লুক্সেমবার্গ: যে দেশ ইউরোপীয়দের চেয়ে ইউরোপীয়

1895
0

সে এক রূপকথার দেশ
রাজা যেথায় শাসন করে
নেই প্রজার সুখের শেষ
প্রবাসী যেথায় আবাস বানায়
নিয়ে স্বপ্ন যে বিশেষ!

আজ আমরা আপনাকে ইউরোপের এমনই এক স্বপ্ন রাজ্যে নিয়ে যাবো, যেখানকার অধিবাসীদের বলা হয় ইউরোপের চেয়েও ইউরোপীয়। দেশটির আয়তনও অবাক হবার মতোই; মাত্র ২,৫৮৬.৪ বর্গ কিলোমিটার! আর দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা মাত্র ৬,১৪,০০০। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই জনসংখ্যার বেশিরভাগই আবার অভিবাসী; যারা শিক্ষার্থী হয়ে বা জীবিকার সন্ধানে এসেছিল ইউরোপের ক্ষুদ্রতম এই দেশটিতে। এত কথা বলে ফেললাম অথচ দেশটির নামই এখনো বললাম না। ইউরোপীয়দের চেয়ে ইউরোপীয় এই দেশের নাম লুক্সেমবার্গ।

দেশটির রাজধানী লুক্সেমবার্গ সিটি। ভৌগলিক অবস্থান ও আয়তনের দিক থেকে লুক্সেমবার্গ ডেলাওয়ারের অর্ধেক। বেলজিয়ামের আরদনেস পর্বতমালার পাদদেশ, বেলজিয়াম এর সীমানা ছেড়ে লুক্সেমবার্গের উত্তর অংশে এসে মিশেছে। এছাড়াও জার্মানি, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সের সীমানাও এসে মিশেছে এই দেশের সঙ্গে। মুদ্রা হিসেবে ইউরো ও ভাষা হিসেবে লুক্সেমবার্গিস, ফরাসী ও জার্মানের বহুল প্রচলন রয়েছে। মাথাপিছু আয় তথা জিডিপির বিবেচনায় দেশটি বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। 

দেশটির বর্তমান রাজা ডিউক হেনরি ও প্রধানমন্ত্রী জেভিয়ার ব্যাটেল। জনসংখ্যার দিক থেকে দেশটিতে রোমান ক্যাথলিক, প্রটেস্ট্যান্ট, ইহুদী ও স্বল্প সংখ্যক ইসলাম ধর্মের অনুসারীও রয়েছেন। যদিও অনেকেই মনে করেন দেশটি ক্ষুদ্র কিন্তু কথাটা মোটেও সঠিক নয়। দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোডস আইল্যান্ড দ্বীপের সমপরিমাণ। এছাড়াও অ্যান্ডোরা, মাল্টা, লিয়েতসেন, সান মারিনো, মোনাকো এমনকি ভ্যাটিকান সিটি এর চাইতেও বড়। তাই তুলনামুলকভাবে লুক্সেমবার্গ ততটাও ক্ষুদ্র আয়তনের দেশ নয়। বিশ্বের মাঝে বিস্ময়কর এই দেশের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরাই মূলত আজকের আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। 

দূর্গ ঘেরা লুক্সেমবার্গের সৌন্দর্য। Photos by travelmagma.com

ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা দুর্গে ঘেরা রাজ্য

ছবির মত সুন্দর এই শহর প্রায় ১০০ দুর্গ দিয়ে ঘেরা। ১৮৩৯ সালে দেশটি সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়। তবে অতীত ঘেটে জানা যায়, ৯৬৩ সালে লুক্সেমবার্গে প্রথম দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। বেশিরভাগ দুর্গ দেশের উত্তর দিকে অবস্থিত; তিনটি বৃহত্তম দুর্গ হল ভায়েনডেন ক্লারভাক্স এবং বোর্সচেডে।  

সমগ্র দেশজুড়ে খুঁজে পাওয়া যাবে মধ্যযুগীয় ইতিহাসের নিদর্শন। বিভিন্ন জাদুঘরে প্রদর্শিত হয় মধ্যযুগের ঐতিহাসিক সরঞ্জামাদি। এছাড়াও বিভিন্ন দুর্গে ও নগরী ঘিরে রয়েছে ভূগর্ভস্থ টানেল যা প্রতিরক্ষার স্বার্থে ১৬০০ সালে নির্মিত হয়েছিল। 

এমন দেশের দেখা মেলা সহজ নয়

যদিও অনেকেই ভাবেন যে, লুক্সেমবার্গ নামকরনে সৃজনশীলতার কোনো ছোঁয়া নেই। তবে দেশটির রাজধানী পুরনো এবং নতুন – এর ভারসাম্যে গড়া প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্টের এক দুর্দান্ত উদাহরণ বৈকি।

মধ্যযুগে নির্মিত শহরের কেন্দ্রটি ছোট, পুরনো বিল্ডিং এবং এর মধ্যযুগীয় অতীতের অবশিষ্টাংশে পরিপূর্ণ। শহরের মাঝামাঝিতে রয়েছে সবুজ রঙে ঘেরা উপত্যকা এবং একেবেকে বয়ে চলা নদী।

শহরের অন্যান্য অংশ, যেমন সরকারি প্রতিষ্ঠান, কিচবার্গে রয়েছে কাঁচঘেরা আকাশচুম্বী সব বড় বড় দালানকোঠা, ব্যাংক ও বহুজাতিক সংস্থার দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। রাজধানী লুক্সেমবার্গ সিটি দেশটির সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু এবং সেখানে অনেকগুলি যাদুঘর, আর্ট গ্যালারী, বার এবং বিশ্বসেরা রেস্তোঁরা রয়েছে। 

ছবির মতো সুন্দর লুক্সেমবার্গ। Photos by topteny.com

ঐতিহ্য, ভাষা ও শিক্ষার রকমফের

লুক্সেমবার্গের বেশিরভাগ লোক বহুভাষিক। বহুল ব্যবহৃত ভাষার মাঝে রয়েছে লুক্সেমবার্গিস, জার্মান, ফরাসী এবং ইংরেজি। কারণ লুক্সেমবার্গের রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে চারটি ভাষার শিক্ষাই দেয়া হয়ে থাকে। 

সুতরাং, আপনি যতক্ষণ এগুলোর মধ্যে যে কোনো একটি ভাষায় কথা বলছেন ততক্ষণ আপনি যে কোনো কিছু অর্জন করতে সক্ষম হবেন এই দেশে। আরো মজার বিষয় হচ্ছে বহিরাগত কেউ যদি লুক্সেমবার্গিস শিখতে চায় কিংবা বলতে পারে, তার খাতিরদারি বেড়ে যায় লুক্সেমবার্গের জনসাধারণের কাছে। বর্তমানে প্রায় ৩,০০,০০০ মানুষ এই ভাষায় কথা বলে।

মূলত লুক্সেমবার্গিস, ফরাসী এবং জার্মান এই তিনটি হচ্ছে লুক্সেমবার্গের দাফতরিক বা সরকারী ভাষা। দেশটিতে প্রচুর সংখ্যক পর্তুগিজ লোক থাকে বিধায় পর্তুগিজ ভাষাও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। 

লুক্সেমবার্গের ঐতিহ্যবাহী নটরডেম ক্যাথেড্রাল। Photos by topteny.com

বিশ্বের জনপ্রিয় সব খাবারের দেশ

লুক্সেমবার্গের সংস্কৃতি খাওয়া-দাওয়াকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। আর পুরো দেশের সংস্কৃতি আবার রাজধানীকে কেন্দ্র করে গড়া। এই শহরে রয়েছে বিশ্বের সর্বাধিক মিশেলিন রেস্তোঁরা।

স্থানীয় খাবার পর্যটকদের ভ্রমণের আগ্রহ বাড়ায়: গ্রোম্পেরেকিচেলচার (ক্রিস্পি আলুর ফ্রাই), রিলেসিংসপ্যাচটিট (মাংস এবং ওয়াইন পাই), জূড ম্যাট গার্ডিবাউনেন (দেশটির জাতীয় খাবার, যা শুয়োরের মাংস এবং বড় বড় মটরশুটি দিয়ে রান্না করা হয়), কুইটসেন্টার্ট (ডুমুরের পিঠা) এবং কাচ্চিস ( নরম পনির) হল লুক্সেমবার্গের ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবারের পদ।

তবে একটি আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, লুক্সেমবার্গের রাস্তা বিশ্বের নামীদামী খাবারের দোকান যেমন- কেএফসি, বার্গার কিং, স্টারবাকস, ক্রিস্পি ক্রিমি, ট্যাকো বেল হতে মুক্ত।  

লুক্সেমবার্গের চোখধাধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। Photos by Caputo Laurent

ওয়াইনের স্বর্গভূমি

লুক্সেমবার্গে পাঁচ ধরণের বিয়ার তৈরি করা হয়- মাউসেল, ব্যাটিন, ডেইকির্চ, বোফফার্ডিং এবং সাইমন। এগুলো সমগ্র লুক্সেমবার্গ জুড়েই বহুল জনপ্রিয়। দেশের চাহিদা বিবেচনা করে প্রচুর ওয়াইন উৎপাদন করা হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, উত্পাদিত বেশিরভাগ ওয়াইন হল সাদা ওয়াইন এবং স্পার্কলিং ওয়াইন, যা ক্রেম্যান্ট নামে লুক্সেমবার্গে পরিচিত। পাশাপাশি  রয়েছে কিছু প্রিমিয়াম ওয়াইন।

লুক্সেমবার্গে এমন কিছু পানীয়ও তৈরি হয় যা সাধারণত ইউরোপের সব জায়গায় পাওয়া যায়; যেমন মীরাবেল এবং কিরশের। রাজধানীর উত্তর-পূর্বে এক বর্ধিষ্ণু গ্রামে রয়েছে বউফোর্টের দুর্গ যেখানে গাঢ় কালো রঙের অ্যালকোহল তৈরি কর হয় যা লুক্সেমবার্গের লোকেরা খুব পছন্দ করে। 

লুক্সেমবার্গের গিনেজ বুক রেকর্ডে  নাম ওঠানো সেরা রেস্তোরার নাম “সিগ্যারী” যেখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ওয়াইন কালেকশন। ১৭৪৬ ধরনের ওয়াইন প্রস্তুত রয়েছে পর্যটকদের তৃষ্ণা মেটাতে। 

লুক্সেমবার্গের ঐতিহাসিক এক দূর্গ। Photos by travelmagma.com

ইউরোপের পাওয়ার হাউস

লুক্সেমবার্গ নামক ছোট দেশটি ব্রাসেলস এবং স্ট্র্যাসবার্গের সাথে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রু পাওয়ার সেন্টার হিসেবে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস, ইউরোপিয়ান কোর্ট অব অডিটরস, দ্য সেক্রেটারিয়েট অব দ্য ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড এই দেশে অবস্থিত।

দর্শনীয় স্থান

পৃথিবী বিখ্যাত এক ক্যাথেড্রালও রয়েছে এই শহরের বুকে। নাম তার “নটর ডেম”। এর গথিক স্থাপত্যধারা এটিকে একটি আকর্ষণীয় ল্যান্ডমার্ক হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিন শতাব্দী ধরে নির্মিত এই ক্যাথেড্রালের ভিত্তি প্রস্তর ১৬১৩ সালে স্থাপন করা হয়েছিল। তবে নির্মাণের শেষ পর্যায়টি ১৯৩৮ সালের আগ পর্যন্তও শেষ হয়নি। 

আর সেজন্যেই এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নের স্মারকও বটে । এখানে, আপনি লে প্রিজননিয়ার পলিটিকের তিনটি সংস্করণের একটি খুঁজে পাবেন, যেখানে রয়েছে লুসিয়ান উইকোলিয়ারের ব্রোঞ্জের কাজ। তিনি ছিলেন লুক্সেমবার্গে জন্মগ্রহণকারী ভাস্কর যিনি নাৎসিদের দাবি হিসেবে “আর্য শিল্প” সৃষ্টির হুকুম মানতে অস্বীকার করায় জার্মানির সীমান্তের ঠিক ওপারে হিনজার্ট কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। 

লুক্সেমবার্গের শীতকালীন সৌন্দর্য। Photos by shutterstock.com

 শিল্প সংস্কৃতির আধার

মুদাম, নগরীর প্রধান আধুনিক আর্ট মিউজিয়াম (মুসিয়ে ডি আর্ট মোদার্ন গ্র্যান্ড-ডুক জিন; মুদাম.লু)। জেনে রাখা ভালো – এটি একটি উদ্ভাবনী প্রতিষ্ঠান যা এককালের ফোর্ট থ্যাঞ্জেন (পুরনো দেয়ালের অংশ) অংশ বিশেষ। এটি বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর সৃজনশীলতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে যা অ্যান্ডি ওয়ারহল এবং জার্মান ফটোগ্রাফার টমাস স্ট্রুথ সহ ১০০ জনেরও বেশি শিল্পীর কাজকে উপস্থাপন করছে।

এই ভবনের স্থপতি ছিলেন চীনা-আমেরিকান স্থপতি আই.এম.পি.পের। আরো আছে গ্যালারি ডি আর্ট কনটেম্পোরেইন “এম টানেল” যা সাম্প্রতিক দশকের গুরুত্বপূর্ণ নান্দনিক নিদর্শন। 

পুরো লুক্সেমবার্গ জুড়ে এমন অসংখ্য দূর্গ আছে। Photos by topteny.com

পশ্চিম ইউরোপের হৃৎপিণ্ডে দেশটির অবস্থান

আপনি যদি সেনজেন ভিসার অধিকারি হন অথবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অধিবাসী হন তবে পশ্চিম ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত, লুক্সেমবার্গের প্রতিটি বড় এবং ছোট শহরে সহজেই প্রবেশ করতে পারবেন।

দিনে লন্ডন থেকে কম বেশি নয়টি ফ্লাইট লুক্সেমবার্গে আসা যাওয়া করে। এতে সময় লাগে মাত্র ১ ঘন্টা। প্যারিস থেকে বিমানে লুক্সেমবার্গ যেতে এক ঘন্টাও লাগে না এবং টিজিভিতে (ত্রাইন্স অ্যা গ্রান্তে ভি দেসে- বিশেষ দ্রুতগামী ট্রেনে) যেতে সময় লাগে কেবল দুই ঘন্টা। ব্রাসেলস থেকে ট্রেনে পৌঁছাতে তিন ঘন্টা ও বার্লিন থেকে ফ্লাইটে কেবল দুই ঘন্টা সময় লাগে।

লুক্সেমবার্গের একমাত্র বিমানবন্দর, ফাইন্ডেল থেকে বিমানে ভ্রমণ বেশ ব্যয়বহুল। সে তুলনায় প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিমান খরচ তুলনামূলক কম। 

লুক্সেমবার্গের সন্ধ্যাও যেন ভিন্ন এক রূপ নিয়ে নামে। Photos by arrivalguide.com

শেষ হয়েও যেন হয় না শেষ। লুক্সেমবার্গ ধনী রাষ্ট্র হলেও নাগরিক সুবিধায় চালু রেখেছে বিনামূল্যে যানবাহন সুবিধা; যা পুরো বিশ্বে সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সব কি আদৌ ইতিবাচক হওয়া সম্ভব? তাই রয়েছে খানিকটা অভাবও।

লুক্সেমবার্গ পৃথিবীর স্বল্পতম সুখী দেশ। বার্ষিক হ্যাপি প্ল্যানেট সূচকটি ১৪০টি গন্তব্যস্থলকে চিহ্নিত করে। সেই সূচকে সর্বোচ্চ জিডিপির গুরুত্ব নেই; পরিবর্তে দীর্ঘ, সুখী, টেকসই জীবন অর্জনের জন্য নাগরিকরা কতটা ভাল করছে বিচার করা হয় সেই বিষয়ে। অসুখী দেশের তালিকায় রয়েছে লুক্সেমবার্গেরও নাম। তাই তো বোধহয় কবি বলেছেন, 

সব চাওয়া কি হয়রে পূরণ,
রয় কি চাওয়ার শেষ,
না পাওয়াটাও রয় লুকিয়ে,
হয়ে গোপন মন বিশেষ। 

Feature Image: © Mikel Trako/Alamy Stock Photo
তথ্যসূত্রসমূহ:

01. Luxembourg- Europe’s unhappiest country.
02. 12 reasons Luxembourg is the best country in the world.