শিল্প, সংস্কৃতি আর সম্পদের নগরী মিলান ইতালির উত্তরে অবস্থিত একটি শহর। ইতালির দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরটির জনসংখ্যা ১.৩ মিলিয়ন। সংস্কৃতি আর ফ্যাশনে সু-উচ্চ অবস্থানের জন্য মিলানকে বলা হয় ‘ফ্যাশনের রাজধানী’। এই শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনা জানান দেয় মিলানের শিকড় বহুদূর।
শুধুমাত্র ইতিহাস, ঐতিহ্য বা শিল্পকলা নয়, সম্পদের দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই শহরটি। অর্থনৈতিকভাবেও মিলান বেশ শক্তিশালী বলা চলে৷ দেশ-বিদেশের শিল্পপতিরা মিলানকে বেছে নিয়েছে বিনিয়োগের কেন্দ্র হিসেবে। যদিও মিলানের ইতিহাস বলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির পক্ষ নেওয়ায় মিত্রবাহিনী দ্বারা ধ্বংসের স্বীকার হয় শহরটি। তবে বিশ্বযুদ্ধের পর মিলানকে পুনরায় নতুনরূপে পুনরায় গড়ে তোলার কাজ খুব তাড়াতাড়িই শুরু হয়ে যায়, তার ই হাত ধরে আজকের মিলান।
মিলানের ইতিহাস, শিল্প ও সংস্কৃতি
ধারনা করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দে পত্তন ঘটে এই শহরের। তারও ২০০ বছর পর রোমানরা দখল করে এবং রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করে। দীর্ঘ ৫০০ বছর ধরে দাপটের সাথে বয়ে চলা এই সাম্রাজ্য শেষ হয় বাইজেন্টাইনদের ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে৷ ইতিহাসের পাতা থেকে চলে যায় আরও ৮০০ বছর।
পরবর্তীতে হাত বদলে মিলানের ক্ষমতা চলে আসে ইতালির সরকারের কাছে। সময়ের আবর্তনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী শাসন করলেও মিলানের অগ্রযাত্রা ব্যহত হয়নি কোনোদিনও। পরবর্তীতে রেনেঁসার শিল্পবিপ্লবে সব কিছুর নতুন জাগরণ অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা কোনো কিছুই যেনো ম্লান করতে পারেই এই শহরের গাম্ভীর্য আর সৌন্দর্যকে।
শুধুমাত্র বর্তমানে না, মিলানের গুরুত্বপূর্ণ ছিলো পূর্বের যে কোনো সময়। একই সাথে সম্পদ এবং শিল্পের নগরী হওয়ায় মিলানের গৌরব যেনো একটু বেশিই। বিভিন্ন সময়ের বিখ্যাত শিল্পীদের মিলনমেলা হয়ে উঠেছে এই নগরী। সেসব দর্শনীয় স্থান, ইতিহাস বিখ্যাত গীর্জা, ভবন এবং স্মৃতিস্তম্ভগুলির এক একটি যেনো নিজ নিজ সময়কালকে প্রতিনিধিত্ব করে।
রেনেসাঁর আতুঁরঘর খ্যাত ইতালির শহর মিলান হওয়ায়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া নবজাগরণের সুবাতাস আবশ্যকীয় ভাবেই বিখ্যাত এই শহরকে ছুঁয়ে যায়। পরিবর্তমান আসে শিল্পীদের মনজগতে, তারই প্রভাব পড়ে শিল্পকলায়। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি এবং তাঁর আঁকা বিখ্যাত শিল্প ‘দ্যা লাস্ট সাপার’ এখনো আছে মিলানের জাদুঘরে।
ফ্যাশনের নগরী মিলান
প্রচলিত আছে, ইতালীয়রা বাঁচে স্টাইলের সাথে, এবং মৃত্যুটাও স্টাইলের সাথেই হয়। প্রচলিত এই কথাটির মূল কারণ ফ্যাশনের প্রতি ইতালিয়ানদের কাজ করে আলাদা রকম আবেগ। আর একারনেই তো বিশ্ব বিখ্যাত সব ব্রান্ডের জন্ম এবং সমন্বয় ঘটেছে মিলানে।
‘আরমানি’, ‘ডোলচি এবন্ড গাবানা’, ‘প্রাডা’ ‘এত্রো’, ‘ভ্যালেন্টিনো’ এর মতন জনপ্রিয় আর নামি-দামি আরো অনেক ব্রান্ডের সব কালেকশন দেখা মেলে এখানে৷ শুধু তাই নয়, এসব ব্রান্ডরা তাদের পোশাক প্রদর্শনীর জন্য বেছে নেয়, ‘মিলান ফ্যাশন উইক’ ইভেন্ট কে, যেটি সারা পৃথিবীতে অতি জনপ্রিয় পোশাক প্রদর্শনীর অনুষ্ঠান।
জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে জানুয়ারিতে মেয়েদের পোশাক আর ফেব্রুয়ারিতে ছেলেদের পোশক প্রদর্শন করা হয়। ফ্যাশন সচেতন হওয়ার দরুন নিজেদের উপার্জনের সিংহভাগ খরচ করে পোশাক-আশাক ক্রয়ের পেছনে।
মিলানিস্টদের আচার-অনুষ্ঠান এবং খাদ্যাভ্যাস
মিলানিয়দের অধিকাংশ রোমান ক্যাথলিক মতাদর্শের অনুসারি এবং ইতালিয়ান ভাষায় কথা বলে থাকেন। মিলানে বসবাসকারীদের বলা হয়ে থাকে ‘মিলানিস্ট’। শুধুমাত্র শিল্প, ঐতিহ্য আর স্থাপত্য শিল্পে মিলান ভরপুর তা নয়, খাবার-দাবারেও এই শহরের রয়েছে নিজস্বতা।
ইতালির অনেক বিখ্যাত খাবারের জন্মই হয়েছে এখানে। বিভিন্ন ধরনের উৎসব আর উৎসব কেন্দ্রিক হৈ-হুল্লোড়েও পিছিয়ে নেই মিলানিস্টরা। এম্ব্রোছিয়ানো কার্নিভাল তেমন ই এক উৎসব।
নিজেদের জাতিগত স্বত্বা, ঐতিহ্য তুলে ধরা হয় এই দিনে। মিলানিস্টদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক মিলোখিনো এই দিনে সকলকে পরতে দেখা যায়।
এছাড়াও মিলানে হওয়া ‘মিলান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ এ বিশ্বের সেরা সেরা প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর জন্য সকলের কাছে জনপ্রিয়। এই অনুষ্ঠানে দেখা মেলে বিখ্যাত সব পরিচালক আর অভিনেতা, অভিনেত্রীদের।
ফুটবল প্রেমীদের আবেগের নাম মিলান
ফুটবল প্রেমীদের কাছে শুধুমাত্র বিশ্বকাপ নয়, সারা বছর হওয়া বিভিন্ন ক্লাবের খেলাও সমান ভাবে জনপ্রিয়। তেমন-ই দু ক্লাব এসি মিলান আর ইন্টার মিলান।
জনপ্রিয় আর ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাব দুটি শুধু মিলানিয়দের কাছে জনপ্রিয় আর আবেগের নাম নয়, বিশ্বব্যাপি ফুটবল ফ্যানদের কাছেও সমান ভাবে পরিচিত। ব্রাজিলের কিংবদন্তি রিকার্ডো কাকা ও কিন্তু একসময় এ.সি মিলানের হয়েও খেলতেন।
মিলানের কিছু দর্শনীয় স্থান
ইউরোপের সবচেয়ে বিস্তৃত গথিক ক্যাথেড্রালগুলির মধ্যে একটি হল মিলান ক্যাথেড্রাল, যা ‘ড্যুমো ডি মিলানো’ নামেও পরিচিত।সেন্ট মেরি ন্যাসেন্টর স্মরণে তৈরি এই গীর্জাটি ইতালির মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম। এটি মিলানের একদম কেন্দ্রে অবস্থিত।
গীর্জাটির স্থাপত্যকর্ম এত দৃষ্টিনন্দন যে এটি নিজেই একটি শিল্পকর্ম হিসেবে ধরা দেয় শিল্প প্রেমী সকল দর্শনার্থীদের কাছে। এছাড়াও অসংখ্য ছোট ছোট চিত্রকল্প, এবং ৩ হাজারের বেশি ভাস্কর্য দিয়ে সাজানো রয়েছে পুরোটা জায়গা। মিলান ঘুরতে গেলে এটি যেনো আবশ্যক একটি দর্শনীয় স্থান।
বিশপ এন্টোনিও দ্যা সাল্যুজ্জো ১৩৮৫ সালে এই গীর্জার কাজ শুরু করেন। তবে মিলানের সর্বপ্রথম রাজা গিয়ান গেলিয়াজ্জো গীর্জাটিকে সবচেয়ে সুন্দর ভাবে গড়ে তুলতে সমগ্র ইউরোপ থেকে সেরা সেরা স্থপতিদের সমাবেত করেন।
অত:পর ১৪১৮ সালে নির্মানকাজ শেষ হয় এবং গীর্জাটি রূপ নেয় চমৎকার স্থাপত্য শিল্পে। এছাড়াও আছে সান্তা মারিয়া দ্যেলে গ্রাজ্যিই নামে অন্য একটি গীর্জা।
রেনেসাঁর সময়কালের যে শিল্প বিপ্লব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো সারা ইউরোপ জুড়ে তার ই সাক্ষ্য বহন করছে এটি। বিখ্যাত স্থাপতি দ্যোনাতো ব্রামাতে নির্মান করেন এটি। বিখ্যাত সব পেইন্টিং এর জন্য পরিচিত গীর্জাটি। এখানেই আছে, কালজয়ী চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির আঁকা ‘দ্যা লাস্ট সাপার’ চিত্রকর্মটি।
বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন শপিংমল ‘গ্যালিরিয়া ভিতোরিয়া ইমান্যুয়েল ২’ ও এই মিলানেই অবস্থিত। নীল গ্লাসের সিলিং, মোজাইক করা মেঝে, সুউচ্চ টাওয়ার যে সৌন্দর্য্য ছড়াচ্ছে তা অতুলনীয়। ল্যুই ভুতোন, প্রাডার মতন বিশ্বের নামি-দামি ব্রান্ডের দেখা মেলে এখানে।
বিংশ শতাব্দীর কুখ্যাত শাসক মুসোলিনী শাসন শুরু করে এই মিলান থেকে, পতন ও হয় এই মিলানেই। মিলান যেনো ইতিহাসের কোনো কলঙ্ক তার নিজের গায়ে লাগতে দেয় না। মিলান যেনো চায় সময়ের অসীমতটে প্রতিলিপি হয়ে থাকুক শুধুমাত্র তার অসাধারণ সব শিল্পকর্ম, স্থাপত্য আর হালের আলো জ্বলমলে কোনো এক ফ্যাশন উইকের একটি রাতের গল্প!
Feature Image: fearlessfemaletravels.com References: 01. Milan-the-gray-city-is-going-green. 02. Milan-italys-lost-city-of-canals. 03. Milan-in-the-renaissance. 04. the-city-of-milan.