১৯০৩ সাল, পদার্থ বিজ্ঞানে দুর্দান্ত অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করার সাথে সাথে তুমুল হাততালির আওয়াজে মিলনায়তন সরগরম হয়ে উঠল। সবার সাথে হাত মিলিয়ে ভীষণ শান্ত প্রকৃতির একজন নারী পুরস্কার গ্রহণের জন্য এগিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই বছর তিনি তার স্বামী ও স্বনামধন্য এক পদার্থবিদের সাথে নোবেল পুরস্কারটি ভাগ করে নিয়েছিলেন “প্লোনিয়াম এবং রেডিয়াম” আবিস্কারে অবদান রাখার জন্য। যদিও তাকে দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কারটি বগলদাবা করতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
ঠিক আট বছর পর ১৯১১ সালে দ্বিতীয়বারের মত তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। সেবার তিনি বিজ্ঞানের আরেকটি মৌলিক শাখা রসায়ন শাস্ত্রে নোবেল অর্জন করেন, যা আজ পর্যন্ত রেকর্ড। তিনি আর কেউ নন, ‘মাদার অব মডার্ণ ফিজিস্ক’ নামে খ্যাত মেরি কুরি, যিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে রেডিয়েশনের সংযোগ ঘটিয়ে তেজস্ক্রিয়তার গতানুগতিক ধারণাই আমুল পালটে দিয়েছিলেন।
তিনিই প্রথম এবং একমাত্র নারী যিনি দুইবার তাও বিজ্ঞানের দুটি ভিন্ন শাখায় নোবেল পুরস্কার জিতেছিলেন। কিন্তু এমন দিগ্বিজয়ী অবদানের মূল্য তাকে জীবন দিয়ে দিতে হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যুর কারন হয়ে দাঁড়ায়। তবে কি তিনি জানতেন যেই রেডিয়াম নিয়ে তিনি রাত দিন এক করছেন, তার শরীরের জন্য তা আদৌ নিরাপদ নয়?
বেড়ে ওঠা
১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর ওয়ারশতে মারিয়া স্কলোডোস্কা জন্মগ্রহণ করেন। উনিশ শতকের রাশিয়ার বিরুদ্ধে পোল্যান্ডের স্বাধীনতা বিদ্রোহের সেই উত্তাল ভূমিতে জন্ম নেয়া মারিয়ার বেড়ে উঠা আট-দশটা সাধারণ বাচ্চা মেয়ের মতো ছিল না। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন বটে কিন্তু বড় হয়েছেন এক দরিদ্র পরিবারে। মারিয়ার পিতা-মাতা উভয়ই পোলিশ এবং পেশায় শিক্ষক ছিলেন। তার পিতা পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন, কট্টর নাস্তিক এবং স্বাধীন পোল্যান্ডের পক্ষে তার অবস্থান প্রকাশ্যে জোরাল ছিল। স্বভাবতই তৎকালীন কর্তৃপক্ষের সাথে সংঘর্ষিক মতবাদের ফলে পুরো পরিবারের জীবিকা নির্বাহ অনেকটা সংগ্রামের পর্যায়ের ছিল। মারিয়া তার মা-বাবার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচাইতে ছোট ছিলেন।
মারিয়া প্রথমদিকে বোর্ডিং স্কুলে বড় হয়ে উঠলেও, যখন মারিয়ার বয়স ১১ বছর তখন তার মা যক্ষ্মায় মারা যান। স্বাভাবিকভাবেই মারিয়া তার বাবার কাছে এসে থাকা শুরু করার কারনে বাবার পরীক্ষাগারে গবেষণার কাজে হাত দেয়ার সুযোগ পান। অস্থীতিশীল সেই রাজনৈতিক সময়ে পিতার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগারের শান্ত এবং গবেষণার পৃথিবী ছিল মারিয়ার জন্য এক নতুন জগত।
মারিয়া যখন ১৮ বছর বয়স তখন আর্থিক বাস্তবতা তাকে এই নিরাপদ আশ্রয় থেকে টেনে কঠিন বাস্তবতায় পা রাখতে বাধ্য করে। রাশিয়ান নিয়ন্ত্রিত পোল্যান্ডে মহিলাদের উচ্চশিক্ষার অনুমতি ছিল না। কিন্তু মারিয়া এবং তার বোন ব্রোনিয়া উচ্চশিক্ষা গ্রহনের জন্য গোপনে ফ্লাইং ইউনির্ভাসিটিতে লেখাপড়া করেছেন। এমনকি কর্তৃপক্ষের হাত থেকে বাঁচতে তাদের রীতিমত স্কুল পরিবর্তন করতে হত সময়ে-অসময়ে।
উচ্চশিক্ষার নেশা তার এতটাই ছিল যে, দারিদ্র্যের কষাঘাত মারিয়ার পথ চলা থামাতে পারেনি বিন্দুমাত্র। তিনি তার বোন ব্রোনিয়ার প্যারিসে মেডিসিন বিষয়ে পড়াশুনার খরচ উপার্জনের জন্য গভর্নেসের চাকরি নেন এবং পাশাপাশি নিজের পড়াশুনা অবসর সময়ে চালিয়ে যেতে থাকেন। বিনিময়ে তার বোন ব্রোনিয়া ডাক্তার হয়ে মারিয়াকে প্যারিসে এনে পড়াশুনার খরচ দিবেন এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্য মারিয়ার জন্য অন্য কিছুই ঠিক করে রেখেছিল!
প্যারিসের দিনগুলো
শিক্ষতায় ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জনের সুবাদে প্যারিসে পাড়ি জমানো মারিয়া প্রথমেই তার নাম বদলে মেরি রাখেন। দরিদ্র শিক্ষার্থী মেরির জীবিকা অর্জনের সংগ্রাম তাকে নিয়ে দাড় করায় প্যারিসের এক বৈজ্ঞানিক পরিক্ষাগারে, যা তার জীবনের মোড় চিরকালের জন্য ঘুরিয়ে দেয়। একে তো ফরাসি ভাষার মত সম্পুর্ন নতুন ভাষায় কথা বলা, তার উপর প্যারিসের প্রচন্ড শীতের ধূসর রাতগুলো একটু ওমের অভাব এবং বিজ্ঞানের অপ্রতিরোধ্য জগতে একজন নিছক তরুণীর চাকরি পাওয়া, প্যারিসের জীবন মেরিকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করে দেয়।
অবশেষে খুব ছোট কাজের দায়িত্বে মেরিকে এক পরীক্ষাগারে চাকরি দেয়া হলেও, তার প্রযুক্তির দক্ষতা সবার মনোযোগ ও সম্মান অর্জন করতে সময় নেয় না। কাজের সুবাদেই পিয়েরে কুরি নামক একজন বিজ্ঞানীর সংস্পর্শে আসা, প্রণয়ে সূত্রপাত এবং অতপর তা বিবাহবন্ধনে মোড় নেয়।
পিয়েরে কুরি ছিলেন বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগী, বামপন্থী এবং ধর্মনিরপেক্ষ একজন মানুষ। তিনি কর্মজীবনের প্রথম দিকে ভাই জ্যাকের সাথে ‘পাইজো ইলেক্ট্রিসিটি’ আবিষ্কার করেন এবং পরবর্তীতে তিনি স্কুল অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিজিক্স অ্যান্ড কেমিস্ট্রির একটি পরীক্ষাগারের প্রধান ছিলেন, যেখানে প্রতিভাবান প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।
মেরি পিয়েরেকে প্যারিসে ১৮৯৪ সালে বিয়ে করেন। সাজসজ্জার প্রতি প্রচণ্ড উদাসীন মেরি খুব সাধারণ একটি নীল রঙের পোশাক পরে বিয়ের দিন উপস্থিত হন। বিয়ের ঠিক দুই বছর পর তাদের মেয়ে আইরিনের জন্ম হয়। যিনি নিজেও পরবর্তীতে রসায়নে ১৯৫৩ সালে ‘আর্টিফিসিয়াল রেডিয়েশন’ এর উপর নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। অপরদিকে, ১৯০৪ সালে ছোট মেয়ে ইভ জন্মগ্রহন করেন, যিনি পরবর্তিতে একজন সাংবাদিক ও লেখিকা হিসেবে পেশা জীবনে নিজের দ্যুতি ছড়ান।
পেশাজীবন
মেরি বরাবরই স্বদেশে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার স্বপ্ন প্রচন্ডভাবে লালন করলেও তা বাস্তবে রুপ দিতে পারেনি। চেষ্টাও যে করেননি তাও কিন্তু নয়। শুধুমাত্র নারী হবার কারণে ক্রাকো বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল।
মেরির ব্যক্তিগত জীবন বা মাতৃত্বকে তার কাজের পথে বাধা হতে দেননি কখনোই। ১৮৯৫ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী উইলহেলম রেন্টজেনের এক্স-রে আবিষ্কার এবং ১৮৯৬ সালে মেরির সুপার ভাইজার হেনরি বেকেরেলের ইউরেনিয়াম লবণ দ্বারা উৎপাদিত রশ্মি নিয়ে গবেষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেন মেরি। মেরি ইউরেনিয়ামের বৈশিষ্ট্য-এর উপর গবেষণা শুরু করেন। তার গবেষনার উদ্দেশ্য ছিল যে এই বৈশিষ্ট্যগুলি অন্যান্য পদার্থে পাওয়া যায় কিনা।
মেরির সুপারভাইজার হেনরি বেকেরেল খুঁজে পেয়েছিলেন যে ইউরেনিয়াম সল্ট কালো কাগজের মাধ্যমে ফটোগ্রাফিক প্লেটগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে, এমনকি সূর্যের আলো ছাড়াই। পিয়েরের আবিষ্কৃত একটি যন্ত্রের সাহায্যে মেরি এই আজব রশ্মির ধাঁধা সমাধান করতে শুরু করেন। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে, তিনি আবিষ্কার করেন যে থোরিয়াম উপাদান ইউরেনিয়ামের মতো একই রশ্মি বের করতে সক্ষম।
এরই ধারাবাহিকতায় মেরি এবং পিয়ের রেডিওঅ্যাক্টিভিটি অনুসন্ধানের কাজ করছিলেন এবং ১৮৯৮ সালে তারা ঘোষণা করেন তারা দুটি নতুন রাসায়নিক উপাদান আবিষ্কার করেছে: পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম। অবশেষে ১৯০৩ সালে, পদার্থবিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেলসহ তেজস্ক্রিয়তায় অনবদ্য অবদানের ফলস্বরুপ মেরি ও পিয়েরে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
উত্থান পর্ব
১৯০৬ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় স্বামী পিয়েরে কুরির মৃত্যুতে মেরি মানসিকভাবে প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়েন। আর দুঃখ ঘোচাতে নিজেকে নিযুক্ত করেন ল্যাবের গবেষণায়। একই সাথে মৃত স্বামী পিয়েরের শিক্ষতার দায়িত্ব মেরির উপর চলে আসে এবং প্রথম মহিলা শিক্ষক হিসেবে কলেজে নিযুক্ত হন তিনি। এরপর ১৯১১ সালে মেরি রসায়নে রেডিয়াম বিচ্ছিন্ন করার অর্জন হিসেবে দ্বিতীয়বারের মত নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন।
মেরি তার দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরপরই সোরবনে দুটি গবেষণাগার নির্মাণ করা হয়। একটি ল্যাবরেটরিতে তেজস্ক্রিয়তা বিশ্লেষণকারী গবেষকদের একটি দলের নেতৃত্ব দিতেন এবং অন্য ল্যাবরেটরিটি ক্যান্সারের সম্ভাব্য চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হতো।
প্রচন্ড মেধাবী এই বিজ্ঞানী ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈন্যদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। মেরি একটি মোবাইল এক্স-রে ইউনিট তৈরি করেন যা দিয়ে তিনি যুদ্ধে আহত সৈন্যদের আঘাত-ক্ষত পরীক্ষা করে দেখতেন। তখন তার সহযোগী ছিলেন ১৭ বছর বয়সী বড় মেয়ে আইরিন। উক্ত বছরই ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রস মেরিকে রেডিওলজিকাল সার্ভিসের প্রধান পদে নিযুক্ত করে, যেখানে মেরি ডাক্তার এবং মেডিকেল সহযোগিদের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।
১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মেরি তার কাজে ফিরে আসার পর ১৯১৯ সালে যুদ্ধের উপর “রেডিওলজি ইন ওয়ার” নামক বইয়ে তার ব্যক্তিগত বিবরণ লিপিবদ্ধ করে যান।
মৃত্যুকে হার না মানা আবিস্কার
১৯০১ সালে স্বয়ং বেকেরেল জানান যে, রেডিয়ামের একটি সক্রিয় নমুনা বহন করার ফলে তার পকেট পুড়ে গিয়েছিল। এছাড়াও, তেজস্ক্রিয় উপাদান পরিচালনা হয় এমন ল্যাব সহযোগীদের বেশিরভাগ আঙুলই ব্যথা এবং ক্ষতে আক্রান্ত হতো। মেরি এর সবই জানতেন যে তিনি মৃত্যুর সাথে তাল মিলিয়ে চলছিলেন। স্বভাবতই কাজের প্রতি প্রচণ্ড নেশা ও একনিষ্ঠতার ফলে তিনি মৃত্যুর আশঙ্কাকে রীতিমত অস্বীকার করেছিলেন।
স্বভাবতই ল্যাবে দীর্ঘ সময় কাটানোই অবশেষে তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মেরি ১৯৩৪ সালে অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া নামক রোগে মারা যান, এই রোগে অস্থি মজ্জা পর্যাপ্ত নতুন রক্তকণিকা তৈরি করে না। তার মৃত্যুর কারন নিশ্চিতভাবেই বিকিরণের অত্যধিক এক্সপোজারের ফলাফল ছিল বলে জানানো হয়। মেরির ল্যাবে ব্যবহৃত নিজস্ব নোটবুকগুলি আজও ফ্রান্সে সীসাযুক্ত বাক্সে বিশেষভাবে সংরক্ষিত আছে। কারন নোটবুকগুলো তেজস্ক্রিয়তা দ্বারা এতই দূষিত যে আগামী বহু বছর ধরে এর জের রয়ে যাবে। সর্বোপরি তেজস্ক্রিয়তার অর্ধেক জীবন ১৬০০ বছর ধরা হয়।
তৎকালীন বিজ্ঞানের পুরুষতান্ত্রিক দুনিয়ায় একজন দরিদ্র পোলিশ অভিবাসী নারী হিসেবে মেরি অবিশ্বাস্যজনক ভাবে সফল ছিলেন। তার রেখে যাওয়া বৈজ্ঞানিক অবদান তেজস্ক্রিয়তার একক (কিউরি), এলিমেন্ট কুরিয়াম এবং একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান সবই তার নামানুসারে রাখা হয়। আজও যখন আমরা এক্স-রে মেশিনে পা রাখি তার অবদান অস্বীকারের উপায় আমাদের নেই। নারীদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার শুরুটা তিনি করে দিয়ে গিয়েছিলেন, যা কালে কালে প্রতিটি নারীর মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণার পথে অনুপ্রেরণা।
“ আমি শিখেছি, উন্নতির পথ দ্রুত বা সহজ নয়” – মেরি কুরি।