মানানাঙ্গাল: রহস্যময় এক প্রাণীর নাম

1534
0
শিল্পীর তুলিতে মানানাঙ্গাল। image source: devianart.com

ফিলিপাইন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির কথা আমরা প্রায় সবাই জানি। অনেকে ওখানে ঘুরতেও যান। তবে যেটা বেশীরভাগ মানুষই জানেন না তা হলো, আরবান লেজেন্ডের সংখ্যার দিক দিয়ে আমেরিকা আর জাপানের পর সম্ভবত এই দেশটিই সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে।

শহর বলুন আর গ্রাম, ফিলিপাইনে রয়েছে অসংখ্য আরবান লেজেন্ডস। ফিলিপিনো ভাষাতে এদেরকে বলা হয় ‘অশওয়াং’। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘রক্তচোষা’। যদিও এরা সবাই রক্ত খায় না। যাই হোক, ফিলিপিনো অশওয়াং বা আরবান লেজেন্ডদের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত এবং ভয়কর হিসাবে ধরা হয় ‘মানানাঙ্গাল’ কে। আমাদের আজকের আয়োজন এই অতিপ্রাকৃত প্রাণীকে ঘিরেই।

এখন প্রশ্ন আসতে পারতে, মানানাঙ্গাল আসলে কী? মানানাঙ্গাল হলো অভিশপ্ত কিছু মহিলা যাদের শরীর রাতের বেলা কোমড় থেকে আলাদা হয়ে যায়, হাতগুলো পরিণত হয় বাঁদুরের মতো ডানায়। কোমড়ের যে জায়গা থেকে শরীরটা বিচ্ছিন্ন হয় সেখান থেকে নাড়িভুড়িও বেরিয়ে থাকে। এজন্য একে ফিলিপাইনের বীভৎসতম অশওয়াং বলা হয়।

ক্যামেরায় ধরা পড়া অদ্ভুত প্রাণী। Image Source: www.pinterest.com

মানানাঙ্গাল গভীর রাতে আকাশে উড়ে বেড়ায়। যখনই কোনো বাড়ির জানালা খোলা দেখে তখনই এরা সেই জানালা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে। এদের জিহবা অনেক লম্বা হয়, সেই জিহবা এরা ঘুমন্ত মানুষের নাকের ফুটা বা খোলা মুখের ভিতর দিয়ে শরীরে প্রবেশ করায়।

শোনা যায় মানানাঙ্গাল, মানুষের হৃদপিন্ড, ফুসফুস, যকৃত, বৃক্ক ইত্যাদি খেয়ে ফেলে! গর্ভবতী মহিলার গর্ভে থাকা বাচ্চাদের ভ্রুণ এদের প্রিয় খাদ্য। দিনের বেলা মানানাঙ্গালেরা সাধারণ নারীর মতো আচরণ করে। তাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। এমনকি এদের অনেকে নাকি ঘর-সংসারও হয়, সন্তানও জন্ম দেয়।

যখন গভীর রাত হয়ে তখন ধীরে ধীরে তারা উঠে বসে এবং কাছের কোনো নির্জন এলাকায় গিয়ে মানানাঙ্গালের রূপ ধারণ করে। যে এলাকায় যায় এদের শরীরের বাকী অংশটা সেখানেই পড়ে থাকে। সাধারণত বাড়ির কাছের কোনো জঙ্গল বা নির্জন এলাকাতে এরা শরীরের বাকী অংশটাকে লুকিয়ে রাখে। সাধারণত এই কাজের জন্য মানানাঙ্গালদের প্রিয় জায়গা হলো কোনো কলা বাগান।

শিল্পীর তুলিতে মানানাঙ্গাল। Image Source: cevianart.com

ব্যাপারটার বিশেষ গুরত্ব আছে। কারণ শিকার শেষে সকালের আগে যদি মানানাঙ্গাল নিজের বাকী দেহের সাথে মিলিত না হয় তবে সে মারা যাবে! তাই শরীর লুকানোর সময় এরা সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাটাই বেছে নেয়। এখন প্রশ্ন হলো একজন মহিলা মানানাঙ্গাল হয় কী করে?

কথিত আছে, কোনো বয়স্ক মানানাঙ্গালদের গলার মধ্যে একটা কালো হাঁসের বাচ্চা থাকে। সেই হাঁসের বাচ্চাটাকে বের করে যদি তারা কোনো মুমূর্ষু মহিলার মুখের ভিতর দেয় এবং মহিলা সেটাকে আস্ত গিলে ফেলে, তাহলে ওই মহিলা বেঁচে যায় এবং পরবর্তীতে মানানাঙ্গাল হয়ে যায়।

বহু মহিলা নাকি নিজেদের জীবন বাঁচানোর জন্য স্বেচ্ছায় মানানাঙ্গাল হয়। মানানাঙ্গালদের মেরে ফেলার কী কোনো উপায় আছে? হ্যাঁ, বেশ কিছু উপায় আছে। আপনি যদি কোনো মানানাঙ্গালের ফেলে যাওয়া অবশিষ্ট শরীরের পাশে লবণ বা মরিচের গুঁড়া ছড়িয়ে দেন তাহলে সে সঠিক সময়ে ফিরেও আর ওই অংশের সাথে মিলিত হতে পারবে না। ফলে মৃত্যু হবে তার।

স্প্যানিশদের আগমন। Image source: www.pinterest.com

কিংবা কোনো মানানাঙ্গাল মাটি থেকে পাঁচ-সাত ফুট ওপরে থাকা অবস্থায় যদি তার পিঠের ভিতর একটা কাঠের তৈরী বর্শা ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তবেও তার মৃত্যু হবে। কোনো নারীর মুখের মধ্যে যদি সেই কালো হাঁসটা চলেই যায়, তবে তার মানানাঙ্গাল হওয়া আটকানোর উপায় হলো কোনো গাছের সাথে তাকে উল্টা করে ঝুলিয়ে লাঠি দিয়ে অনবরত পিটানো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মুখ দিয়ে হাঁসের বাচ্চাটা হয়ে আসে।

এই পদ্ধতিটি খুবই অমানবিক, এবং এক হিসাবে দেখা গেছে শুধুমাত্র ১৬৬৫ সালেই গোটা ফিলিপাইনে মানানাঙ্গাল সন্দেহে প্রায় সাড়ে ৫০০ নারীকে গাছের সাথে উল্টা করে পিটিয়ে মারতে মারতে মেরেই ফেলা হয়েছে। বর্তমানে মানানাঙ্গালের চিকিৎসার নামে ব্যবহৃত এই অমানবিক পদ্ধতিটি ফিলিপাইনে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে গ্রামগুলোতে এখনো নিয়মিতই অনেক নারী এমন নির্যাতনের শিকার হন। মানানাঙ্গালের কথা প্রথম উঠে আসে ১৫৩৩ সালে একজন হোসে রামিরেজ নামে একজন স্প্যানিশ যাজকের দিনলিপিতে। উনি লিখেছিলেন-

…ওই গ্রামে ঈশ্বরের বাণী প্রচার করতে গিয়ে রাতে আমাকে থেকে যেতে হয়েছিলো। ভোররাত্রি নাগাট হুট করেই গ্রামবাসীদের চিৎকার-চেঁচামিচিতে ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। তাবু থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি যে আকাশে বাদুড়ের মতো একটা বিশালাকৃতির একটা কিছু উড়ে যাচ্ছে। নিচে নেমে এলো ওটা, ভালো করে খেয়াল করলাম…ওটার শরীর মানুষের, নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আছে। হাত দুটো পাখনার মতো…মুখটা একটা মহিলার!

এর আগে এই অদ্ভুত অতিপ্রাকৃত জিনিসটি নিয়ে কেউই লেখেনি। ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও সত্যি যে, ১৫২১ সালে স্প্যানিশরা ফিলিপাইনে আসার আগে কেউই এই প্রাণীটিকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তাহলে? এমন কী হলো স্প্যানিশরা আসার পর? এটা বোঝার জন্য আপনাকে ওরা আসার আগের ফিলিপাইনকে ভালো করে বুঝতে হবে।

স্প্যানিশরা আসার আগে ফিলিপাইনের সমাজব্যবস্থায় নারী ও পুরুষের প্রায় সমান অধিকার ছিল। নারীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত যেত, নানান চাকরীতে যোগ দিত এবং চিকিৎসকেরা অধিকাংশই ছিল নারী। সেই সময়ে ফিলিপাইনের ধর্মবিশ্বাস ছিল কিছুটা শামানবাদী। অধিকাংশ শামানই ছিল নারী।

শামানদের অতিপ্রাকৃত চিকিৎসা। Image source: devianart.com

তারা মানুষের ভবিষ্যত বলতো, আত্মা হাজির করতো এবং নানান অলৌকিক কাজকর্ম নাকি ছিল তাদের নখদর্পনে। পরিবারে পুরুষের যতটুকু কর্তৃত্ব ছিল নারীরও ঠিক ততটুকুই ছিল। স্প্যানিশ মিশনারীরা আসার পর সবকিছু বদলে গেল। তারা নারীদের সমান অধিকারকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করতে লাগলো। যেসব নারীরা শামান ছিল তাদেরকে যাজকেরা ডাইনী বলতে লাগলো।

শুরু হলো এসব নারীদের পুড়িয়ে হত্যা এবং নির্যাতন। স্প্যানিশরা প্রচার করতো যে এরা রাতের বেলা পিশাচ হয়ে মানুষের ক্ষতি করে, এদের ওপর স্বয়ং শয়তানের আশীর্বাদ রয়েছে। এভাবেই মানানাঙ্গালের লেজেন্ডটি হুট করেই বিখ্যাত হয়ে যায়। এছাড়া,  অনেকক্ষেত্রে অসাবধানতাবশত বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্যও এই অতিপ্রাকৃত প্রাণীটিকেই দায়ী করা হয়।

শামানদের সাথে স্প্যানিশদের ধর্মীয় সংঘর্ষ। Image source: www.pinterest.com

ধীরে ধীরে নারীদেরকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেললো স্প্যানিশরা। যে নারীরা এর প্রতিবাদ করতেন তাদেরকেই ডাইনী বলা হতো।মানানাঙ্গালের আতংক সবচেয়ে বেশী ছিল আঠার শতকে। এই সময়ে অনেক ফিলিপিনো বাড়িতে জানালাই রাখা হতো না, যাতে করে মানানাঙ্গাল না ঢুকতে পারে। ছোট বাচ্চাদেরকে খুব সাবধানে রাখতেন তাদের মা-বাবা।

১৯২৭ সালে হোসে নেপোমুসিনো মানানাঙ্গাল নিয়ে ‘আং মানানাঙ্গাল’ নামে একটি সিনেমা নির্মান করেন। যেটি ১৯৩৬ সালের পর হুট করেই হারিয়ে যায়। এখনো সিনেমাটি কোথাও পাওয়া যায় না।

হোসে নেপোমুসিনো। Image source: www.pinterest.com

১৯৩২ সালের সিনেমা ‘আং অসওয়াং’তেও মানানাঙ্গালের চরিত্র ছিল। সম্প্রতি ২০১৬ সালে মানানাঙ্গালকে নিয়ে নির্মিত হয় চলচ্চিত্র ‘আং মানানাঙ্গাল এসএ ইউনিট ২৩বি’। সিনেমাটি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র পুরষ্কারও পেয়েছে। এছাড়া ফিলিপাইনের বিখ্যাত কমিক সিরিজ ‘ট্রেসে’ তে মানানাঙ্গাল নিয়ে অনেকগুলো কেস আছে।

এটি মূলত একটি এমন সিরিজ যেখানে একজন নারী গোয়েন্দা একাধিক অতিপ্রাকৃত রহস্য সমাধান করে। মূলত ফিলিপাইনের আরবান লেজেন্ডগুলোকে এই কমিকে তুলে ধরা হয়েছে। এটি নিয়ে নেটফ্লিক্সেরও একটি সিরিজ নির্মানের কথা রয়েছে।

চলচিত্র ‘আং মানানাঙ্গাল এসএ ইউনিট ২৩বি’। Image Source: Imdb.com

তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাইরে কেউই তেমন এই আরবান লেজেন্ডটি সম্পর্কে জানে না।  করোনার লকডাউনের সময়ে ফিলিপাইনের বিভিন্ন টিভি চ্যালেন তাদের আরবান লেজেন্ডগুলো নিয়ে একাধিক টিভিশো নির্মান করেছিল। সেগুলোতেও অনেকবার মানানাঙ্গালের কথা আসে।

২০১৭ সালের দিকে দারাগা নামের একটি গ্রামে প্রায় দেড়শো গ্রামবাসী মিলে অ্যানা নামের চব্বিশ বছর বয়সী একটি মেয়েকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। গ্রামবাসীর দাবি ছিল যে মেয়েটি একটি মানানাঙ্গাল, ওর ঘরে ছোট বাচ্চাদের মাথা আছে। কিন্তু পরে পুলিশ ওই ঘরে কিছু শুকনো রুটি আর মাংস পেয়েছিল।

 

‘ট্রেসে’ কমিক। Image source: www.pinterest.com

খুবই গরীব ছিল মেয়েটি। পতিতাবৃত্তিরও অভিযোগ ছিল তার নামে। পরে প্রমাণিত হয় যে, গ্রামের এক প্রভাবশালী পরিবারের ছেলের সাথে তার সম্পর্ককে ধামাচাপা দিতেই এই হত্যাকান্ড। যদিও সেই ছেলেটি বা ওই প্রভাবশালী পরিবারের এখনো বিচার হয়নি।

যুগের পর যুগ এভাবেই পুরনো কিংবদন্তীগুলোকে মানুষ নিজেদের ফায়দার জন্য ব্যবহার করেছে। মানানাঙ্গাল আছে কি না আছে সেটা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু পৃথিবীতে কিছু নিষ্ঠুর মানুষ আছে।

Feature Image: devianart.com
তথ্যসূত্র:

01. Chasing the manananggal, a Filipino demon.
02. 17 Facts About The Manananggal.