মসৃণ, চকচকে, বৃত্তাকার একটি বস্তু গাঢ়-ধূসর কাদা পাথরের স্তুপ থেকে বেরিয়ে আসছে। মেরি ছুটে এসে জলদি আশেপাশের শেলটি সরিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ পর একটি প্রাণির মাথার খুলি বের হয়। কিন্তু এটি তার প্রথম আবিষ্কারের মতো নয়। তার এই নীরব পর্যবেক্ষণের সঙ্গী ছিলেন তার বিশ্বস্ত কুকুর ট্রে। মাত্র কয়েক মিনিট আগেও এতো ঠান্ডায় বাইরে থাকা ঠিক হবে কি না ভাবছিলেন। এখন তিনি নিশ্চিত যে মূল্যবান কিছু পাবেন।
পরদিন সকালে আবার খনন শুরু হয়। এক এক করে কশেরুকা, পেলভিক হাড় থেকে শুরু করে পাঁজরের হাড়গুলো বেরিয়ে আসে। একটু বেশি খনন করে চারটি সূক্ষ্ম হাড় যা পা বা প্যাডেল বলে মনে হয়েছিল, বের করা হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রমের পর শেষ পর্যন্ত একটি প্রায় নয় ফুট লম্বা এবং ছয় ফুট চওড়া কঙ্কাল বেরিয়ে আসে, যার মাথার দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র চার থেকে পাঁচ ইঞ্চি।
তার এই আবিষ্কার অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। তার এই আবিষ্কারকে জাল প্রমাণের চেষ্টাও ছিল। এটি শুধু তার পরিবারের আত্মসম্মানের বিষয় ছিল না, একইসাথে জীবাশ্ম বিজ্ঞানের নতুন যুগের জন্য বাধাও তৈরি করছিল। এই আবিষ্কারটি ছিল প্লেসিওসরাসের (Plesiosaurus) সম্পূর্ণ কঙ্কাল। আর এই অদম্য ব্যক্তিটি ছিলেন মেরি অ্যানিং, যার হাত ধরে জীবাশ্ম বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু। কিন্তু, অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতোই এখানেও সামাজিক অবস্থান এবং নারী হিসাবে তিনি উপেক্ষিত ছিলেন।
জন্ম ও শৈশব
মেরি অ্যানিং ১৭৯৯ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম ইংলিশ কাউন্টি ডরসেটের লাইম রেজিসে জন্মগ্রহণ করেন। লাইম রেজিস ‘জুরাসিক কোস্ট’ হিসাবে পরিচিত, যেখানে আজও প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার চলছে। লাইম রেজিস অ্যামোনাইট এবং বেলেমনাইট সমৃদ্ধ একটি স্থান। নেপোলিয়নিক যুদ্ধের সময়, বেসামরিক নাগরিকদের বিদেশের পরিবর্তে বাড়ির কাছাকাছি ছুটিতে উৎসাহিত করা হয়েছিল। তাই, পর্যটকরা লাইম রেজিসের মতো সমুদ্র তীরবর্তী শহরগুলোতে ভিড় করতো, ফলে জীবাশ্ম অনুসন্ধানও বৃদ্ধি পায়।
মেরির পরিবার ছিল ধর্মীয় ভিন্নমত পোষণকারী প্রোটেস্ট্যান্ট যারা চার্চ অব ইংল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। সেই সাথে তারা খুব দরিদ্র ছিল। নয় বা দশটি সন্তানের মধ্যে শুধু মেরি এবং তার বড় ভাই জোসেফ বেঁচে ছিলেন। মাত্র ১৫ মাস বয়সে মেরি এক প্রতিবেশীর সাথে বাইরে বেড়ানোর সময় দুর্ঘটনায় পতিত হন। সেই প্রতিবেশীসহ মোট তিনজন বজ্রপাতে নিহত হন। মেরি মৃত্যুর একদম কাছাকাছি গিয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান।
সেই সময়ে লাইম রেজিসের অনেক মেয়ের মতো, মেরির খুব কম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল। তবে তিনি পড়তে পারতেন এবং নিজেই ভূতত্ত্ব এবং অ্যানাটমি শিখেছিলেন। মেরির বাবা রিচার্ড আসবাবপত্র তৈরি করতেন, সাথে ছিলেন একজন শখের জীবাশ্ম সংগ্রাহক। মাত্র পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকে মেরি তার বাবার সহযোগী হয়ে উঠে। সেই সময় ধর্ম, সামাজিক অবস্থান সবকিছু থেকেই একজন মেয়ের জন্য এটি অকল্পনীয় ছিল।
মেরি তার বাবার কাছ থেকে সৈকতে পাওয়া জীবাশ্ম সন্ধান এবং তা পরিষ্কার করতে শিখেছিল। যা রিচার্ড তার দোকানে প্রদর্শন এবং বিক্রি করতো। রিচার্ড ১৮১০ সালে যক্ষ্মা এবং পূর্ববর্তী আঘাতের কারণে হঠাৎ মারা যান। জোসেফ শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজ শুরু করে এবং তাদের মা মলি, মেরিকে তার প্রত্নতাত্ত্বিক সন্ধান বিক্রি করে পরিবারের ঋণ পরিশোধে সহায়তা করতে পরামর্শ দেন।
প্রথম ইকথিওসর (Ichthyosaur)
১৮১১ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে মেরি তার ভাই জোসেফের সাথে একটি অদ্ভুত দর্শন জীবাশ্মযুক্ত খুলি খুঁজে পান। মেরি অনুসন্ধান করে এর ৫.২ মিটার দীর্ঘ কঙ্কালের রূপরেখাটি খনন করেন। শহরের সবাই ভাবত যে তার আবিস্কার নিশ্চয়ই কোন দানবীয় বস্তু।
বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন এটি একটি কুমির। মেরির এই রহস্যময় আবিষ্কার নিয়ে বছরের পর বছর ধরে বিতর্ক হয়। অবশেষে এটির নামকরণ করা হয় ‘ইকথিওসরাস বা ‘ফিশ লিজার্ড’। তবে এটি মাছ বা টিকটিকি নয়, বরং একটি সামুদ্রিক সরীসৃপ যা ২০১-১৯৪ মিলিয়ন বছর আগে বেঁচে ছিল।
বিতর্কিত আবিষ্কার
লেখার শুরুতেই একটি আবিষ্কারের গল্প ছিল। ১৮২৩ সালে মেরিই প্রথম প্লেসিওসরাসের (Plesiosaurus) সম্পূর্ণ কঙ্কাল আবিষ্কার করেন। Plesiosaurus অর্থ ‘সরীসৃপের কাছাকাছি’। এই অদ্ভুত নমুনাটি নিয়ে জর্জেস কুভিয়ার বিতর্ক শুরু করেন।
তারা লন্ডনের জিওলজিক্যাল সোসাইটির একটি বিশেষ সভায়ও মেরিকে আমন্ত্রণ জানায়নি। দীর্ঘ বিতর্কের পর, অবশেষে কুভিয়ার তার ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হন।
ডিমারফোডন (Dimorphodon) আবিষ্কার
১৮২৮ সালে মেরি আরেকটি জীবাশ্ম আবিষ্কার করেছিলেন যার একটি লম্বা লেজ এবং ডানা ছিল। এটি ছিল মূলত ডিমারফোডনের প্রথম অবশেষ। সেই সাথে জার্মানির বাইরে আবিষ্কৃত প্রথম টেরোসর (pterosaur)। টেরোসরদের ডানা ছিল এবং বিশ্বাস করা হয় যে, তারা সর্বকালের সবচেয়ে বড় উড়ন্ত প্রাণী।
অন্যান্য আবিষ্কার
অ্যানিং বছরের পর বছর ধরে সুপরিচিত ইংরেজ ভূতত্ত্ববিদ এবং অক্সফোর্ডের ভূতত্ত্বের প্রথম অধ্যাপক, উইলিয়াম বাকল্যান্ডের সাথে কাজ করেছেন। তারা কপ্রোলজি নামে পরিচিত জীবাশ্মযুক্ত মলের সন্ধান পেয়েছিলেন। মেরি, ইকথিওসরের কঙ্কালের ভেতর প্রায় চার ইঞ্চি লম্বা অনেক পাথর খুঁজে পেয়েছিলেন।
তিনি ভেবেছিলেন, সেগুলো হজম না হওয়া খাবারের জীবাশ্মযুক্ত গুচ্ছ হতে পারে। পরবর্তীতে তারা বুঝতে পারেন, সেগুলো মূলত মল ছিল, যা তাদের সেই প্রাণিদের খাদ্য সম্পর্কেও ধারণা দিয়েছিল।
১৮২৯ সালে তিনি স্কোয়ালোরাজারের (Squaloraja) কঙ্কাল খুঁজে পান। এটি একটি মাছের জীবাশ্ম ছিল, যাকে হাঙ্গর এবং রে মাছের মাঝামাঝি একটি সদস্য বলে মনে করা হয়। মেরি আরও আবিষ্কার করেছিলেন প্রাচীন স্কুইড-সদৃশ প্রাণীর জীবাশ্ম কালি, লেখা এবং আঁকার কালি হিসাবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
বিজ্ঞান ও ধর্ম
অ্যানিং যেসব ব্রিটেনের পুরুষ ভূতত্ত্ববিদদের সাথে কাজ শুরু করেছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ছিলেন অ্যাংলিকান পাদ্রী। তারা জীবাশ্ম আবিষ্কারের ফলে প্রাকৃতিক বিশ্ব সম্পর্কে নতুন জ্ঞান ব্যাখ্যা করার জন্য বাইবেলের গল্প ব্যবহার করার চেষ্টা করতেন। যেমন-বাকল্যান্ড বিশ্বাস করতেন উচ্চ উচ্চতায় পাওয়া জীবাশ্মগুলো প্রমাণ করে পৃথিবীতে একটি বিশাল বন্যা হয়েছিল, ঠিক যেমনটি বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে।
১৮৩৩ সালে, মেরি একজন পর্যটক রেভারেন্ড হেনরি রলিন্স এবং তার ছয় বছরের ছেলে ফ্রাঙ্কের সাথে দেখা করেন। রলিনস বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর এক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু অ্যানিং তরুণ ফ্রাঙ্ককে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, পাহাড়ের বিভিন্ন স্তরে পাওয়া জীবাশ্মগুলোর অর্থ সম্ভবত ভিন্ন সময়ে প্রাণিগুলো তৈরি হয়েছিল এবং বেঁচে ছিল। ফ্র্যাঙ্কের জার্নাল অনুসারে, অ্যানিং যাওয়ার পর তার বাবা এই বিষয়ে আলোচনা করতে অস্বীকার করেছিলেন।
কিন্তু তার বন্ধুদের কাছ থেকে পাওয়া বেশিরভাগ বিবরণ অনুসারে, অ্যানিং ধার্মিক ছিলেন যাকে প্রায়শই প্রার্থনা করতে বা বাইবেল পড়তে দেখা যেত এবং তিনি সহজে রবিবারের প্রার্থনা মিস করতেন না। অ্যানিং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাস এবং তার আবিষ্কারের সমন্বয় করার চেষ্টা করেছিলেন। বেশিরভাগ বিবরণ থেকে মনে হয়, তিনি মেনে নিয়েছিলেন বিবর্তন ঈশ্বরের পরিকল্পনার অংশ। মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগে তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে,
প্রাক্তন এবং বর্তমান বিশ্বের প্রাণীদের মধ্যে একটি সাদৃশ্যের সংযোগ রয়েছে।
পর্যাপ্ত মূল্যায়নের অভাব
তার ক্রমবর্ধমান খ্যাতি সত্ত্বেও, বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় তার কাজকে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। পুরুষ বিজ্ঞানীরা যারা প্রায়ই মেরির আবিষ্কৃত ফসিল কিনেছিলেন, তাদের বৈজ্ঞানিক কাগজপত্রে কৃতিত্ব দেননি। এমনকি যখন তার যুগান্তকারী ইকথিওসরের সন্ধান সম্পর্কে লিখতেন তখনও মেরিকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়নি।
লন্ডনের জিওলজিক্যাল সোসাইটি মেরির অবদানকে অস্বীকার করেছিল। এমনকি তারা ১৯০৪ সাল পর্যন্ত নারীদেরই স্বীকারই করেনি। স্টিফেন জে গোল্ড একবার মন্তব্য করেছিলেন যে,
অ্যানিং সম্ভবত জীবাশ্মবিদ্যার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অগোচরে থেকে যাওয়া (অথবা পর্যাপ্ত মূল্যায়নের অভাবে থেকে যাওয়া) ব্যক্তি।
কৃতিত্ব
‘She sells seashells by the seashore’ —বলা হয় এই টাং টুস্টারটি মেরি অ্যানিং থেকেই অনুপ্রাণিত। তিনি তার অনেক আবিষ্কার বিক্রি করেছেন, যা ক্রমান্বয়ে ভূতত্ত্ব এবং জীবাশ্মবিদ্যার প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ বাড়িয়েছে। তার আবিষ্কার বিখ্যাত ভূতাত্ত্বিক (এবং শৈশবের বন্ধু) হেনরি দে লা বেচেকে ১৮৩০ সালে ‘ডুরিয়া অ্যান্টিকিওর – এ মোর অ্যানসিয়েন্ট ডরসেট’ (Duria Antiquior – A More Ancient Dorset) আঁকতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
তিনি মেরির জন্য অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রিন্ট বিক্রি করেছিলেন। তার এই চিত্রকর্ম জীবাশ্ম বা ফসিলের উপর ভিত্তি করে প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রথম সচিত্র বর্ণনা। এই শিল্প ফর্ম এখন প্যালেওআর্ট (palaeoart) নামে পরিচিত। মেরির কাজ ১৮৪০ সালে প্রকাশিত ভূতত্ত্ববিদ টমাস হকিন্সের বই ‘অফ দ্য গ্রেট সি ড্রাগনসকেও’ অনুপ্রাণিত করেছিল।
শেষ জীবন ও স্বীকৃতি
মেরি অ্যানিং ১৮৪৭ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে স্তন ক্যান্সারে মারা যান। আজীবন অসাধারণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পরও তিনি আর্থিক সংকটে ছিলেন। লাইম রেজিসের সেন্ট মাইকেল চার্চে যেখানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে, সেখানে মেরিকে উৎসর্গ করা একটি দাগযুক্ত কাচের জানালা রয়েছে। তার বাড়ি এবং দোকানের জায়গায় লাইম রেজিস মিউজিয়াম তৈরি করা হয়। তার স্মৃতিতে এর বাইরে একটি নীল ফলক রয়েছে।
আজ লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম মেরি অ্যানিংয়ের বেশ কিছু আবিষ্কার প্রদর্শন করে, যার মধ্যে রয়েছে তার ইকথিওসর, প্লেসিওসর এবং টেরোসর। মেরির স্মৃতি বহনকারী রুক্ষ জুরাসিক উপকূল এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট – যেখানে বিজ্ঞানী, সৌখিন এবং দুঃসাহসিক শিশুরা পরবর্তী বড় সন্ধানের জন্য সারা বছর ধরে জড়ো হয়৷
২০১০ সালে তিনি রয়্যাল সোসাইটির ব্রিটিশ ইতিহাসের ১০ জন প্রভাবশালী নারী বিজ্ঞানীদের একজন হিসাবে স্বীকৃত হন। মেরি অ্যানিংয়ের একটি মূর্তি ২০২২ সালের মে মাসে তার নিজ শহরে, স্কুল ছাত্রী এভি সোয়ারের নেতৃত্বে চার বছরের প্রচারণার পর উন্মোচন করা হয়েছে। ব্রোঞ্জের মূর্তিটি চার্চ ক্লিফ সৈকতের উপরে কালো ভেন এবং গোল্ডেন ক্যাপের মুখোমুখি স্থাপন করা হয়েছে।
মেরি অ্যানিংয়ের আবিষ্কার শুধু বিজ্ঞানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, একইসাথে তার জীবন বারবার মনে করিয়ে দেয় সময়ের সাথে নারীরা কতটা উপেক্ষিত ছিল। এতো প্রতিকূলতার পরও তার নিরলস কাজ করে যাওয়া সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। তার আবিষ্কার যুক্ত করেছে অতীতের সাথে, আর ভবিষ্যতের পথ সুগম করেছে।
Features Image: amightygirl.com References: 01. Mary Anning Unsung Hero. 02. Biography Mary Anning. 03. Mary Anning Fossil Hunter. 04. Top 10 Mary Anning Facts. 05. Mary Anning Grave. 06. Mary Anning Paleontology.