মেরি অ্যান বেভান: কুৎসিত নারীর খেতাবপ্রাপ্ত ও তার সংগ্রামের গল্প

535
0

সুন্দর হতে কে না চায়? অপরের চোখে নিজেকে সুন্দর দেখানো, নিজেকে অন্যের চেয়ে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা-কমবেশি প্রত্যেক মানুষেরই মনের এক সুপ্ত বাসনা। আর যদি কোনোভাবে পাওয়া যায় সেই সৌন্দর্যের স্বীকৃতি, তখন মন মেলে আসমানে পাখা। উড়ে যেতে ইচ্ছে করে হাওয়ায়, ভেসে যেতে ইচ্ছে করে মেঘের ভেলায় চড়ে। কিন্তু যদি ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো হয়, তাহলে? এমনও কি হয় যে কাউকে বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া? কেমন হবে তার অবস্থা!

মেরি অ্যান বেভান—গোটা পৃথিবীর কাছে যিনি পরিচিত ‘বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত মহিলা’ হিসেবে। এখন বিশ্বজুড়ে সৌন্দর্যের এত জয়জয়কার, পৃথিবীব্যাপী অনুষ্ঠিত হচ্ছে মিস ওয়ার্ল্ড, মিস ইউনিভার্সের মতো সুন্দরী প্রতিযোগিতা। অথচ আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে, সভ্যতা শেখানো দেশ হিসেবে খ্যাত ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতো ভয়ংকর এক প্রতিযোগিতা।

যে প্রতিযোগিতায় নির্ধারণ করা হতো বিশ্বের সবচেয়ে কুৎসিত নারী। ইতিহাসের জঘন্যতম এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়ে ‘দ্য আগলিয়েস্ট উইমেন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ খেতাব জিতেন মেরি অ্যান বেভান। যিনি তার এই ‘কুৎসিততম’ খেতাবকে পুঁজি করে লড়াই করতে নামেন জীবনযুদ্ধের মাঠে। মেরির সেই জীবন সংগ্রামই আজ আমাদের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য।

মেরি অ্যান বেভানের গল্প 

মেরি অ্যান বেভান ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডের নরহ্যামের এক শ্রমজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাইয়ের এক বোন মেরি বাকি আট দশটা সাধারণ মেয়ের মতোই বেড়ে উঠেন। একে তো বড় পরিবার, তার উপর কন্যা সন্তান হওয়ায় মেরির পক্ষে অধিক পড়াশোনা করা সম্ভব ছিল না। তাও মেরি নার্সিংয়ের উপর ডিগ্রি নিয়ে লেখাপড়া শেষ করেন।

অল্পবয়সী মেরি অ্যান বেভান Image source bsbtimes.com

দেখতে সুন্দর, টানা টানা চোখ আর ছিপছিপে গড়নের মেরির বাকি পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই সংসারী হওয়ার স্বপ্ন ছিল। মেরি চেয়েছিল আত্মনির্ভরশীল হতে। স্বপ্ন তার সত্যিও হলো। অল্প বয়সেই তিনি নার্সিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে চাকরিতে যোগদান করেন।

পড়াশোনা শেষ হলো, চাকরিও হলো। সব স্বপ্ন পূরণ হলো। এবার যে সংসার করার পালা! সদা স্বাধীনচেতা মেরি অন্যান্যদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি বয়সেই সংসার জীবন শুরু করেন। ১৯০৩ সালে ২৯ বছর বয়সে টমাস বিভানকে বিয়ে করেন মেরি। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! বিয়ের পর থেকেই তার মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে থাকে।

কখনো মাইগ্রেন আবার কখনোবা পেশিতে ব্যথা। কিন্তু এতসব শারিরীক সমস্যার দিকে নজর দেওয়ার সময় কই তার! ইতোমধ্যে চারটি সন্তানের জননী হয়েছেন তিনি। ফলে সংসারের কাজে পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে যান মেরি অ্যান। তাইতো এসব সামলেও দিব্যি সংসার করে যাচ্ছিলেন।

সহকর্মীদের সাথে মেরি অ্যান Image source: anandabazar.com

কিন্তু নিয়তি যেন তাকে সুখে থাকতে দিতে চাচ্ছিলো না। সেজন্যই হয়তো মাইগ্রেন আর গেঁটে ব্যথার সঙ্গে এবার যুক্ত হলো আরও একটি ভয়ানক সমস্যা। এবার মেরির মুখের হাড়গোড় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সেইসাথে মাথার খুলির পরিসরও অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। যার ফলে ধীরে ধীরে বিকৃত হতে থাকে মেরি অ্যানের মুখ।

নষ্ট হতে থাকে তার মুখের স্বাভাবিক সৌন্দর্য। সুন্দরী আর লাস্যময়ী মেরি ধীরে ধীরে পরিণত হতে থাকে বিকৃত চেহারার রমণীতে। সংসারী আর ঘরোয়া মহিলাদের চেহারা তো এমনই হওয়ার কথা, তাইনা?— এমনটাই বলেছিলেন আশেপাশের পাড়া-প্রতিবেশি।

আসলে কি রোগ হয়েছিল তার? জানতে চাইলে চিকিৎসকেরা জানান অ্যাক্রোমেগালি (acromegaly) নামক এক বিরল অসুখে ভুগছিলেন তিনি। মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণের ফলে এই রোগ হয়ে থাকে। সেজন্য একে ‘পিটুউটারি অ্যাডেনোমা’ও বলা হয়ে থাকে।

অ্যাক্রোমেগালি আক্রান্ত মেরি অ্যান বেভান Image Source: pinterest.com

এই অসুখে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত বেড়ে যায়। বিশেষ করে হাত-পা, হাড়গোড় এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে পেশিতে তীব্র যন্ত্রণা ও মাইগ্রেন হয়। আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে এই অসুখ সম্পর্কে ডাক্তাররা খুব কমই জানতো।

ফলে সঠিক চিকিৎসার অভাবে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে মেরি অ্যানের আসল সৌন্দর্য। সবার কাছে তিনি পরিচিত হতে থাকেন একজন কুৎসিত মহিলা হিসেবে। এতকিছুর পরও স্বামী টমাস বিভান সবসময় মেরির পাশে থাকায় সেই যাত্রায় রক্ষা পান তিনি।

কিন্তু কথায় আছে না—বিপদ যখন আসে তখন সবদিক দিয়েই আসে। মেরির জীবনে সুখ যেন সহ্যই হচ্ছিলো না। বিয়ের মাত্র এগারো বছরের মাথায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায় তার স্বামী। অদ্ভুত আর কিম্ভূতকিমাকার চেহারার জন্য নার্সের চাকরিটাও হারান মেরি। এই চেহারা নিয়ে নতুন কোনো চাকরিও পাচ্ছিলেন না।

উল্টো প্রতিবার কাজ খুঁজতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। তাছাড়া অ্যাক্রোমেগালির কারণে মেরির শরীর দিন দিন আরো খারাপ থাকে। মোটকথা, চারটি সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে অথৈ সাগরে নিমিজ্জিত হতে থাকেন তিনি।কোনোভাবেই আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

সন্তানদের সাথে মেরি অ্যান বেভান Image source: proof of brain.com

এরমধ্যে একদিন খবরের কাগজের একটা বিজ্ঞাপন নজরে পড়ে মেরি অ্যানের। বিশ্বের ‘কুৎসিততম’ মহিলাদের খুঁজে বের করতে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে যাচ্ছে ইংল্যান্ড। যেখানে জিতলে একটা মোটা অঙ্কের অর্থপ্রাপ্তি হবে। সন্তানদের দুমুঠো খাইয়ে পরিয়ে বাচিঁয়ে রাখার জন্য সেই প্রতিযোগিতায় নাম লেখান মেরি অ্যান। এবং তাতে অংশগ্রহণ করে The Ugliest Woman in The World খেতাব জিতে নেন।

এরপর থেকে দিন দিন তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। পত্র-পত্রিকাগুলো মেরি অ্যানের ছবিসহ ভয়ঙ্কর সব গল্প প্রকাশ করতে থাকে। এসব মুখ বুজে সহ্য করেন তিনি। তার এই ‘কুৎসিততম’ খেতাবকে হাতিয়ার করে যদি সন্তানরা দুমুঠো খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারে, তাতে মন্দ কি! অবশ্য মিডিয়ার এই প্রচারের কারণেই ম্যারি অ্যানের জীবনে অন্য আরেক দুয়ার খুলে যায়।

১৯২০ সালে আমেরিকার জনপ্রিয় ‘ড্রিমল্যান্ড’ সার্কাসে ডাক পান মেরি অ্যান। কাজটা হচ্ছে মঞ্চে উঠে জোকারের মতো করে সবাইকে হাসাতে হবে। সেজন্য বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত, কিম্ভূতকিমাকার আর উদ্ভট সাজে জনসম্মুখে উপস্থিত হতে হবে। যা দেখে হাসিতে ফেটে পড়বে গ্যালারিতে বসা দর্শকেরা। এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান মেরি অ্যান। জাহাজে করে ইংল্যান্ড থেকে পাড়ি জমান সুদূর আমেরিকায়।

যৌবনে মেরি অ্যান বেভান Image source: sinisterisles.com

আমেরিকার মাটিতে পা রাখামাত্রই পত্রিকাগুলো হুড়মুড়িয়ে পড়ে। বহু পত্রিকার কভার পেইজে তাকে নিয়ে রিপোর্ট করা হয় ‘দুনিয়ার কুৎসিততম মহিলা’ শিরোনামে। সেই শিরোনাম তিনি সহ্য করেছেন। সমস্ত অপমান, অবহেলা, তিরস্কার, লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সহ্য করে তিনি মঞ্চে পারফর্ম করেছেন। কারণ এর দ্বারাই যে তার সন্তানদের থাকা খাওয়ার খরচ চলতো!

সার্কাসের লোকেরা মেরি অ্যানকে দেখে পাশবিক আনন্দে হেসে লুটিয়ে পড়তো। কিন্তু মেরির মানসিক যন্ত্রণার খবর নেওয়ার যে কেউ নেই! এভাবে চলে যায় কয়েক বছর। আস্তে আস্তে মেরির পরিবারও স্বচ্ছল হতে থাকে। বাচ্চাদের ভালো স্কুলে পড়ানো, বোডিংয়ের খরচ সব জোগাড় করতে সমর্থ হোন মেরি।

এসবের সাথে সমানতালে চলতে থাকে তাকে নিয়ে করা ব্যঙ্গবিদ্রূপও। একসময় এসবের বিরুদ্ধে কথা বলেন চিকিৎসকেরা। স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ‘হার্ভি কাসিং’ চিঠি লিখে এর প্রতিবাদ জানান। এতে করে মেরির অসুস্থতার কথা সামনে চলে আসে। তা সত্ত্বেও সার্কাসে মেরি অ্যানকে নিয়ে করা শো বন্ধ হয়নি।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সার্কাসের মঞ্চেই কাজ করে গিয়েছেন। যদিও ছেলেমেয়েরা উপার্জনক্ষম হবার পর থেকে মাকে সার্কাসের পেশা থেকে সরিয়ে আনার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি তাদের কথা শোনেননি। অসুস্থতা নিয়েই কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। এর মধ্যে একবারের জন্যও দেশের মাটিতে ফেরা হয়নি তার। তবে তার সর্বশেষ ইচ্ছে অনুযায়ী মৃত্যুর পর তার দেহটি ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ইংল্যান্ডে। ১৯৩৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ৫৯ বছর বয়সে মারা যান মেরি অ্যান বিভান।

মেরি অ্যান বেভান Image Source: pinterest.com

অ্যাক্রোমেগ্যালির বেশিরভাগ রোগীই বেশিদিন বাঁচেন না। মেরি অ্যানও বেশি দিন বাঁচেননি। কিন্তু মরে গিয়েও এই পৃথিবীর কদাকার মানুষগুলোর থেকে মুক্তি পাননি মেরি। মৃত্যুর পর খবরের কাগজগুলো রিপোর্ট করেছিল এই শিরোনামে—চলে গেলেন ‘দুনিয়ার কুৎসিততম মহিলা’ মেরি অ্যান বিভান। বিভিন্ন সময়ে মেরির ছবিকে কদাকারভাবে উপস্থাপন করে ফায়দা উঠিয়ে যাচ্ছে সবাই। অভাগিনী মেরি মৃত্যুর পরও হাসির খোরাক হচ্ছে এই পৃথিবীর মানুষের কাছে।

২০০৬ সালে হল্যান্ডের চিকিৎসক অটার ডি হার্ডার ব্রিটেনের একটি দোকানে গিয়ে দেখেন সেখানে রাখা একটা বিখ্যাত কোম্পানির কার্ডে মেরিকে খুবই বাজেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটা তিনি সহ্য করতে পারেননি। সঙ্গে সঙ্গে তিনি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। ফলে সেই কোম্পানি ক্ষমা চেয়ে কার্ডটি বাজার থেকে তুলে নেয়। পুরো দুনিয়ার কাছে মেরি অ্যান বেভান বিশ্বের সবথেকে কুৎসিত নারী হলেও, তার সন্তানদের কাছে তিনি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মা। তার মৃত্যুর পর সন্তানেরা বলেছিল—

ঈশ্বরের দরবারে আমাদের মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পুরস্কার। বিশ্বের সেরা মায়ের পুরস্কার। প্রতিনিয়ত মানসিকভাবে ধর্ষিত হতে হতেও যার পাখির চোখ ছিল তিনটে কচি পেট।

 

Feature Image: pinterest.com 
References: 

01. Mary Ann Bevan. 
02. Mary Ann Bevan. 
03. Mary Ann Bevan Ugliest Woman. 
04. Worlds Ugliest Woman Mary Ann Bevan.