মেডুসা: রূপসী থেকে অভিশপ্ত সর্পকেশী রমণী

494
0

গ্রীক পৌরাণিক ঐশ্বরিক দেব-দেবীদের মধ্যে বিখ্যাত একজন হচ্ছে মেডুসা। গর্গন বোনদের একজন ছিলেন মেডুসা। যিনি অমর ছিলেন না। মেডুসা তার সাপের মতো চুল এবং তার পাথর শীতল দৃষ্টিশক্তির জন্য বিখ্যাত। সে যার দিকে তাকিয়ে থাকতো তারাই পাথর হয়ে যেতো। বলা হয়ে থাকে যে, মেডুসা প্রথমে এমন অভিশপ্ত ছিল না, অপূর্ব সুন্দরী ছিল। কিন্তু দেবী অ্যাথেনার অভিশাপে সে কদাকার হয়ে যায়।  

সুন্দর জীবন  

মেডুসা তার জীবনের শুরুতে এরকম কদাকার, কুৎসিত দেখতে ছিল না। সে দেখতে অপরূপ সুন্দরী ছিল। টাইফন এবং একিডনা দম্পতি জন্ম দিয়েছিল মেডুসাকে। কেউ কেউ বলে, মেডুসার বাবা-মা সাগরের দেবতা ও দেবী ফোরসিস ও সিটো ছিলেন। 

মেডুসারা তিন বোন ছিল। যারা গর্গন নামে পরিচিত ছিল। গর্গন নামটি এসেছে প্রাচীন গ্রীক শব্দ γοργός থেকে, যার অর্থ ‘কঠোর’, ‘উগ্র’, এবং ‘ভয়ঙ্কর’ এবং মেডুসার নামটি এসেছে প্রাচীন গ্রীক ক্রিয়াপদ μέδω থেকে যার অর্থ ‘রক্ষা করা’। তিন বোনের মধ্যে মেডুসা ছোট ছিল। বড় দুই বোন অমর হলেও মেডুসা ছিল মরণশীল।  

গর্গন বোনদের তিনজন। Image Source:devianart.com

রূপবতী মেডুসা পৃথিবীর একদম উত্তরে বাস করতো যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছাতো না। খুব ছোটবেলাতেই দেবী অ্যাথেনার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিল সে। দেবী অ্যাথেনার মন্দিরেই ধর্মযাজিকা হিসেবে কাজ করতো। 

অভিশপ্ত জীবনের পেছনের কারণ 

মেডুসার অভিশপ্ত জীবনের পেছনের কারণ জানতে গেলে বেশ কয়েকটি মতবিভেদ পাওয়া যায়। কিছু উৎস থেকে জানা যায়,  মেডুসা যখন ধর্মযাজিকা হিসেবে অ্যাথেনা দেবীর মন্দিরে কাজ করতেন একদিন তার সূর্য দেখার খুব সাধ জাগে।

কিন্তু চাইলেই তো সূর্য দেখা যাবে না। দেখার পূর্বে দেবী অ্যাথেনার কাছে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু দেবী তার ইচ্ছা একদম নাকচ করে দিলেন। সূর্য দেখার অনুমতি দিলেন না। 

মেডুসার মনে মনে খুব ক্ষোভ হলো এবং দেবীর সাথে রাগ দেখিয়ে ফেলল। এতদিন ধরে নিষ্ঠার সাথে পূজা করার পরেও তাকে সূর্য দেখতে যেতে দিল না কারণ দেবী নিশ্চয়ই মেডুসার রূপ নিয়ে ঈর্ষান্বিত। 

জ্ঞানের দেবী অ্যাথেনা; Image Source: Glogster

মেডুসার এরকম কথা শুনে অ্যাথেনা ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি তাকে অভিশাপ দিলেন। যে রূপ নিয়ে তার এত অহংকার, সে রূপ চিরতরে হারিয়ে যাবে। সেই সাথে তার দিকে যে তাকাবে সে নিষ্প্রাণ পাথরে পরিণত হয়ে যাবে।

সাথে সাথেই অভিশাপ ফলে যায়। মেডুসার শুভ্র সাদা গায়ের রং সাপের মতো সবুজ হয়ে যায়। মসৃণ চামড়া আঁশটে রূপ ধারণ করে।

মাথার ঘন চুল হাজার হাজার বিষাক্ত সাপে রূপ নেয়। কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত সাপের লেজের আকৃতি হয়ে যায়। চোখ দুটো ভয়াবহ রকম শীতল হয়ে যায়। 

অভিশপ্ত মেডুসা; Image Source: wallpaperaccess.com

মতান্তরে কিছু উৎস বলে, মেডুসার সুন্দর নিটল দেহ গড়ন, ফর্সা গায়ের রং এবং লম্বা সোনালী চুলই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। মেডুসাকে যেই দেখতো সেই লালসায় পাগল হয়ে যেত। তার সেই স্বর্গীয় রূপের প্রেমে পড়লেন সমুদ্র দেবতা পসাইডনও। 

একদিন অ্যাথেনার মন্দিরের ভেতরেই মেডুসার সঙ্গে জোর করেই সঙ্গমে লিপ্ত হলেন সমুদ্র দেবতা। ভিন্নমতে এটি ধর্ষণ ছিল না। মেডুসাও পসাইডনের প্রেমে পড়ে এই কামলালসায় সাড়া দিয়েছিল। পবিত্র মন্দিরের মধ্যে দেবীর সামনেই মিলিত হয়, স্থান, কাল, পাত্র ভুলে যায়। 

দেবী তাই রাগে কাঁপতে কাঁপতে ভয়ংকর অভিশাপ দিলেন শুধুমাত্র বেচারি মেডুসাকেই। সাগর দেবতা পসাইডনের কোন শাস্তি হলো না। অভিশপ্ত হওয়ার সময় মেডুসা গর্ভবতী হয়েছিলেন। অর্থাৎ পসেইডনের সাথে মিলনের ফলে, পেগাসাস যা একটি ডানাওয়ালা ঘোড়া এবং সোনার তরবারির নায়ক ক্রাইসারকে জন্ম দিয়েছিল বলে জানা যায়।

অভিশপ্ত জীবনের শুরু 

নিজের রূপ হারানোর পর খুবই হতাশ হয়ে পড়ে মেডুসা। রাগে দুঃখে অ্যাথেনা দেবীর মন্দির ছেড়ে চলে যায় অনেক দূরে কোনো এক গহীন বনে। মেডুসা সবসময় লম্বা একটি ধনুক এবং পিঠে তীর নিয়ে ঘুরে বেড়াত। তবে সে চোখের দৃষ্টিতে জঙ্গলের অনেক প্রাণীকে পাথর বানিয়ে দিয়েছিল। 

তীর ধনুক হাতে শিকার করছে মেডুসা; Image Source: pxfuel.com

সমুদ্রের এক নির্জন দ্বীপে থাকা শুরু করে সে। আর সেই দ্বীপে তাকে মারার জন্যে কেউ গেলে আর ফিরে আসত না কারন সবাই পাথর হয়ে যেতো। জঙ্গলে ঘোরার সময় তার মাথা থেকে সাপগুলো খসে পড়ে গিয়েছিল। ধারণা করা হয়, সাপ পড়েছিল আফ্রিকায় এবং এরপর থেকেই আফ্রিকা বিষাক্ত সাপদের অন্যতম একটি আবাসস্থল হয়ে দাঁড়ায়। 

মেডুসা বধের নেপথ্য 

মেডুসা বধের কারণ লেখার আগে মেডুসাকে বধ করার নায়কের নাম অবশ্যই নিতে হবে। সেই নায়ক হচ্ছে পার্সিয়াস। পার্সিয়াস ছিলেন অর্ধেক নর, অর্ধেক দেবতা। কারণ দেবতা জিউস ও মানবী ড্যানির সন্তান ছিলেন তিনি। রাজা পলিডেকটাসের সেরিফোস দ্বীপে পার্সিয়াস বসবাস করত। 

একদিন রাজা তার এক বিশাল ভোজসভায় পার্সিয়াস ও তার মা ড্যানিকে নিমন্ত্রন করেন। মূলত পার্সিয়াসের সুন্দরী মা ড্যানির দিকে নজর ছিল চতুর পলিডেকটাসের। এদিকে সবাই বেশ দামি দামি উপঢৌকন নিয়ে আসলেও গরীব পার্সিয়াস খালি হাতেই এসেছিলেন। চতুর রাজা সে সুযোগটাই নিলেন।

মেডুসার কাটা মুণ্ডু হাতে পার্সিয়াস ;Image Source: twitter.com

গল্পের ফাঁদ পাতলেন। তিন গর্গন কন্যার গল্প করলেন পার্সিয়াসের সামনেই, এছাড়াও বললেন যে কেউ যদি তিন বোনের একজনের মাথা তাকে কেটে এনে দিতে পারতো তবে তিনি খুব খুশি হতেন। পার্সিয়াস এতে অপমাণিত বোধ করলেন। তিনি তখনি গর্গন বোনদের খুঁজতে বেরিয়ে পরলেন। রাজা এটাই চেয়েছিলেন মনে মনে। 

একান্তে পার্সিয়াসের মাকে পাওয়ার জন্যেই এই মিথ্যে মনবাসনার কথা তুলে ধরেছিলেন তিনি। কারণ তিনি জানতেন তিন গর্গন বোনের মধ্যে মেডুসা ছাড়া বাকি দুইজন অমর। একমাত্র মেডুসাই মরণশীল কিন্তু তাকে মারা অসম্ভব ব্যাপার। তাকে মারতে গেলে পার্সিয়াস আর কখনোই ফিরে আসবে না। 

মেডুসা বধ

বহু পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে এসে মেডুসার দ্বীপে পৌঁছালো পার্সিয়াস। মেডুসাকে একা একা মারা সহজ কাজ ছিল না। তবে স্বয়ং গ্রীক দেবী অ্যাথেনাই তাকে শিখিয়ে দিল মেডুসা বধের বিভিন্ন কৌশল। নিজের ঢাল উপহার হিসেবে দেন পার্সিয়াসকে। দেবীর কথা মতো মেডুসার চোখের দিকে না তাকিয়ে ঢালের আয়নায় চোখ রাখতেন পার্সিয়াস। 

এছাড়াও পার্সিয়াসের কাছে পাখাওয়ালা জুতো ছিল। একদিন সুযোগ বুঝে মেডুসার গলায় তরবারি চালালো সে। আকস্মিক আক্রমণের ফলে মেডুসা প্রতিরোধের সুযোগ একদমই পায়নি। মেডুসার কাটা মুণ্ডু জাদুর থলিতে ভরে পালিয়ে ফেরত আসে পার্সিয়াস।  

সমুদ্রের দানব ক্র্যাকেন। Image Source: theconversation.com

মতান্তরে, গ্রিসের আর্গোস রাজ্যের রাজা আর রানী দেবতাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে দেবতাদের অপমান করেছিলেন। চরম অপমানিত হয়ে দেবতারা শাস্তি দিতে পাতালের কারাগার টারটারাস থেকে ভয়ঙ্কর দানব ক্র্যাকেনকে মুক্ত করে পৃথিবীতে পাঠায়।

দেবতারা নিজেরাই বিশাল এই জলদানবকে ভয় পেত এমনকি একে মারার জন্য কোনো অস্ত্রও ছিল না। আর্গোস রাজা মহাবিপদে পড়ে সেসময় রাজ্যের এক জ্যোতিষী কাছে সমাধানের জন্য যায়। 

সে রাজাকে সমাধানের জন্য দুইটি উপায় বলে দেয়। একটি হচ্ছে রাজকন্যাকে দানবের সামনে বলি দেওয়া অন্যটি হচ্ছে বলি দিতে হবে মেডুসার মাথা কেটে এনে দানবের সামনে রাখলেই দানদের মৃত্যু হবে। 

আর্গোসের রাজা তখন পার্সিয়াসকে মেডুসার কাটা মুণ্ডু নিয়ে আসার দায়িত্ব দেন। কাটা মুন্ডু ক্র্যাকেনের চোখের সামনে ধরতেই মস্ত দানব নিমেষে পাথর হয়ে যায়। 

ইতালির ফ্লোরেন্সে পার্সিয়াস ও মেডুসার ভাস্কর্য; Image Source: mythopedia.com

গ্রীক মিথোলজিতে মেডুসাকে নিয়ে অনেক কাহিনীই প্রচলিত আছে। বর্তমানে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের প্রধান নগরচত্বরে পার্সিয়াস এবং মেডুসার একটি বিখ্যাত স্থাপত্য কর্ম দেখা যায়। প্রতিবছর অগণিত পর্যটক এটি দেখতে ভিড় জমায় সেখানে। 

 

Feature Photo: wallpaperaccess.com 
Sources:

01. Medusa. 
02. Medusa: The Real Story of the Snake-Haired Gorgon. 
03. Medusa Greek Mythology. 
04. The Curse of Medusa From Greek Mythology. 
05. The Real Story of Medusa: Protective Powers from a Snake-Haired Gorgon.