ইন্সটাগ্রামের হ্যাশট্যাগ থেকে শুরু করে জনপ্রিয় সাইটের আর্টিকেল; কখনোবা ইউটিউবের ভিডিও থাম্বনেইল বা ফেইসবুকে কারো পোস্ট করা পেইন্টিং-এর ক্যাপশন; নানা জায়গায় আজকাল খুঁজে পাওয়া যায় এই মিনিমালিজম শব্দটি।
তো সেটা কি হালের ট্রেন্ড না সত্যি এর কোন ভিত্তি আছে? মিনিমালিজম কি আসলেই চেখে দেখার মতো জীবনবোধ না বন্ধুদের আড্ডায় নিজেকে একটু আপডেটেড প্রমাণ করার জন্য জেনে রাখা শব্দ?
এই সবকিছুর উত্তর খুঁজতেই আজকের আলোচ্য বিষয় মিনিমালিজম, এর ইতিহাস, সুবিধা, চ্যালেঞ্জ এবং আগ্রহীদের জন্য এই লাইফস্টাইল প্র্যাকটিস শুরু করবার কিছু ছোট্ট টিপস।
ইতিহাস ও বিস্তার
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পশ্চিমা বিশ্বের আর্ট জগতে মিনিমালিজমের চর্চা শুরু হয়। তৎকালীন বিরাজমান আর্টের ধরণকে নতুন আর্টিস্টরা বেশ কেতাবি আর একঘেয়ে বলে মনে করতে শুরু করেন। এই চিন্তা থেকেই তারা একের পর এক মিনিমাল আর্ট পিস সৃষ্টি করতে থাকেন। স্বল্প আয়োজনে বিস্তর বার্তা থাকতো এইসব শিল্পকর্মে। ধীরে ধীরে শিল্প থেকে এই মিনিমালিজম কনসেপ্ট আসতে শুরু করে- ইন্টেরিয়র, আর্কিটেকচার, ফ্যাশন, রান্না, কেনাকাটার অভ্যাস-প্রায় সব সেক্টরেই।
মিনিমালিজম-এই ছোট্ট শব্দটি আদতে বিশাল এক জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র তা হোক খাদ্যাভ্যাস, ঘর সাজানোর ধরণ, পোশাক পরিচ্ছদ, কেনাকাটার স্টাইল এমনকি হাতের ফোন ব্যবহারের অভ্যাস, সবখানেই এই ছোট্ট শব্দের গভীর জীবনবোধ জায়গা করে নিতে পারে। এখন প্রশ্ন হতে পারে মিনিমামভাবে এই মিনিমাল লাইফস্টাইলের ব্যাখ্যা কি?
এক লাইনে এই লাইফস্টাইল মিনিমাম যেকোনো কিছু থেকে তার ম্যাক্সিমাম ব্যবহার কিংবা ফল লাভ নিশ্চিত করা। তাই ইংরেজিতে এই কন্সেপ্ট নিয়ে বহুল প্রচলিত একটি লাইন হলো Less is More. যার অর্থ দাঁড়ায়, কমই শ্রেয়।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, খাদ্যাভ্যাসে মিনিমালিজম ধারণাটি প্রয়োগ করতে চাইলে প্রথমেই দেখতে হবে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ পেতে কি কি খাবার কি পরিমাণে খেলে তা একজন মানুষের জন্য তা যথেষ্ট। দেখা যাবে তাতে কোন অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর আইটেম ছাড়াই বাজারের লিস্ট আর রান্নার আইটেম দুইই স্থির হবে।
একইভাবে অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ডিক্লাটার করা, অব্যবহৃত পোশাক ঘরে না জমানো, এমনকি পরিবারকে সময় দেবার সময় ফোনের দিকে না তাকানোও ডিজিটাল মিনিমালিজমের ভিতর পড়ে।
মিনিমাল লাইফস্টাইলের সুবিধা
অবাক হবার মতো বিষয় হলো এই জীবনধারার সুবিধাগুলো যে শুধুই সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করার মতো তা কিন্তু নয়। বরং বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণিত যে, এই লাইফস্টাইল ইতিবাচক। যা সত্যিই জীবনে নানা ভালো দিক যোগ করে এবং একইসাথে নানা ক্ষতিকর বিষয়কে অজান্তেই দূরে পাঠায়। এর অসংখ্য সুবিধার মধ্যে কিছু এখানে উল্ল্যেখ করা হলো:
১. প্রথমত এই লাইফস্টাইল গ্রহণ করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করা যায়। এতে শুরুতেই হাতে কিছু ক্যাশ আসে।
২. চাইলে বিক্রির বদলে অপ্রয়োজনীয় জিনিস দান করে মানসিক শান্তি অর্জনও সম্ভব হয়।
৩. চারপাশে কম অথচ শুধু প্রয়োজনীয় জিনিসই থাকার কারণে মানুষ মানসিকভাবে হালকাবোধ করে যা যেকোনো কাজে মনোযোগ বাড়ায় ও অন্যমনস্ক হবার আশংকা কমায়।
৪. বাড়ি, গাড়ি, কর্মক্ষেত্র যেকোনো জায়গায় মিনিমালিজমের চর্চা বজায় রাখলে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে কম সময় ব্যয় হয়।
৫. যেকোনো জিনিস খুঁজে পেতে কম বেগ পেতে হয়।
৬. এই লাইফস্টাইল মেইনটেইন করা মানুষ সবসময় গোছালো ও প্রেজেন্টেবল একটি অবস্থায় থাকে।
৭. বিজ্ঞান তো বলে এই মিনিমালিজম লাইফস্টাইলের ফলস্বরুপ মানুষের ড্রাইভিং পর্যন্ত আরো ফোকাসড হয় যা অ্যাক্সিডেন্টের আশংকা কমায়।
৮. রান্না, ঘর গুছানো, কাপড় বা ফ্যাশন আইটেম কিনতে ও যত্ন করতে কম সময় ব্যয় হয় তাই হাতে ফ্রি সময় থাকে।
৯. একজন মিনিমালিস্টিক অভিভাবক তার সন্তান বা আদরের পোষা প্রাণিটিকে নিয়ে কম দুশ্চিন্তায় ভোগেন কারণ ঘরে জিনিস কম থাকা মানে এদের আঘাত পাবার চান্সও কমে যায়।
১০. এই লাইফস্টাইল ঘর, অফিস বা যেকোনো স্থানে স্পেস তৈরি করে সবার স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা ও কাজের গতি বৃদ্ধি করে।
১১. ভ্রমণপ্রেমীরা দ্রুত পরবর্তী গন্তব্যের জন্য তৈরি হতে পারেন এবং অনেক কম জিনিস ঘরে সামলে বের হতে সক্ষম হোন।
১২. ঘর সাজানো, পোশাক, খাদ্য বা যেকোনো ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত খরচ হয় না বলে মিনিমালিজম ধীরে ধীরে ভালো সেভিংসের দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম।
১৩. একটি জিনিসের বিভিন্ন রকম ব্যবহার খুঁজে বের করা এবং সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার অভ্যাস তৈরিতে সাহায্য করে। তাই মানসিকভাবে এক ধরণের পরিপূর্ণতার অনুভূতি তৈরি হয়।
১৪. মানুষ জীবনের প্রতিটি জিনিসকে আরো অনেক বেশি মূল্য দিতে শিখে।
আর শুধু কি ম্যাটেরিয়ালিস্টিক জিনিস নিয়েই এই লাইফস্টাইলের কারবার? না! চিন্তাভাবনা বা অভ্যাসের জগতেও এর আনাগোনা। এই খাবার টেবিলে বা পরিবার কিংবা বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর সময় বারবার কারণে অকারণে ফোনের স্ক্রিনে তাকাচ্ছেন, গল্প বা আড্ডার সময়ও চোখ চলে যাচ্ছে ল্যাপটপের দিকে, এই ক্ষতিকর আর অপ্রয়োজনীয় অভ্যাসগুলোকে জীবন থেকে ছেটে ফেলাও কিন্তু এই মিনিমালিস্টিক জীবনের অংশ।
আধুনিক যুগে এর নাম দেয়া হয়েছে ডিজিটাল মিনিমালিজম। আর হ্যাঁ, এতগুলো ভালো দিক যে লাইফস্টাইলের তার কি কোনোই চ্যালেঞ্জিং দিক নেই? আছে, অবশ্যই আছে।
মিনিমালিজম চর্চার কমন কিছু সমস্যা
১. প্রথম সমস্যা হলো শুরুর দিকে এই মিনিমাম আয়োজনে জীবন চালানো বেশ কঠিন হয় এবং কিভাবে শুরু করা হবে সেই প্ল্যান ঠিক করতে বেগ পেতে হয়।
২. চারদিকে যখন শুধুই নানা রঙের, নানা ঢঙের পণ্য কিংবা আয়োজনের ছড়াছড়ি, সেখানে নিজেকে কিছুটা দলছুট আর একাকীও লাগতে পারে।
৩. অনেকের মনে হয় যে, ঠিক যতখানি মিনিমালিস্টিক হওয়া উচিৎ বা হবার ইচ্ছা ছিল তা হয়তো হয়ে উঠা হলো না। এতে হতাশা জন্মায়।
৪. সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং পয়েন্ট হলো যদি এই যাত্রা শুরু করে কারো যদি মনে হতে থাকে যে এসব খুবই অর্থহীন।
তবে এর থেকে পরিত্রাণ পাবারও কিছু উপায় আছে। প্রথমত, মনে রাখতে হবে যে মিনিমালিজম কোনো কঠোর জীবনব্যবস্থা না যে শুরু করলে একবারেই সব আয়ত্তে আনতে হবে। তাই নিজেকে এই ব্যাপারে চাপ দেয়া যাবে না। বরং আস্তে আস্তে নিজের কমফোর্ট জোনের তেতর থেকে এই লাইফস্টাইল আত্মস্থ করতে হবে।
নিজেকে এই কম্যুনিটির মানুষের সাথে মেশার সুযোগ করে দিতে হবে যাতে নিত্যনতুন জিনিস শেখা ও একাকী বোধ দূর করা যায়। সাথে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, মিনিমালিস্ট হলেও সব ধরণের মানুষের সাথেই মেলামেশা করা ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির জন্য ভীষণ জরুরি।
যে কাজটি কখনো করা যাবে না তা হলো নিজেকে কখনোই আরেকজন মিনিমালিস্টের সাথে তুলনা করা যাবে না। এতে করে মানসিক চাপ বাড়বে; যা মিনিমালিজমের সৌন্দর্যকে নষ্ট করে।
মিনিমালিজম দুনিয়ার সদস্য হতে দরকারি কিছু টিপস
সত্যি বলতে এর কোনো লিখিত নিয়ম নেই। নিজের মতো করেই শুরু করা যায়। খুব ছোট ছোট স্টেপ নিয়ে শুরু হতে পারে এই যাত্রা। মানিব্যাগ বা পার্স থেকে অপ্রয়োজনীয় কাগজ ফেলে দেয়া, টাকার নোটগুলো একটু গুছিয়ে রাখা, এই দিয়েই শুরু হতে পারে।
কিংবা অফিসের বা বাসার রান্নাঘরের কোনো ড্রয়ার বা তাক থেকে অব্যবহৃত জিনিস ফেলে দেয়া, যা না হলেও চলবে তা ডিক্লাটার করা, এক জিনিসে একাধিক কাজ হবে এমন জিনিস ব্যবহার করা, এভাবেও শুরু হতে পারে।
আর এই ক্ষেত্রেও একটি মজার প্র্যাকটিস আছে যাকে বলা হয় মিনিমালিজমের ১-২-৩। যেকোনো জিনিস দেখে ভাবতে হবে এটি ব্যবহার হচ্ছে কিনা, এটি কোনোভাবে প্রয়োজন কিনা অথবা জিনিসটি একান্ত ভালোবাসার কিনা। যদি এর কোনটি না হয় তবে তা বিক্রি করা বা দান করার মাধ্যমে মিনিমালিজমের পথে শুরু হতে পারে যে কারো শুভযাত্রা!
Feature Image: unsplash.com References: 01. Becoming a Minimalist. 02. How to Become a Minimalist. 03. Pros and Cons of Minimalism. 04. Benefits of Minimalism. 05. The Top 15 Minimalist Influencers You Should Know.