সবুজ গালিচায় আবৃত এক সমতল চূড়ার পর্বত। শ্বেত পর্বতের অতলে মেঘলোকে যার বিস্তৃতি। চারপাশে ভরে রয়েছে সজীবতা ভরা একখন্ড হারানো পৃথিবী! কিন্তু চূড়া কি কখনো সমতল হয়!
ছোটবেলায় ডায়মন্ড কমিকসের সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র ছিল লি ফকের অমরসৃষ্টি ‘ফ্যান্টম।’ চারশো বছর আগে গভীর জঙ্গলের খুলিগুহায় প্রথম ফ্যান্টমের আবাস, সোনালী তট এবং জেড পাথরে স্ত্রী ডায়ানার আবাস। জঙ্গলের আদিবাসীদের কাছে যিনি চলমান অশরীরী – এক অমর ব্যাক্তি। ফ্যান্টমের ‘নতুন পৃথিবীর সন্ধানে’ সিরিজে ওয়াকার টেবিলের ইতিহাসের ছোঁয়া পায়।
১৪৯৪ সালে ক্রিস্টোফার কলোম্বাসের সাথে নতুন পৃথিবীর সন্ধানে যায় ফ্যান্টম। অভিযাত্রায় গিয়ে ফ্যান্টম আর বন্ধু ক্যারিবো মিলে আবিষ্কার করে এক অদ্ভুত টেবিলের! ওয়াকার টেবিল নামে রুক্ষ সমতলভূমিতে থাকা বিচ্ছিন্ন এক খাড়া পাহাড়। যার চূড়া সমতল এবং যেখানে অজ্ঞাতবাস করে ফ্যান্টম। ফ্যান্টমের স্রষ্টা লি ফকের ওয়াকার টেবিল কিন্তু সত্যিই পৃথিবীতে রয়েছে! বাস্তবের পৃথিবীতে ওয়াকার টেবিলের মতোই এই সমতল চূড়া পর্বতের আদলে আখ্যান গড়েছে মাউন্ট রোরাইমা নামে।
দক্ষিন আমেরিকার টপ-মাউন্টেন বা সমতল চূড়ার এই পর্বতের বয়স প্রায় দুইশ কোটি বছর। অন্যান্য পর্বত থেকে চূড়া শঙ্কু না হয়ে সমতল আকৃতি মাউন্ট রোরাইমাকে অনন্য করে তোলে এই পৃথিবীর বুকে। প্রায় ৩১ কিলোমিটার চূড়ার আয়তনের এই পর্বতের দেয়ালের উচ্চতা প্রায় ১৩০০ ফুট। দুর্গম এই পর্বতটি সারাবছরই মেঘে আবৃত আর ভেজা স্যাতসেতে থাকে। এই পর্বতটি প্রথম মানুষের নজরে আসে ১৫৯৬ সালে। সেই সময়ে এই এলাকাটিতে অভিযান চালানোর সময় স্যার ওয়াল্টার র্যালের নজরে পড়ে এই অদ্ভুত আকৃতির পর্বতটি।
মুলত প্রথমবারের মতো বিশ্বের দরবারে মাউন্ট রোরাইমাকে যখন আবিষ্কার করা হয়, খেয়াল করে দেখা যায় চারদিকে চারশো মিটার লম্বা ক্লিফ দ্বারা বেষ্টিত এই পর্বতমালা। এটি তিনটি দেশকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। দেশগুলো যথাক্রমে – ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল আর গায়ানা। তিনটি দেশের মধ্যে একমাত্র ভেনিজুয়েলার সীমান্ত দিয়েই এই দুর্গম পর্বতে প্রবেশ করা যায়। লাস্যময়ী এই পবর্তটি বছরের বেশিরভাগ সময় ঢেকে থাকে মেঘের সমুদ্রে, বিপুলা পৃথিবীর বুকে এ যেন এক স্বর্গ রাজ্য!
প্রাচীন সভ্যতার চেয়েও সুপ্রাচীন এই পর্বতমালার সমতল চূড়ায় অবস্থান করছে ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল আর গায়ানার সীমান্তের মিলনের মোহনা। স্থানীয় পেমুন ইন্ডিয়ানরা একে টেপুই নামে ডাকে। টেপুই অর্থ দেবতাদের আবাসস্থল। তবে এমন পর্বত গায়ানার উচ্চভূমিতে বিশেষ করে পশ্চিম গায়ানা ও ভেনিজুয়েলাতে দেখতে পাওয়া যায়। তবে দক্ষিন আমেরিকায় এটি হচ্ছে সর্বোচ্চ টেপুই। এই অঞ্চলটি প্রকৃতপক্ষে মালভূমি।
দেবতার আবাসস্থল
স্থানীয় আদিবাসীদের বিশ্বাস মতে, এখানে পাহাড়, অরণ্য আর সিঙ্কহোলে দেবতারা বসত করে। এইজন্যেই এটি টেপুই বা দেবতাদের আবাসস্থল। ইউরোপীয়রা এই এলাকায় আসার আগে থেকেই পর্বতটির ওপরে বাস করত স্থানীয় আদিবাসীরা। স্থানীয় পেমন ইন্ডিয়ানদের দেওয়া নাম ‘রোরাইমা’র ‘রোরাই’ শব্দটির অর্থ নীল-সবুজ আর ‘মা’ অর্থ মহান! অতল সবুজের ভীড়ে শত্রু আর হিংস্র জন্তুর হাত থেকে বাঁচতে মাউন্ট রোরাইমাই ছিল তাদের কাছে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।
মাউন্ট রোরাইমা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯২২০ ফুট উঁচু। ১২ বর্গমাইলের এলাকাজুড়ে বিস্তৃত চূড়াটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে ৪০০ মিটার উচ্চতার পাথুরে পর্বতের দেয়াল। এই পর্বতমালাগুলো বালি দিয়ে গঠিত। এদের গঠন হয়েছিল প্রিক্যাম্বিয়ান যুগে। সেই সময়ে প্রত্যেকটি পর্বত একসাথেই যুক্ত ছিল। কিন্তু মহাদেশগুলো যখন একে অন্যের থেকে দূরে সরে যায় সাথে পর্বতগুলোও বিচ্ছিন্ন হয়। এখানকার এক একটি পর্বতের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বিদ্যমান।
বেশিরভাগ মানুষই ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ নামের সাথে পরিচিত। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল তার এই ক্লাসিক উপন্যাস লেখার অণুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মাউন্ট রোরাইমা দেখেই! বইটিতে উল্লেখ করা পৃথিবী থেকে অনেক দূরে বিচ্ছিন্ন কোনো জায়গায় এখনো জুড়ে আছে ডাইনোসর, টেরোডেক্টাইলেরআর আদিম অধুনালুপ্ত প্রাণীদের কথা। সেই জায়গাটি অবস্থিত মেঘের উপর এবং তা সুস্পষ্টভাবেই তা এই মাউন্ট রোরাইমাকে নির্দেশ করে।
মাংসখেকো ঘন্টাফুল এবং মরণফাঁদ
মাউন্ট রোরাইমার প্রায় ৮৫ শতাংশ অংশ জুড়ে ভেনেজুয়েলার অবস্থান। গায়ানার মধ্যে আছে ১০ শতাংশ এবং ব্রাজিলের মধ্যে আছে ৫ শতাংশ। এই পর্বতের ওপরে থাকা তিনকোণা একটি পিলার রয়েছে। যেটি নির্দিষ্ট করে দেয় সমতল চূড়ার কোন দিকটি কোন দেশের দখলে আছে। এর চূড়ায় থাকা জঙ্গলে বাস করে বিভিন্ন প্রাণী। তবে তার মধ্যে কোনো হিংস্র প্রাণী দেখা যায়নি আজ অব্দি। এসব জঙ্গলে পাওয়া যায় কিছু বিরল উদ্ভিদ।
অবাক হলেও সত্যি যে, এদের মধ্যে আছে মাংসাশী উদ্ভিদও। এই জঙ্গলেই দুর্লভ উদ্ভিদগুলো পাওয়া যায়। দুটি উদ্ভিদের একটি হচ্ছে মাংশাসী উদ্ভিদ হেলিয়াম্ফোরা। এর নলাকার পাতা শিকার ধরার পরে মেরে ফেলার জন্য বিশেষভাবে তৈরি। অন্যটি হচ্ছে চ্যাম্পেননুলা গণের নীলরঙা ঘন্টাফুল। মাউন্ট রোরাইমার অবাক করা এই সমতল চূড়ায় রয়েছে ছোট ছোট পুকুর। এসব পুকুরে আছে মস, ফার্ণ জাতীয় জলজ উদ্ভিদ।
রহস্যময় এই মাউন্ট রোরাইমার কথা প্রথম জানা যায় ইংরেজ কিংবদন্তি অভিযাত্রী স্যার ওয়াল্টার র্যালের মুখে। তিনি প্রথম খুঁজে বের করে রহস্যময় এই অতলে। যদিও স্যার র্যালে তখন আসলে স্বর্ণনগরী ‘এল ডোরাডো’ খুঁজতে তন্নতন্ন করে যাচ্ছিল দক্ষিণ আমেরিকা। তখন গায়ানাতে গিয়ে তিনি এই সমতল পাহাড়ের সন্ধান পান। বহিরাগতদের মধ্যে মাউন্ট রোরাইমায় প্রথম আরোহণ করেন ব্রিটিশ অভিযাত্রী এভরার্ড থুর্ন।
দুঃসাধ্যের ভেতরে প্রবেশ করা প্রথম অভিযাত্রী
১৮৮৪ সালে প্রথম এই দুঃসাধ্য কাজটি করে থুর্ন তাক লাগিয়ে দেয় পৃথিবীর বুকে। কারণ একমাত্র ভেনেজুয়েলার দিক দিয়েই পর্বতটির ওপরে ওঠা সম্ভব। সেই সম্ভবের দুয়ার খুলে দেয় পর্বতের গায়ে প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি কিছু সিঁড়ির ধাপের জন্য। আর ট্রেকারেরা সেই পথেই এগিয়ে যায় চূড়ার দিকে। মাউন্ট রোরাইমাতে সারাবছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রক ক্লাইম্বারেরা আসেন ট্রাকিং করতে। দুর্গম এই পর্বতমালা যেন তাবৎ পৃথিবীর এক রহস্যের ভাণ্ডার।
কেউ যদি মাউন্ট রোরাইমা যেতে চায় তাকে প্রথমেই যেতে হবে ব্রাজিলের ‘রোরাইমা’ স্টেটের রাজধানী বোয়া ভিস্টাতে। সেখান থেকে প্রায় তিন ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে ভেনেজুয়েলার শহর সান্তা এলেনার কাছে থাকা পারাই টেপুই গ্রামে। পারাই টেপুই থেকেই ট্রেকিং রুট সর্পিলভাবে বয়ে যায় মাউন্ট রোরাইমার চূড়ার দিকে। আর ট্রেকিংয়ের জন্য স্থানীয় গাইড পাওয়া যায় পারাই টেপুই গ্রামের পেমন আদিবাসী যুবক। পেমন যুবকের নিখুঁত নিশানায় ভর করে যে কেউ পৌঁছে যায় মেঘের রাজ্যে থাকা মাউন্ট রোরাইমার চূড়ায়। যে পর্বতের চূড়ায় একসময় বাস করতো পেমনদের পূর্বপূরুষেরা।
মাউন্ট রোরাইমার চূড়া থেকে মেঘের সাগরে উঠতে থাকা ঢেউ দেখা যায়। চেনা পৃথিবীর এক বৈচিত্র্যময় রূপ। যদিও কোন নির্দিষ্ট মরসুম নেই ট্রেকিংয়ের জন্য। বছরের যে কোনও সময় যাওয়া যায় রহস্যময় মেঘে ঘেরা মাউন্ট রোরাইমাতে। একদিকে যেমন বৃষ্টি মাউন্ট রোরাইমাতে, অপর দিকেই দেখা দেয় নীল আকাশ। এই জন্যে এখনো অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের কাছে স্বর্গের রূপ মাউন্ট রোরাইমা।
প্যারারাইমা পর্বতশ্রেনীর সবচেয়ে উচ্চতম পাহাড় হলো মাউন্ট রোরাইমা। এটি ভেনেজুয়েলার কানাইমা ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্ভূক্ত। এই পর্বতশ্রেণী ইউনেস্কোর হ্যারিটেজ পার্ক হিসেবে ঘোষিত। বিখ্যাত এ্যাঞ্জেল ফলস এই পার্কের অংশ। এমনকি ডায়নোসরের জীবাশ্মও পাওয়া গিয়েছে মাউন্ট রোরাইমাতে। ভূতাত্ত্বিকভাবে সমৃদ্ধ এই পর্বতটিতে ডায়নোসরের জীবাশ্ম পাওয়ার খবরটি বিজ্ঞানীরাও নিশ্চিত করে।
রহস্যময় এই সমতল চূড়ায় রোরাইমা বুশ টোড নামের বিশেষ প্রজাতির কালো ব্যাঙ পাওয়া যায়। পর্বতের চূড়ার পানি নিচে গড়িয়ে বিশাল জলপ্রপাত তৈরি করে যেটি প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপের রূপ ধারণ করে। আর সেজন্য উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও প্রাণীবিজ্ঞানীদের জন্য মাউন্ট রোরাইমা অতি মূল্যবান এক আবিষ্কারের উৎস।
বাস্তবের প্যারাডাইস ফলস
২০০৯ সালে পিক্সার ফিল্মের ‘আপ’ এর দুটি চরিত্র বিরাট শহর ছেড়ে দেখতে যায় দক্ষিন আমেরিকার মেঘে ভাসা কোনো এক প্যারাডাইস ফলস নামের মালভূমি। মাউন্ট রোরাইমার অনুকরণে ছবিতে ভেসে উঠে প্যারাডাইস ফলস!
শুধু কি সিনেপ্লেক্সের পর্দা, মাউন্ট রোরাইমাকে নিয়ে ডকুমেন্টসও হাজির হয় ২০১৩ সালে। দীর্ঘ পাহাড় চড়ার অভিজ্ঞতায় ভরপুর কার্ট আলবার্ট, হলগার হেউবার এবং স্টেফেন গ্লোএজ নিজেরাও জানত না কী বিশাল রহস্যের ভাণ্ডারে তারা হারিয়ে গিয়েছিল।
বেশকিছু বছর আগে ইতালিয়ান একটি টিম মাউন্ট রোরাইমা নিয়ে কিছু ভূতাত্ত্বিক জরিপ সামনে আনে। ডেভিট নেইল্ডের মতে,
কোয়ার্টজের ভেতরের বেলেপাথরের গুহাগুলো তৈরি হতে লক্ষ লক্ষ বছর লেগেছে।
এই দলটি খনিজ এবং অনন্য প্রজাতির প্রাণী আবিষ্কার করে যা এর আগে কেউ আশাও করেনি। গুহাগুলি অণুজীব দ্বারা আবৃত অদ্ভুত আকৃতির স্পিলিওথেম (স্ট্যালাকটাইট এবং স্ট্যালাগমাইট) দিয়ে ভরা। যদিও দলটি এখনো জরিপের সম্পুর্ণ তথ্য দিতে পারেনি হারানো পৃথিবীর এই ভূ-স্বর্গ নিয়ে।
শীতের সকালের ম্লান রোদের মতই চিলতে মেঘের ভীড়ে বিশ্বের এক অজানা ফ্যান্টাসির নাম মাউন্ট রোরাইমা। যে নিজের অতল সৌন্দর্যের ভারে প্রতিবছর অভিযাত্রীদের মুগ্ধ করে দেয় নিজস্ব স্বয়ংম্ভরতা নিয়ে।
Feature Image: Historyofyesterday.com.
তথ্যসূত্র:
01. Mount Roraima.
02. Mount Roraima Venezuela-Hiking Guide.
03. Mount Roraima is one of the oldest formations on Earth dating back to some two billion years ago.
04. Mount Roraima-The Oldest Geological Formations on Earth.
05. Welcome to Mount Roraima: The ‘Floating Island’ Plateau.
নতুন নতুন তথ্য নিয়ে আবারো ফিরে আসা লাবণ্যর প্রতিটা তথ্যবহুল জানা অজানার গল্পের প্রতীক্ষায় দিন গুনি আমি l এ যেন এক অজানা আকর্ষণ l চেনা জানা ছোট্ট মেয়েটি এক অদ্ভুত জাদুর কাঠিতে প্রতিবার ই রূপ দেয় পৃথিবীর সব নৈস্বর্গের দৃশ্য l শুভ কামনা লেখকের উদ্দেশ্যে ll
এক অনির্বচনীয় অনুভূতিতে ভরে গেল হৃদয়। ছোট বেলার বেতালের ওয়াকার টেবিল যেন ছুঁতে পারলাম।। মেঘের ওপারে এক স্বগরাজ্যে ঘুরিয়ে আনবার জন্য লেখিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।।
অনির্বচনীয় এক অনুভূতি তে ভরে গেল হৃদয়।। ছোট বেলার সেই বেতালের ওয়াকার টেবিলে ঘুরে আসলাম মনে হলো।। মেঘের উপরে একটুকরো সবুজ দেশে ঘুরিয়ে আনবার জন্য লেখিকাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।।
ফিচার পড়তে পড়তে সত্যি মনে হচ্ছিলো মেঘের দেশের মাউন্ট রোরাইমাতে চলে গেলাম। আদিবাসী পেমন ইন্ডিয়ান থেকে সব কিছু চোখের সামনে ভাসছে। মাউন্ট রোরাইমা সম্পর্কে আগে কখনো শুনিনি এই প্রথম পড়লাম। দারুণ লাগলো।
মেঘেদের দেশের ছোঁয়া নিতে ছুটে যেতে মন চাচ্ছে শুধু।