মাল্টা: এক ইউরোপিয়ান দেশের আদ্যোপান্ত

370
0

পৃথিবীতে একেক দেশের একেক সংস্কৃতির ছড়াছড়ি। এমনও কিছু দেশ আছে যার সম্পর্কে অনেকেই অবগত নয়, কিন্তু ওই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি বেশ প্রাচীন। অন্যান্য দেশের তুলনায় এটি বেশ ছোট একটি দেশ, এবং সারা বিশ্বে মাল্টা দেশটি ক্ষুদ্রতম দেশ হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছে।

মাত্র ৩১৬ বর্গ কিঃমিঃ এর এই দেশটি ইতালির সিসিলি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। পাঁচটি ছোট্ট দ্বীপ নিয়ে গঠিত ই দেশ নিয়ে আজ জানবো এই দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, জনসংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে।

মাল্টার জাতীয় পতাকা। Image Source: pinterest.com

মাল্টা দেশের নামকরণের ইতিহাস

মাল্টা নামটি মূলত গ্রিক বা পোয়েনিসিয়ান ভাষা থেকে আগত। সাধারণত এই দুই ভাষার সংস্কৃতির মধ্যে বেশকিছু মিল রয়েছে। জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দে গ্রিকরাই সর্বপ্রথম এই দেশে পা রাখেন। গ্রিকরা যে দ্বীপে আসেন সেই দ্বীপের নাম ছিল মেলিটা। মেলিটা অর্থ মধু। এই দেশটি নিয়ে কথিত আছে যে এই দেশে আগে প্রচুর পরিমাণে মধু উৎপন্ন হতো।

আবার পোয়েনিসিয়ান ভাষায় একে বলা হতো ম্যালেথা, যার অর্থ স্বর্গ। রূপক অর্থে নয়, দেশটির সৌন্দর্য স্বর্গের প্রায় কাছাকাছি হিসেবেই ধরে নিয়েছিল তারা। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আবহাওয়া, পরিবেশ ইত্যাদির দিক থেকে বিবেচনা করলে এই দেশের অবস্থান অন্যান্য দেশের তুলনায় বহু এগিয়ে। মেলিটা কিংবা ম্যালেথা থেকেই এর নাম মাল্টাতে উৎপন্ন হয়।

মাল্টার মানচিত্র। Image Source: pinterest.com

মাল্টা দেশের ভাষা মাল্টা হলেও বর্তমানে এর সরকারি ভাষা ইংরেজি করা হয়েছে। ইংরেজিতে হলেও এখানকার নাগরিকেরা মাল্টা ভাষাতেই বেশি কথা বলে থাকে। স্কুল, কলেজে এরা সাধারণত ইংরেজিতেই কথা বলে থাকে।

এখানে প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ ইংরেজিতে কথা বলে। এছাড়া ৬৬ ভাগ মানুষ ইতালি ভাষায় এবং ১৭ ভাগ মানুষ ফরাসি ভাষায় কথা বলে থাকে। অনেকে জার্মানিতেও কথা বলে, তবে এর সংখ্যা খুবই কম।

মাল্টার রাজধানী ভালেট্টা

ভালেট্টাকে বলা হয় মাল্টার রাজধানী। এই শহরটি বেশ প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক। ইতিহাস থেকে উঠে এসেছে প্রায় সাড়ে চারশত বছর আগে এই শহরের উৎপত্তি ঘটে। এই শহরের নামকরণ করা হয় গ্র্যান্ড মাস্টার প্যারিজো দে লা ভালেট্টার নামানুসারে।

এই নামটি মূলত একটি প্যালেসের নাম, আর এর চমৎকার আকর্ষণের কারণে এটি রাজধানীর নামকরণে স্থান লাভ করে। এটি ভালেট্টা শহরের সবচেয়ে সুন্দর এবং আকর্ষণীয় প্যালেস হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

মাল্টার রাজধানী ভালেট্টা। Image Source: thetelegraph.com

এই প্যালেসটির একটি অংশ বর্তমানে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা যায়। এবং বাকি অংশ পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হয়েছে। ছোট্ট এই ভালেট্টায় কিন্তু প্রাচীন নিদর্শনের অভাব নেই। চলতে ফিরতে এখানে প্রায় তিনশোর মতো প্রাচীন গির্জা, দুর্গ, প্রাসাদের দেখা মিলবে। এই শহর এমন একটি শহর যা একজনকে পায়ে হেঁটে দেখতে হবে। আর এতে সে দেখা পাবে পৃথিবীর আদি নিদর্শনের একটি চমৎকার শহর।

মাল্টা দেশের দ্বীপ

মাত্র ৩১৬ বর্গকিলোমিটারের এই দেশটি তিনটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। মাল্টা, গোজো ও কোমিনো এই তিন দ্বীপ নিয়ে মাল্টা দেশের অবস্থান। ছোট দেশ হলে কি হবে, এর সৌন্দর্য, দ্বীপের আবহাওয়া অন্যান্য দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। তাহলে জেনে নেয়া যাক এই দেশের দ্বীপ নিয়ে নানান অজানা তথ্য!

গোজো

মাল্টার ছোট একটি দ্বীপ এটি। এই দ্বীপের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু জানা-অজানা গ্রাম। রয়েছে মানুষের বাস। এই দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেকটাই রঙ তুলিতে আঁকা ছবির মতো। এই গ্রামের লোকেরা সাধারণত মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বেশ শান্ত, নিরিবিলির বলে এই দ্বীপে ছুটি কাটাতে ছুটে আসেন নানান দেশের নানান পর্যটকেরা।

এই দ্বীপের কিছু দর্শনীয় স্থান হচ্ছে, গগন্তিজার মন্দির, প্রিন্সটিন বীচ, প্রাকৃতিক বেশ কিছু দুর্গ। এই দ্বীপের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হচ্ছে প্রাকৃতিক চুনাপাথরে সৃষ্ট আজুরে উইন্ডো যা এই দ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত।

মাল্টার একটি দ্বীপের সৌন্দর্য। Image Source: pinterest.com

কোমিনো

এই দ্বীপটি বেশ ছোট একটি দ্বীপ , কিন্তু এর সৌন্দর্য এতোটাই যে কেউ এখানে আসলে আর যেতে চাইবে না। দ্বীপটি বিখ্যাত মূলত এর নীল স্বচ্ছ পানির জন্য। মাল্টা দেশের তিনটি দ্বীপের মধ্যে এই দ্বীপটি ব্লু লেগুনের কারণে সারা বিশ্বে আলোচিত হয়ে আছে। এর চারপাশে শিলায় আবিষ্ট যার কারণে পর্যটকদের আকর্ষিত করে তুলে।

যদি কেউ এই দ্বীপ ভ্রমণ করে তাহলে এই দ্বীপের বালি, নীল পানি ইত্যাদির জন্য মনকে আবার ফিরে পেতে চাইবে। সার্ফিং বা স্কুবা ডাইভের জন্য এটি আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে পর্যটকদের কাছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বেশ এগিয়ে থাকার কারণে এটিকে ন্যাচারাল রিজার্ভ ফরেস্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

মাল্টা

এই দ্বীপের আয়তন অন্যান্য দ্বীপের তুলনায় বেশ ছোট। এই দ্বীপে রোমান, বাইজেন্টাইন, আরব সৈন্যদের বেশ কিছু স্মৃতি রয়েছে। ঐতিহাসিক বাইজন্টাইন সাম্রাজ্যের গড়পতন ঘটে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাল্টার পূর্ব অংশ রোমানের অধীনে ছিল এবং পরবর্তীতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এসে শাসন চালায়। বহু ইতিহাস পেরিয়ে এই দেশে আগমন ঘটে ইংরেজদের এবং সর্বশেষ নিজেদের দেশে নিজেরা শাসনের সুযোগ পায় এবং জন্ম নেয় মাল্টার।

মাল্টা দেশের প্রধান দ্বীপ হচ্ছে মাল্টা। এছাড়া মাল্টা দেশের অন্যতম একটি পরিচিত শহর হচ্ছে রাবাত। এই শহরের ইতিহাসের যেন শেষ নেই! এই শহরকে অতিতে বলা হত রোমান সিটি অফ মেলটা। অন্যান্য শহরের তুলনায় এটি অনেকটাই এখন এগিয়ে আছে।

বর্তমানে রাবাতকে বলা হয় বাণিজ্যের শহর। রয়েছে সেন্ট পলস শিপরেক নামক এক বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক চার্চ। মাল্টা দেশে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন গির্জা, তন্মদ্ধে এই গির্জাটি অন্যান্য সকল গির্জা থেকে বেশ ঐতিহাসিক।

মাল্টায় গড়ে তোলা গির্জা। Image Source: pinterest.com

এই গির্জার নামকরণের পেছনে রয়েছে এক ইতিহাস। জানা যায়, ৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেন্ট পল নামের এক ধর্মযাজক ধর্মের প্রচার করতে এই শহরের এক সাগরে এসে তার জাহাজের নোঙর তোলেন। তখন তার এই শহরে আসার ঘটনাটিকে সবার মনে চিরদিনের জন্য গেঁথে রাখার জন্য এই গির্জা তৈরি করা হয় এবং এর নামকরণ করা হয় তার নামের সাথে মিল রেখে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, মাল্টা দেশের যে আরও গির্জা রয়েছে তার থেকে এর সৌন্দর্য প্রায় হাজার গুণ বেশি। এর অত্যন্ত মনোরম সৌন্দর্য, পরিবেশ, নানান সবুজের সমারোহ যে কারো মন আকর্ষিত করার জন্য যথেষ্ট। এই গির্জার অন্যতম দিক হচ্ছে এর এক পাশে গড়ে উঠা পানির ফোয়ারা।

ইতিহাসের পাতায় মাল্টা

সাধারণত ভৌগলিক কারণে অনেক অনেক বছর আগে থেকেই মাল্টার নাম ইতিহাসের পাতায় উঠে এসেছে। এদেশের নানান ঐতিহাসিক কারণে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে আসছে। এই ছোট দেশটি বহু শাসক দ্বারা শাসিত হয়ে এসেছে।

১৯৪২ সাল নাগাদ এই দেশে প্রায় তিনবার বোমা নিক্ষেপ করা হয়। আর সেই বোমা গির্জার উপর আঘাত হানে। যদিও এতে তৎকালীন বেশকিছু যাজক উপস্থিত থাকার পরেও তাদের কিছু হয়নি বরং এই ঘটনার পর সেই গির্জাটি এরও বিখ্যাত হয়ে উঠে।

এই দেশটি এক সময় রোমানরা শাসন চালায়। ২১৮ খ্রিস্টাব্দে এই দেশ রোমানদের অধীনে চলে আসে এবং এরা চতুর্থ শতকে মাল্টাকে পূর্ব ও পশ্চিম দুইটি অংশে ভাগ করে দেন। মাল্টার যে অংশ রোমানের অধীনে ছিল তা বর্তমানে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করে আছে।

মাল্টার সৌন্দর্য। Image Source: pinterest.com

নানান ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে ইতিহাসের পাতায় সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা এই দেশটি নিয়ে যতোই বলা হোক না কেন, এ যেন আরও তৃপ্তির অংশ রেখে দেয়। এর পরিবেশ, আবহাওয়া, সংস্কৃতি, দেশের নানান গল্প সারা বিশ্বে জীবন্ত হয়ে থাকবে চিরকাল।

এ দেশের সৌন্দর্য যেন দেশ-বিদেশের পর্যটকদের মনে জায়গা করে রেখেছে, তেমনি ভ্রমণ পিপাসু লোকদের কাছে কৌতূহলের দেশ হিসেবে রয়ে যাবে তাদের হৃদয়ে।

Feature Image: letterstobarbara.com  
Reference: 

01. Malta. 
02. Malta.