়; যা তাদেরকে পুরোপুরি সুদক্ষ করে। এভাবে মুন্ডারি পুরুষদের দীক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন হয়। এরা ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে গরু বলি দেয় ঠিকই কিন্তু গরুর মাংস খায় না। মুন্ডারিরা বিশ্বাস করে, গরুর মূত্র তাদের শুদ্ধিকরণে সাহায্য করে।
অদ্ভুত গরুপ্রেমী জাতিটির পুরুষরা তাদের জীবনের পুরোটা সময় রাখাল হয়েই দিন পার করে। আর মহিলাদের সময় কাটে সাংসারিক কাজ, রান্নাবান্না করে। আর মুন্ডারি শিশুদের কাজ হচ্ছে, গরুর গোবর সংগ্রহ করা এবং তা গোল গোল করে শুকানো। এছাড়াও মুন্ডারি শিশুরা অল্প বয়সে আনাড়ি হাতে বন্দুক নিয়ে গরু পাহারা দেওয়ার মত কঠিন কাজটিও করে থাকে। তাই বলে এদেরকে দুর্বল ভাবলে চলবে না। মুন্ডারি জাতি কুস্তি করতে খুব পছন্দ করে। নিয়মিত কুস্তি প্রতিযোগীতার আয়োজনও করা হয়। মুন্ডারিদের অবসর সময় কাটে গানবাজনা ও কুস্তির মধ্য দিয়ে।
শুকনো গোবর রান্নার জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মুন্ডারীরা মনে করে, গরুর মূত্র ও গোবরের ছাই অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করে। তাই তারা গোবরের ছাই গায়ে হাতে মাখে যেন সূর্যের তাপ তাদের ত্বকের ক্ষতি না করে। এই ছাই তারা দাঁতের মাজনি হিসেবেও ব্যবহার করে থাকে। সুস্বাস্থ্যের জন্য মুন্ডারিরা পান করে গরুর মূত্র। এ সম্প্রদায়ের পুরুষরা মাথায় চুল কমলা রঙের করার জন্য গরুর মূত্র দিয়ে মাথা ধুয়ে থাকে।
মুন্ডারি সমাজে গরু অর্থ সম্পদ ও সম্মানের প্রতীক। যার যত বেশি গরু আছে, সে তত বিত্তশালী। এমনকি, এই গোষ্ঠী মেয়ের বিয়েও দেয় গরুর দামের হিসেবে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দক্ষিণ সুদানে বিয়ের জন্য মেয়েদের বেশ আকাল দেখা দেয়। তাই বিয়ের জন্য কনের খোঁজে অনেকেই মুন্ডারিদের শরণাপন্ন হয়। ফলে একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে ধনী মুন্ডারিরা।
যৌতুক নেওয়া ও মেয়ে বেচার মত জঘন্য অপ্রীতিকর কাজ করা শুরু হয়। প্রথমদিকে মুন্ডারি মেয়েদেরকে ২০টি গরুর সমমূল্যের বিনিময়ে বিক্রি করা হয়, পরবর্তীতে বিক্রি করা হয় ৪০টি গরুর মূল্যের বিনিময়ে। শুধু তাই-ই নয়, কাজের বিনিময়ে মুন্ডারি গাইডদেরকে টাকা দেওয়া হলে তারা অখুশি হয় এবং রেগে বলে, ‘একটি গরু কিনে দিলে দাও নইলে লাগবে না তোমার টাকা।’
আনখল-ওয়াতুসি
মুন্ডারি প্রজাতি যে গরু লালন পালন করে তার নাম আনখল-ওয়াতুসি যা বেশ জনপ্রিয় ও মূল্যবান একটি গরু। বিশ্ব বাজারে এর এর দাম ৫০০ মার্কিন ডলার। ৮ ফুট লম্বা দেহী ও বিশালাকার শিং-ওয়ালা এই গরুগুলোকে বলা হয় ‘The cattle of kings’ কেননা এরা অনেক নাজুক হয় থাকে। যত্নের সামান্য ত্রুটির কারণে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে এদের। তাই দিনে দুইবার মালিশ করতে হয় আনখল-ওয়াতুসির দেহ।
মুন্ডারিরা এই মালিশের কাজে গোবরের ছাই টেলকম পাউডারের মত করে ব্যবহার করে; যেন কোন বিষাক্ত পোকামাকড় অবলাদের গায়ে বসে এদের কোন ক্ষতি না করতে পারে। ক্ষতিকর জীবাণু থেকে গবাদিপশুদের রক্ষা করতে নিয়ম করে গোয়ালে ছিটানো হয় এই ছাই। মশার হাত থেকে আদুরে গরুগুলিকে রক্ষা করতে গোয়ালের চারপাশে নান্দনিক উপায়ে জ্বালিয়ে রাখা হয় আগুন।
জীবিকার উৎস সবসময়ই বেশ আদরের এবং অত্যন্ত যত্নের হয় তা আমাদের কারোই অজানা নয়। এবং তা যদি হয়, কোন প্রানী তাহলে আদর-যত্নের মাত্রাটা একটু ভিন্নই হয়। কেননা পশু-পাখি এমনিই মায়া জড়ানোর একটি বস্তু তার উপর সেইটা আপনার জীবিকায় একটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু পশুপ্রেম নজিরবিহীন। ফটোগ্রাফার তারিক যায়িদি দুইবার মুন্ডারিদের অঞ্চলে গিয়ে তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। তিনি বলেন-
“আমি ৩০টির বেশি আফ্রিকান আদিবাসী গ্রামে ঘুরেছি কিন্তু মুন্ডারি রাখালদের জীবনে গবাদিপশুর যে গুরুত্ব তা অবর্ণনীয়। গরুর সাথে এদের সম্পর্ক গভীর ও আত্মিক। পশুরাই তাদের জীবনের সব।“