প্রত্যেকটি দেশের নিরাপত্তার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে বর্তমান ভূরাজনৈতিক জটিলতা সামলানোর জন্য এসব নিরাপত্তা সংস্থা কর্তৃক দেওয়া তথ্য কূটনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এর পাশাপাশি দেশের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য এসব সিক্রেট মিলিটারি এজেন্সি প্রত্যেকটা মুহূর্তেই কাজ করে চলেছে। আমেরিকার সিআইএ কিংবা ভারতের “র” প্রত্যেকটি স্পাই এজেন্সি তাদের দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমস্যা নিয়ে কাজ করছে।
উক্ত দেশগুলোর মতো সম্পূর্ণ পৃথিবীতেই এই ধরণের নিরাপত্তা এজেন্সি আছে। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এসব দেশসমূহের শত্রুভাবাপন্ন অনেক রাষ্ট্র থাকলেও বন্ধু রাষ্ট্রের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাই বলা যায় এদের সবার কাজই প্রায় একই।
কিন্ত এমন একটি দেশ যার জন্মের পর বেশিরভাগ রাষ্ট্রই তাদের স্বীকৃতি দেয়নি, সেই ধরণের রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থা কেমন হওয়া উচিত তা ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থা “মোসাদ” এর দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই।
মোসাদ এমন এক মিলিটারি এজেন্সি, যারা আমেরিকার সিআইএ কিংবা ব্রিটেনের আমআইসিক্স- কেও কৌশল,দুধর্ষতা এবং স্পাই লিমিট সব দিক থেকেই হারিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে।
আজকের আলোচনা বিশ্বের সেরা মিলিটারি এজেন্সিকে নিয়ে যারা স্নায়ুযুদ্ধের সময় বিশ্বের সব বড় বড় সিক্রেট এজেন্সির থেকে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল।
দুনিয়ার অন্যতম বিতর্কিত ও ছোট দেশ ইসরায়েলের মোসাদ পৃথিবীর সব রহস্যময় অপারেশনের জন্য বিখ্যাত। বলা হয়- “মোসাদের নিশানায় যে পড়ে, তার বেঁচে ফেরা অসম্ভব।“ তো কিভাবে হলো মোসাদের জন্ম? এর উত্তর পেতে হলে ইতিহাসের পাতায় চোখ দিতে হবে।
অনেক আগের থেকেই ইহুদি সম্প্রদায় তাদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনের ইচ্ছা ও দাবী পোষণ করে আসছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসী বাহিনী যখন লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করলো তখন থেকে এই ইচ্ছা বাস্তবে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনের ভূমিতে ব্রিটিশদের সহায়তায় ইসরায়েল তাদের ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।
প্রথমত এই জায়গা দখল ছিল অনৈতিক। দ্বিতীয়ত ইসরায়েলের আশেপাশে সব ছিল আরব রাষ্ট্র। তাই স্বাভাবিকভাবেই ইসরায়েলের নিরাপত্তা অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে আরো বেশি শংকার মধ্যে ছিল। শুধুমাত্র নিরাপত্তা নয়, প্রতিটি মুহূর্তেই এর সার্বভৌমত্বও শঙ্কটের মধ্যে ছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সিনিয়র কমান্ডার রোভেন শিলোহা (Reuven Shiloha) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেনকে মোসাদের পরিকল্পনার কথা জানান।
দেশের নিরাপত্তা বিধানে কয়েক মাসের মধ্যে অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বর ১৯৪৯ সালেই প্রধানমন্ত্রী ডেভিড মোসাদের প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও তখন এর নাম ছিল “সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউশন ফর কো অর্ডিনেশন”। পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে এর নাম পরিবর্তন করে “মোসাদ” রাখা হয়।
কিন্ত কেনই বা রোভেন শিলোহার মোসাদ প্রতিষ্ঠার এই চিন্তা আসলো? এর উত্তরে বলা যায় যে, মোসাদ এমন এক গোয়েন্দা সংস্থা যার জন্ম বলতে গেলে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্বেই হয়ে গিয়েছিল।
অবাক লাগছে? খুলে বলি- হিটলার বাহিনী যখন একের পর এক ইহুদি সম্প্রদায়কে আক্রমণ ও হত্যা করতে লাগলো তখন ১৯৩০ সালের শেষের দিকে নাৎসী বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে ইহুদিরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নিজস্ব সৈনিক সংগঠন তৈরি করে। আর ঐসব সৈনিক সংগঠনেরই নিজেদের গোয়েন্দা বিভাগ ছিল।
এমন একটি সৈনিক সংগঠন ছিল হাজানাহ (Haganah)। তাদের গোয়েন্দা বিভাগটির নাম ছিল সাহী বা সাঁই (Shai)। এটি ১৯৪০ সালে প্রতিষ্ঠা হয়। রোভেন শিলোহা এর অন্যতম সদস্য ছিলেন।
আর মোসাদ যখন প্রতিষ্ঠার সময়, প্রায় সবাই তখনকার সাঁই গ্রুপের অন্তর্গত ছিল। তাই বলা চলে যে মোসাদের প্রতিষ্ঠায় ইসরায়েল পূর্ব সৈনিক সংগঠনের ভূমিকা অনেক।
উল্লেখ্য, রোভেন শিলোহা ছিলেন মোসাদের প্রথম ডিরেক্টর। ১৯৫২ সালে তিনি অবসর নেওয়ার পর থেকে অর্থাৎ ইসার হারেল (Isser Harel) এর নেতৃত্বেই মোসাদ তার জাল বিস্তার করে দুনিয়ার সর্বসেরা গোয়েন্দা সংস্থায় রুপ নিতে শুরু করে।
মোসাদ কিভাবে কাজ করে? এর সদস্যদের মূল কাজ বা কি? এ নিয়ে অনেক প্রশ্নই উঠে আসে। তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে ইসরায়েলের আইনে মোসাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, তাদের শক্তি কিংবা বাজেট কিছু সম্পর্কেই সরাসরি কিছু উল্লেখ নেই।
ইসরায়েলের অন্যান্য দুটি সংস্থা তথা “আমান” এবং “শিন বেট” নিয়ে মানুষ অনেক কিছু জানলেও মোসাদের নির্দিষ্ট তথ্য তেমন একটা পাওয়া যায় না।
কিন্ত বিভিন্ন বিশ্লেষণ, গবেষণা ও কিছু তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে মোসাদ দেশের শত্রুদের বিনাশ করতে এবং তাদের হত্যার মাধ্যমে যেন অন্যান্যরা পিছপা হয় তা নিয়ে কাজ করে। যেহেতু তাদের নির্দিষ্ট কোন উদ্দেশ্য কিংবা সীমাবদ্ধতা নেই তাই তারা তাদের মিশন সম্পন্ন করতে যেকোন পর্যায়ে যেতে সক্ষম যা আমরা অনেক অপারেশনেই দেখতে পাই।
রাজধানী তেল আবিবে থাকা সদর দপ্তর থাকা এই গোয়েন্দা সংস্থার আটটি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। যার মধ্যে তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
কালেকশন ডিভিশন
এদের অফিসাররা অন্যান্য দেশের সাথে কূটনীতিবিদ কিংবা গোয়েন্দা হয়ে তাদের লক্ষ্যের বাস্তবায়ন করে। বলা হয় এখানে ৩০ থেকে ৪০ জোন অফিসার নিযুক্ত।
স্পেশাল অপারেশন ডিভিশন
এই বিভাগকে মেটসাডাও বলা হয়। বড় স্পর্শকাতর অপারেশনে আক্রমণ, ধবংস ও হত্যার কাজে এরা নিয়োজিত।
একশান পলিটিকাল অফ লিয়াসন ডিপার্টমেন্ট
এটি বন্ধুরাষ্ট্রদের সাথে কূটনৈতিক ও সামরিক দিক গুলো নিয়ে কাজ করে।
এছাড়াও লোয়ামাহ সাইকোলজিস্ট ডিপার্টপমেন্ট, রিসার্চ ও টেকনিক্যাল ইউনিট মোসাদের মিশনগুলো বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিখ্যাত অপারেশন
বলা হয় মোসাদ তাদের ৭৩ বছরের ইতিহাসে দুইহাজার সাতশতেরও বেশি গুপ্ত অপারেশন পরিচালনা করেছে। রোনেন বার্গম্যান তার রাইজ এন্ড কিল ফার্স্ট বইয়ে বলেন-
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মোসাদ অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের চেয়ে
বেশি হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
অপারেশন থান্ডারবোল্ট
মূলত এই অপারেশনের মাধ্যমে বিশ্ববাসী মোসাদের ক্ষমতা সম্পর্কে অবগত হয়। ১৯৭৬ সালে ফ্রান্স থেকে গ্রিসগামী একটি বিমান ফিলিস্তিনের “পপুলার ফ্রন্ট ফর দি লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন” নামক দল হাইজ্যাক করলে তারা সেই বিমানে থাকা ৯৪ জন ইসরায়েলীকে উগান্ডায় নিয়ে যায়। হাইজ্যাকাররা তাদের কিছু সদস্যের বিনিময়ে সেই ৯৪ জনকে ছাড়ার শর্ত দিলেও ইসরায়েল কোন আলাপ আলোচনায় না বসেই উগান্ডাতে তাদের অপারেশন চালিয়ে মাত্র ৯০ মিনিটেই হাইজ্যাক বিমান উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে নেয়।
এর পর থেকেই সবাই বুঝে যায় যে মোসাদের কর্মকান্ড শুধুমাত্র আরব কিংবা পশ্চিমেই নয়। তারা যেকোন দেশেই তাদের অপারেশন চালাতে পারদর্শী।
র্যাথ অফ গড
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর গ্রুপ দ্বারা মিউনিখে ইসরায়েলি এথলিটদের হত্যার যেই ঘটনা সেটা মিউনিখ ম্যাসাকার নামে পরিচিত। উক্ত হত্যাযজ্ঞে সরাসরি সবাইকে মোসাদ ধরতে না পারলেও জানা যায় প্রায় ২০ বছর ধরে তারা ঐ গ্রুপের সবাইকে বিভিন্ন দেশ থেকে খুজে বের করে হত্যা করে।
ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম
অতি সম্প্রতি একটি হামলা হচ্ছে ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামের জনক মোহসেন ফাকরিজাদেহকে স্বয়ং তেহরানে হত্যা করা। বলা হচ্ছে এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ইসরায়েল, ইরানের সম্পূর্ণ নিউক্লিয়ার প্রোগ্রামকে বন্ধের অবস্থা করে দিয়েছিল। ২০২০ সালে করা এই আক্রমণে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাথে সুপার উইপন ব্যবহার হয়েছিল বলে জানা যায়। যদিও এর দায় মোসার স্বীকার করে নি। তবে বিবিসির অনুসন্ধানী রিপোর্টে উক্ত টেকনোলজির ব্যবহার মোসাদকেই নির্দেশ করে। এছাড়াও ইরানের কাশেম সোলেমানি হত্যাতেও আমেরিকার সাথে সাথে মোসাদের হাত রয়েছে বলে জানা যায়।
এর পাশাপাশি নাৎসী যুদ্ধপরাধী এডলফ আইচম্যানকে আর্জেন্টিনা থেকে তুলে এনে বিচারের সম্মুখীন করা ও বুচার অফ লাটভিয়া খ্যাত “সুকুরস” যিনি কিনা যার উপর ৩০ হাজার ইহুদি হত্যার দায় ছিল তাকেও মোসাদ হত্যা করে।
মোসাদের এসব অপারেশনগুলো দেশের নিরাপত্তার নামে কতটা যুক্তি সংগত তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এছাড়াও মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও মোসাদ তার পরোয়া করছে না। তবে এটি বলা যায় যে, গোয়েন্দা জগতে মোসাদ যেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
Feature Image: Daily Sabah References: 01. Inside Mossad: Israel's Elite Spy Agency. 02. Mossad carries out assassinations. 03. Mossad. 04. Soleimani killing. 05. Mossad hunted the ‘Butcher of Riga,’.