মাদ্রিদ: ক্যাপিটাল অব স্পেন

517
0

মাদ্রিদ! ফুটবলপ্রেমীরা নামটা হরহামেশাই শুনে থাকেন। অনেকে তো এটাও মনে করতে পারেন যে, মাদ্রিদকে ফুটবলই পরিচিত করেছে দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে। কিন্তু ফুটবল ছাড়াও মাদ্রিদ শহরটির পরতে পরতে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যের ছোঁয়া। যেগুলো মাদ্রিদকে যুগ যুগ ধরে পরিচিতি দিয়ে আসছে বিশ্ববাসীর কাছে।  

জনসংখ্যা ও ভৌগলিক অবস্থান 

স্পেনের মানচিত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, মাদ্রিদ ভৌগোলিকভাবে কতটা উন্নত। ভৌগোলিকভাবে স্পেনের ঠিক মাঝখানেই মাদ্রিদের অবস্থান। এই ভৌগলিক অবস্থানের সুবাদে স্পেনের রাজধানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে দীর্ঘ কাল থেকে। স্পেনের এই প্রদেশটিকে আংশিক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। মাদ্রিদ শহরের ভৌগোলিক আয়তন প্রায় ৬০৪ বর্গ কিলোমিটার। এই আয়তনের মধ্যেই আনুমানিক ৬৫ লক্ষ মানুষের বাস। 

এটা বলা-ই যায় যে, স্পেনের সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর মধ্যে মাদ্রিদ একটি। তবে শুধু স্পেনের নয়, জনসংখ্যার বিচারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশগুলির মধ্য লন্ডনবার্লিনের পরে মাদ্রিদের অবস্থান। শহরটির পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে মানসানারেস নদী প্রবাহিত হয়েছে এবং উত্তরে পাইন বৃক্ষে আবৃত পর্বতমালা গুয়াদাররামা ঘিরে রেখেছে। শিক্ষার দিক থেকেও স্পেনের কেন্দ্র মাদ্রিদ। তাছাড়া, মাদ্রিদের যোগাযোগ ব্যবস্থা মাদ্রিদকে ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। 

মাদ্রিদের সিটি সেন্টার। Image Source: independant.co.uk

মাদ্রিদের পর্যটন 

মাদ্রিদের পর্যটন কতটা বিখ্যাত তা ঢালাও করে না বললেও চলবে। তাছাড়া মাদ্রিদ শহরটি কম পুরোনো নয়। তবে স্প্যানিশদের যত্নশীলতার ফলস্বরূপ আজও শহরটি পুরনো ঐতিহ্য ও শিল্পের আঁচড়ে ভরপুর। তাছাড়া মাদ্রিদের জাদুঘরগুলো শৈল্পিক নিদর্শনে ঠাসা। আপনি ইউরোপের শ্রেষ্ঠ চিত্রকলা প্রদর্শনীগুলির খোঁজে থাকলে আপনাকে মাদ্রিদের প্রাদো জাদুঘর-এ যেতেই হবে। 

তাছাড়া মাদ্রিদের রেইনা সোফিয়া জাদুঘর এবং তিসেন-বোর্নেমিসা জাদুঘর-এ অনন্য শিল্পকর্মগুলো সংরক্ষিত আছে। জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রধান কার্যালয়ও মাদ্রিদে। জাদুঘর, লাইব্রেরী, উদ্যান এবং নান্দনিক দালানসহ বিভিন্ন নিদর্শন মাদ্রিদকে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে ব্যাপক খ্যাতি এনে দিয়েছে। শুধুমাত্র মাদ্রিদের রয়েল প্যালেস দেখতে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ পর্যটক ভিড় করে এই প্রাসাদে। 

মাদ্রিদের স্থাপনা 

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা, ভাস্কর্য এবং কারুকার্যমন্ডিত ভবনগুলো। উন্মুক্ত স্থান হিসাবে মাদ্রিদের আরেকটি বড় আকর্ষণ পুয়ের্তো দেল সল। যেটাকে বাংলায় সূর্যের প্রবেশদ্বার বলা হয়। এই চত্বরটিকে মাদ্রিদের হৃৎকেন্দ্রও বলা হয়। 

এখানকার রাজকীয় প্রাসাদ, গির্জা, মঠ ও সরকারী ভবনগুলোর বয়স চারশো বছরেরও অধিক। মাদ্রিদে ৪০টিরও বেশি নগর উদ্যান রয়েছে। বুয়েন রেতিরো হচ্ছে মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় উদ্যান। 

মাদ্রিদের পুয়ের্তো দেল সোলের রাতের রূপ। Image Source: culturetrip.com

মাদ্রিদের রয়েল প্যালেস

মাদ্রিদের স্থাপনাগুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে সবার প্রথমে মাদ্রিদের রয়েল প্যালেসের নাম চলে আসে। মূল শহরের কিছুটা দূরে, ১ লাখ ৩৫ হাজার বর্গমিটার জমির উপর নির্মিত এই প্রাসাদ স্পেনের রাজার বাসস্থান ছিল একসময়। ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যের চমৎকার নিদর্শন এই প্রাসাদ। কোনো এক ইতালিয়ান ডিজাইনারের সৃজনশীলতার ফসল এই সুবিশাল প্রাসাদটি। পশ্চিম ইউরোপের সব থেকে সুন্দর প্রাসাদগুলোর মধ্যে এই রাজপ্রাসাদকে অন্যতম না বললেই নয়। 

বলা হয়ে থাকে, আপনি যদি মাদ্রিদ ভ্রমণে যান, কিন্ত রয়েল প্যালেস না দেখে আসেন, তাহলে আপনার মাদ্রিদ ভ্রমণ বৃথা। দামি মার্বেল পাথর, ইট, কাচ এবং লোহার সমন্বয়ে তৈরি এই প্রাসাদকে পাহারা দেওয়ার জন্য ঐতিহ্যবাহী ঘোড়াও যেমন ব্যবহার করা হয়, তেমনই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও ব্যবহার হয়। সারা বছরজুড়ে দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকলেও, সরকারি উৎসবের দিনগুলোতে অন্যরকমভাবে সেজে উঠে এই রাজপ্রাসাদ।  

মাদ্রিদের ইতিহাস 

আগেও বলেছি মাদ্রিদের ইতিহাস বেশ পুরোনো। তবে ১০ম শতক থেকে মাদ্রিদ নিয়ে লিখিত ইতিহাস পাওয়া গেছে। সেই ইতিহাসের শুরুর দিকে এই নগরীর নাম সম্ভবত মাহেরিত ছিল। তখন এই শহর শাসন করতো স্পেনীয় মুসলমান শাসকরা। পরবর্তীতে খ্রিস্টান রাজা ৬ষ্ঠ আলফোনসো মুসলমানদের কাছ থেকে ১০৮৩ সালে শহরটি নিজের দখলে নেয়। 

এরপর ১৫৬১ সালের দিকে স্পেনের রাজা ফিলিপ মাদ্রিদেই স্পেনের রাজদরবার স্থাপন করেন। এবং ১৬০৭ সালে মাদ্রিদ আনুষ্ঠানিকভাবে স্পেনের স্থায়ী রাজধানীর মর্যাদা পায়। এই শহর ফরাসিরাও শাসন করেছিল। তবে স্প্যানিশরা বেশিদিন সহ্য করেনি ফরাসিদের। মাদ্রিদের অধিবাসীরা ফরাসি সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করলে, ১৮১২ সালের দিকে মাদ্রিদ আবারও স্পেনের নিয়ন্ত্রণে আসে। 

প্রাচীন মাদ্রিদের রূপ। Image Source: madrid.info

মাদ্রিদের সাংস্কৃতিক জীবন 

মাদ্রিদ ভৌগলিকভাবে উন্নত হওয়ার কারণে এখানে নানান ধাঁচের মানুষের আগমন হয়েছে যুগ যুগ ধরে। যেটা মাদ্রিদকে সাংস্কৃতিকভাবে আরো সমৃদ্ধ করেছে। মাদ্রিদের ফিল্ম থিয়েটারের হলগুলো এখনো কানাই কানাই পূর্ণ থাকে।  আধুনিক সংস্কৃতি, ফিল্ম, থিয়েটার এবং সঙ্গীতের ব্যাপক চর্চা দেখা যায় এখানে। 

মাদ্রিদে ঐতিহ্যবাহী ষাঁড়-এর লড়াই এখনো বহুল জনপ্রিয়। প্রায় ২৫০০০ মানুষের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন লাস ভেনটাস হচ্ছে স্পেনের  সবচেয়ে বড় বুলিং স্টেডিয়াম। তবে মাদ্রিদবাসী ব্যাপক ফুটবলপ্রেমী। রিয়াল মাদ্রিদ এবং অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ-এর মতো বড় বড় দুটি ক্লাব এই শহরেই গড়ে উঠেছে।  

মাদ্রিদে জনজীবন

ইউরোপের ব্যয়বহুল শহরগুলোর মধ্যে মাদ্রিদ অন্যতম বললেই চলে। জীবনযাত্রা উন্নত এবং আধুনিক হলেও, এখানে থাকতে হলে আপনাকে মোটা অংকের ব্যয়ভার বহন করতে হবে। এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা অনেকেই ব্যবসায়ী। আর যারা চাকুরীজীবী রয়েছে তাদের মধ্যে অনেকে একাধিক চাকরিও করে। তবে সামগ্রিক দিক বিবেচনা করলে মাদ্রিদের জনজীবন বেশ উন্নত। বিশ্বের শীর্ষ ১০টি বসবাসযোগ্য স্থানগুলোর মধ্যে মাদ্রিদ রয়েছে। 

দৃষ্টিনন্দন মাদ্রিদ। Image Source: brittanica.com

মাদ্রিদে কেমন আছে বাংলাদেশীরা?

আপনি কোনো এক সকালে ঘুম থেকে উঠলেন, উঠেই সাইন বোর্ডে বাংলায় বড় বড় করে লিখা অরুণ হেয়ার কাটিং নামের একটা সেলুনে ঢুকে চুল ছেটে নিলেন। এরপর একজন দোকানদারের সাথে বাংলায় কুশল বিনিময় করে আলু, পটলসহ বাঙালি সব সবজি কিনে বাড়িতে চলে এলেন। আপনার সারাটা দিন বাঙালিয়ানায় কাটলো, কিন্ত আপনি রয়েছেন ইউরোপের কোনো এক আধুনিক শহরে। কেমন হবে ব্যাপারটা? 

আপনি যদি স্পেনের মাদ্রিদে থেকে থাকেন তাহলে ব্যাপারটা দুরূহ কিছু না। মাদ্রিদের লাভাপিয়েস নামের এমন একটি অঞ্চল রয়েছে, যেই অঞ্চল জুড়ে যেন বাঙালিয়ানার শোরগোল। রাস্তায় হাঁটতে বের হলে দেখা হয়ে যায় আরেক বাঙালির সাথে। লাভাপিয়েসের অলিগলিগুলোতে এরকম বাঙালি আড্ডার দেখা পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।  

মাদ্রিদের লাভাপিয়েস অঞ্চল। Image Source: planethotels.com

আনুমানিকভাবে বলা যায়, দশ থেকে বারো হাজার বাঙালির বাসস্থান এই লাভাপিয়েস অঞ্চল। সেইখানে আপনি চাইলে চর্চা করতে পারবেন বাংলা ভাষার। প্রবাসী বাংলাদেশীদের উদ্যোগে সপ্তাহে দুই দিন করে বাংলা ভাষা শেখানো হয় এই শহরে। বলা যায় লাভাপিয়েস অঞ্চলে একটা মিনি বাংলাদেশের সৃষ্টি করেছে প্রবাসী বাংলাদেশীরা। 

ভ্রমণপিপাসুদের জীবনে একবার হলেও মাদ্রিদ ভ্রমণে যাওয়া উচিত। মাদ্রিদের শৈল্পিক সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে বেশিক্ষণ প্রয়োজন হবে না আপনার। 

 

Feature Image: viator.com 
References: 

01. Madrid National Capital, Spain. 
02. Madrid: The Capital City with a Thousand Options. 
03. Madrid.