অপরাধ করা মানেই নির্ঘাত জেল। আর জেলখানা শুনলেই আমাদের মাথায় আসে এক অন্ধকার, জানালাবিহীন ঘরের কথা। যেখানে কয়েদীকে আটকে রাখা হয় অপরাধ করার শাস্তিস্বরূপ! কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবেছি এই অপরাধীদের আটকে রাখা ঘর, এই জেলখানাটিই বেশ বিলাসবহুলও হয়ে থাকে?
এমন কঠিন জীবনেও বিলাসিতা করার কথা ভাবাটা যেন এক অন্যরকমের রোমাঞ্চকর ব্যাপার! আজকে জানবো এমন কিছু জেলখানার গল্প, যাতে কয়েদীর জন্য এমন ব্যবস্থা করে রাখা হয় যা বেশ বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য জেলখানা রয়েছে যাতে অপরাধীকে তার জীবনে বিনোদন পর্যন্ত দেয়া হয়ে থাকে! বিভিন্ন দেশের ব্যতিক্রম এই জেলখানার গল্পগুলোর তথ্য জেনে নেয়া যাক চলুন!
নরওয়ে
জেলখানায় আয়েশ! কথাটি হাস্যকর শোনালেও এটিই বাস্তব করেছে নরওয়ের হলডেন কারাগার কর্তৃপক্ষ। জানা যায়, এর যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সাল নাগাদ। এই জেলখানার ঘরগুলো বৈচিত্র্যময় রঙে পেইন্ট করা। শুধু তাই নয়, তাদের ঘরে এটাচ বাথরুমে আছে দামি দামি সব মোজাইকের কারুকাজ! আছে বিশাল স্ক্রিনের এক রঙিন টিভি। এছাড়া, ঠাণ্ডা পানি খাওয়ার জন্য আছে প্রতি সেলে বরাদ্দ করা ফ্রিজ! আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, তাদের ঘরে কোন প্রকার শিক বা লোহার জানালা নেই, আছে দামি কাঁচের জানালা। যা ইচ্ছা করলেই খুলে একটু হাওয়া খেয়ে নিতে পারেন অপরাধীরা। এই জেলখানায় বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সিনেমাহল। চাইলেই কয়েদিরা তাদের মনোরঞ্জনের জন্য সিনেমা দেখতে পারেন। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে এই জেলখানার কর্তৃপক্ষ কোন রকম কমতি রাখেনি। সুস্বাদু খাবারের সমাহার, পছন্দের খাবার যখন যার ইচ্ছে সে খেয়ে নিতে পারে।
আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, এখানকার কয়েদিরা তাদের পছন্দমতো খাবার নিজেরাই রান্না করেও খেতে পারেন; আর তাদের জন্য প্রতিদিন বরাদ্দ থাকে বিখ্যাত বিখ্যাত শেফ যারা মুখরোচক খাবারের মাধ্যমে তৃপ্তিতে ভরে রাখেন এই জেলখানার কয়েদিদের। এছাড়া আছে বিশাল খেলার মাঠ, যাতে ব্যাডমিন্টনসহ বাস্কেটবল খেলা হয়ে থাকে। আর হ্যাঁ, এখানে কোন রকম খারাপ ব্যবহার কিংবা তাদের কথাবার্তায় যেন কোন কয়েদির জীবনে বাজে প্রভাব না পড়ে তাই কারারক্ষীদের বেশ কিছু ট্রেনিংও দেয়া হয়ে থাকে। এত কিছুর পর এই জেলখানার জীবন অনেকের কাছে বিস্ময়ের বিষয়ই হয়ে থাকে।
সুইজারল্যান্ড
সুইজারল্যান্ডের এক জেলখানা, যা মাত্র কয়েক বছর আগেও ছিল আর দশটা সাধারণ জেলখানার মতোই। এটি এক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ছিল। আর এর পরিবেশ এতটাই খারাপ ছিল যে এই জেলখানায় থাকা কয়েদিরা দিন দিন অসুস্থ হতে থাকে। আর ঠিক এই কারণেই সুইজারল্যান্ডের সরকার উদ্যোগ নেন এই জেলখানাকে নতুন করে সাজিয়ে তুলবেন। সুইস সরকার প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে এই জেলখানাকে পরিমার্জিত করে তুলেন।
সুইস এই জেলখানায় আছে পার্সোনাল রুম থেকে শুরু করে টেনিস কোর্ট, বাস্কেটবল খেলার জন্য সুন্দর কোর্ট। এছাড়া অলস সময় কাটাতে চলে যেতে পারবেন আউটসাইড গেমিং সাইডে। বরফের দেশের এই জেলখানায় মিলবে স্কিইং এর চমৎকার সুযোগ। আবার ধরুন আপনার ক্ষুধায় ইচ্ছে করলো নিজের পছন্দের কিছু রান্না করে খেতে, মিলে যাবে নিজে রান্না করে খাওয়ার সুযোগ। কিছু মুহূর্তের জন্য হয়ে যেতে পারবেন আপনার জগতের নিজস্ব শেফ! সুইজারল্যান্ডের এই জেলখানার নাম চ্যাম্প ডোলন প্রিজন!
স্পেন
পৃথিবীর যে কয়টি বিলাসবহুল জেলখানা আছে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী নামীদামী জেলখানাটি হচ্ছে স্পেনের অ্যারানহুয়েজ প্রিজন। এই জেলখানার কয়েদিদের যে বড় সুযোগটি দেয়া হয় তা হচ্ছে সন্তান ও পরিবারের সাথে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ। সেই জেলখানার মালিক বা সেখানে কর্মরত সবাই এটাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে, একজন শিশুর মানসিক বিকাশে সেই শিশুর পিতা-মাতার অবদান সবচেয়ে বেশী। তারা বিশ্বাস করে, একজন শিশুর শিক্ষার বড় মাধ্যম হচ্ছে তাদের পিতা-মাতা। আর তাই তারা সেই দায়িত্ব মাথায় রেখেই করে গেছেন এমনই কিছু চাঞ্চল্যকর কাজ। আর তাই সেই অপরাধীদের সন্তানরা যেন এই চমৎকার ব্যাপারটি থেকে বঞ্চিত না হয় তাই তারা সেই ব্যবস্থা করে রেখেছে। শাস্তিপ্রাপ্ত কয়েদীদের সন্তানেরা সেখানে বেশ ভালোই সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে বলে জানান সেখানকার কর্তৃপক্ষ।
শিশুদের জন্য সেখানে করে রাখা আছে খেলাধুলার বিশেষ সুযোগ। আছে শিশুদের প্রিয় ডিজনি কার্টুনের ছবি টানানো। এছাড়া বাচ্চারা যাতে সেখানে আনন্দে সময় কাটাতে পারে তাই গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল এক খেলার মাঠ। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্যি! স্পেনের এই জেলখানার মনোমুগ্ধকর ভাবনাটি এসেছিল এক শিশুর প্রাত্যাহিক জীবন থেকে। শিশুটির পিতা মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার কারণে জেলে দীর্ঘদিন আটক ছিলেন। আর সেই শিশুটি প্রতিদিন তার স্কুল বা কাজ শেষে ফিরে আসতো তার বাবার কাছে। জানা যায়, এটিই ছিল তার প্রাত্যাহিক কাজের মধ্যে একটি। এরপরই সেই জেলখানার কর্তৃপক্ষ চিন্তা করেন এই শিশুটির ভবিষ্যৎ যেন অনিশ্চিত না হয়, তাই সেখানে গড়ে তোলা হয় এমন ব্যবস্থা।
সুইডেন
এদেশের কিছু জেলখানা চমৎকার ব্যবস্থা করে রেখেছে সেখানে থাকা কয়েদিদের জন্য। সুইডেনের এই কারাগারে তারা পায় বেশ কিছু ব্যক্তিগত সুবিধা। যার মধ্যে অন্যতম একটি সুবিধা হলো নিজেদের পছন্দের খাবার নিজে রান্না করতে পারা। জেলখানার খাবারের কথা ভাবলেই আমাদের চোখে ভেসে আসে একটি প্লেটে কিছু অখাদ্য জাতীয় খাদ্য। অথচ সুইডেনের সোলেন্টিউনা জেলখানায় নিজেরাই নিজেদের পছন্দের খাবার রান্না করে খেতে পারবে।
অনেকেই নিজেদের শরীরচর্চায় যেতে পারে জিমনেসিয়ামেও। আবার এখানে বিরক্তও হওয়া যাবে না। এর জন্যেও রয়েছে চমৎকার ব্যবস্থা। রয়েছে বিশাল টিভিরুম, যেখানে আয়েশ করে বসে টিভি দেখা যায়। এখানকার কর্তৃপক্ষ জানান, তাদের শাস্তির পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবন যেন দুর্বিষহ হয়ে না পড়ে তাই তাদের এই পরিকল্পনা থেকেই এই জেলখানা গড়ে তোলা!
নেদারল্যান্ডস
আরেকটি বিলাসবহুল কারাগারের নাম হচ্ছে নরগারহ্যাভেন। এর ভেতরে প্রবেশ করলে পারতপক্ষে মনে হবে না এটি কোন জেলখানা। দামী বিলাসবহুল ফাইভ স্টার হোটেলকেও হার মানাবে। অন্যান্য জেলখানা থেকে এখানকার জেলখানার কয়েদিরা আরো এক ধাপ বেশীই সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। আর এখানে কয়েদিরা পেয়ে থাকেন তাদের থাকার জন্য নিজেদের ব্যক্তিগত রুম। আর বই পড়ুয়া হলে তো কথাই নেই! কেননা এখানে রয়েছে বিশাল বড় লাইব্রেরী। তবে এই দেশ থেকে ধীরে ধীরে অপরাধ প্রবণতা কমে আসার দরুন তাদের জেলখানাগুলোর পরিমাণ অনেকটাই কমে এসেছে।
আশ্চর্যের ব্যপার হচ্ছে, দেশটিতে এক সময় অপরাধ প্রবণতা এতোটাই কমে আসে যে, জেলখানা কর্তৃপক্ষ ২০১৫ সাল নাগাদ নরওয়ে থেকে কয়েকজন কয়েদিদের তাদের দেশের জেলখানায় আনার প্রস্তাবে চুক্তি করেন। আর এতে করেই বুঝা যায়, বিলাসবহুল হলেও, এই জেলখানার দরকার কমতেই থাকে দিনদিন! তবে প্রচণ্ড বিলাসবহুল হলেও জেলখানা আমাদের কাছে জেলখানাই! অপরাধ মানেই পাপ, আর পাপ থেকে যতই বিলাসবহুল জেলখানায় থাকা যাক না কেন, দিন শেষে তাদের একমাত্র পরিচয়ই হল তারা অপরাধী! আর এখানে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা ভোগ করলেও আপনি যে পরাধীন সেটাই সবচেয়ে বড় কথা! আর এতে করে মনে হয়ই না আমাদের স্বাধীন জীবন অনেক বেশী মন্দ!
Feature Image: scoopwhop.com
তথ্যসূত্র:
01. www.scoopwhoop.com/most-luxurious-prisons-in-the-world/
02. roar.media/bangla/main/world/luxurious-prisons-in-the-world