‘Ice Age’ নামক অ্যানিমেটেড মুভির কথা মনে আছে? সেখানে ‘ম্যানি’ নামের বিশাল দাঁতের অধিকারী লোমশ এক প্রাণী চরিত্র দেখতে পাওয়া যায়। অনেকেই একে হাতি বলেই ধরে নিয়েছে। কিন্তু আপনি জানেন কি? ‘ম্যানি’ কিন্তু হাতি নয়! এটি একটি ম্যামথ। দেখতে হাতির মতোই; তবে অতিকায় দেহের একটি প্রাণী।
পৃথিবী থেকে চার হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছে বরফ যুগের এই প্রাণী। গবেষকদের ধারণা, পঞ্চাশ লক্ষ বছর আগে থেকে পৃথিবীতে এরা বিরাজমান ছিল। আদিমযুগে মানুষদের আঁকা গুহাচিত্রেও ম্যামথদের দেখা মিলেছে অনেকবার। কালের অতলগর্ভে ডাইনোসরের মতই হারিয়ে গিয়েছে ম্যামথ।
কিন্তু কেন? এর পিছে কারণগুলো কারো সঠিকভাবে জানা আছে কি? এরা কি আদিম যুগের মানুষের অত্যাধিক শিকারের জন্য বিলুপ্ত হয়েছে? নাকি জলবায়ুর রাতারাতি পরিবর্তন এদের বিলুপ্ত হওয়ার জন্য দায়ী? নাকি অন্য কোন কারণ লুকিয়ে আছে এর পেছনে? ম্যামথ নামের এই অতিকার প্রাণীর হারিয়ে যাওয়ার গল্প জানি চলুন।
ম্যামথ কী?
ম্যামথের হারিয়ে যাওয়ার গল্প শুরু করার আগে ছোট্ট করে ম্যামথের ইতিহাসের সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক। ম্যামথ, (জেনাস Mammuthus), অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকা ছাড়া প্রতিটি মহাদেশে প্লাইস্টোসিন এবং উত্তর আমেরিকার প্রাথমিক হলোসিনে জীবাশ্ম হিসাবে পাওয়া হাতির একটি বিলুপ্ত গোষ্ঠীর সদস্য। প্লাইস্টোসিন যুগ ২.৬ মিলিয়ন বছর আগে শুরু হয়েছিল এবং ১১৭০০ বছর আগে শেষ হয়েছিল। হলোসিন যুগ ১১৭০০ বছর আগে শুরু হয়ে বর্তমান পর্যন্ত অব্যাহত।
ম্যামথ যেহেতু হাতি গোষ্ঠীর সদস্য তাই একে দেখতে হাতির মতো লাগবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আপাতদৃষ্টিতে হাতির মতো দেখতে হলেও কিছু পার্থক্য তো আছেই! একটি ম্যামথের দেহের ওজন দুইটি হাতির সমান ছিল। এদের ওজন ৫-১০ টন হতো এবং ৩-৫ মিটার লম্বা।
ম্যামথের মধ্যে সেরা হচ্ছে উলি ম্যামথ। উলি ম্যামথ প্রায় ২০০-৩০০ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে এসেছিল। প্রত্নতত্ববিদদের গবেষণা অনুসারে তাদের জন্মভূমি ছিল সাইবেরিয়া। তবে সেই সময় এখানে জলবায়ু মোটেই ঠান্ডা ছিল না। শীতকালে খুবই হালকা ঠাণ্ডা বইতো।
ম্যামথের সর্বশেষ আবাস্থল
লোমশ এই প্রাণীর অধিকাংশের মৃত্যুকাল আজ থেকে সাড়ে ১০ হাজার বছর আগে। তবে একটি গবেষণার মাধ্যমে জানা যায় যে, তাদের একটি দল পরবর্তী ৫ হাজার বছরের বেশি সময় ধরে বেরিং সাগরের কাছে সেন্ট পল দ্বীপে টিকে ছিল এবং সর্বশেষ দলটি রাশিয়ার উত্তর-পূর্ব প্রান্তসীমার একটি দ্বীপ র্যাঙ্গেলে বেঁচে ছিল; যা প্রায় ১২৫ কিলোমিটার প্রশস্ত এবং আয়তনে প্রায় ৭,৬০০ কিলোমিটার।
দ্বীপটি প্রায় ৯,০০০ বছর আগে একটি প্রাকৃতিক তুষারসেতুর মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল৷ ১২,০০০ থেকে ৯,০০০ বছরের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সেই সেতুটি আর টিকে থাকেনি। ফলে দ্বীপটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, চীন, স্পেন এবং মেক্সিকোয় ম্যামথের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়।
ম্যামথ যেভাবে হারিয়ে গেল
পৃথিবী সৃষ্টির সেই শুরু থেকেই অনেক পশু প্রাণী বসবাস করতো। ধীরে ধীরে এদের অধিকাংশই বিলুপ্ত হতে শুরু করে। ম্যামথও বাদ পরেনি এই বিলুপ্ত চক্র থেকে। এদের মধ্যে সবশেষে টিকে ছিল লোমশ ম্যামথ প্রজাতি। ধারণা করা হয়, এরা বর্তমান হাতিদের পূর্বপুরুষ। আকারে তারা হাতিদের চেয়ে একটু বড়। এদের বিশাল দাঁত, লোমে ভরা দেহ আর বড় শুঁড় দেখেই পার্থক্য করা যেত। তাদের বড় বড় বাঁকাবাঁকা দাঁত যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত হতো। এছাড়াও তুষারের নীচে থেকে, ঝোপঝাড়, ঘাস, শিকড় এবং অন্যান্য ছোট গাছপালা খুঁজে খাওয়ার জন্যেও ব্যবহৃত হতো।
ম্যামথ ঠিক কোন কারণে বিলুপ্ত হয়েছিল তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, মানুষের অত্যধিক শিকারের কারণেই হারিয়ে গেছে তারা। ম্যামথ শিকারের মাধ্যমে মাংস পাওয়া যেত যা ছিল অনেক বেশি পরিমাণে। এছাড়াও ম্যামথের হাড় অস্ত্র এবং দাঁত বিভিন্ন অলঙ্কার তৈরির কাজে ব্যবহার করা হতো। তবে তাদের হারিয়ে যাওয়ার পেছনে এটি একটি কারণ হলেও একমাত্র বা প্রধান কারণ নয়। কেননা, বহু জায়গায় মানুষের আগমনের আগেই ম্যামথ বিলুপ্ত হয়েছিল।
গবেষকদের একটি দল মনে করেন, বরফযুগের শেষে এসে আবহাওয়ায় বিরাট এক পরিবর্তন আসে। এসময় বিশাল তৃণভূমি ক্রমশ বনে ঢেকে যেতে শুরু করে। ম্যামথরা তখন বিপাকে পড়ে যায় কারণ প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা দেয়া শুরু করে। এরা খাদ্যাভাবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং আলাদা হয়ে যেতে শুরু করে। এমন বিচ্ছিন্নতা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
পৃথিবীর তাপমাত্রা তখন ক্রমশ বাড়ছিল। ম্যামথরা যেহেতু ছিল বরফযুগের প্রাণী তাই তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বরফযুগের অবসান হওয়ায় তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা বেশ কঠিন হয়ে গিয়েছিল। তারা পরিবর্তিত তাপমাত্রায় টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল। এছাড়াও একটি গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, একটি ম্যমথের দৈনিক গড়ে ৭০ থেকে ২০০ লিটার পানির প্রয়োজন ছিল। শিকারে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং পানির অভাবে তারা বিলুপ্ত হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে থাকে।
এছাড়াও ম্যামথের বিলুপ্তির পেছনে আরও কিছু সম্ভাব্য কারণ আছে ধারণা করা হয়। এগুলো হচ্ছে-
- নতুন কোনো রোগজীবাণুর আক্রমণ হয়েছিল ম্যামথদের মাঝে।
- মহামারি বা বড় কোনো দুর্যোগ।
- ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা কমে গিয়ে জিনবৈচিত্র্য হ্রাস পেয়ে বিলুপ্তি হয়।
তবে এগুলোর কোনোটারই পক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ নেই। তাই এই কারণগুলো অনুমেয় হিসাবে ধরা হয়।
সাইবেরিয়ার বিশাল বরফ ঢাকা অঞ্চলে বিলুপ্ত প্রজাতির উলি ম্যামথের অন্তত কোটি মৃতদেহ ঢাকা পড়ে আছে বলে গবেষকরা ধারণা করেন। কারণ আলাস্কা ও সাইবেরিয়ায় এখনও বিপুল পরিমাণে ম্যামথের দাঁত কিংবা হাড়-কঙ্কাল পাওয়া যায়। এসব অঞ্চলের অধিবাসীরা কুড়িয়ে পাওয়া দাঁত দিয়ে অনেক ডিজাইনের অলঙ্কার বানায়। এখানে মাটির নিচ থেকে বছরে প্রায় ৫০ টনের কাছাকাছি ম্যামথের দাঁত উদ্ধার করা হয়েছিল। এ থেকে ধারণা করা যায়, ম্যামথের একটি বড় অংশ এই অঞ্চলে বসবাস করতো।
ম্যামথের নিকটবর্তী প্রজাতি এশীয় হাতি এখনও পৃথিবীতে বর্তমান আছে। তাই কিছু বিজ্ঞানী ম্যামথকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। ইতোমধ্যে সাইবেরিয়া অঞ্চলের বরফের ভেতর থেকে ম্যামথের ফ্রোজেন ডিএনএ-র নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেখান থেকেই নানা প্রক্রিয়ায় ক্লোন করার চেষ্টা চলছে। কে জানে, হয়তো আগামীতে দেখা মিলতেও পারে কয়েক হাজার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া এই প্রাণীর! যদিওবা সম্ভব হয়ও, তারা এখনও কি টিকতে পারবে? খাপ খাওয়াতে কি পারবে এই পরিবর্তিত পরিবেশে, যেখানে পূর্বে টিকে থাকতে পারেনি?
Feature Image: iStock
তথ্যসুত্র: