মুখে সপ্তাহ দুয়েকের না-কামানো দাড়ি। ঘরের জানালার একটা কবাট আধখোলা। সেখান থেকে সকালের রোদ উঁকি দিচ্ছে বিছানার প্রান্তে। অলসভাবে গাল আর থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে উঠে বসতে ইচ্ছে করে বৃদ্ধের। হাতে ভর দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসার মতো জোর পায় না গায়ে। অথচ মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। সমুদ্রের মাঝখানে পথভ্রষ্ট জাহাজের দিশেহারা আর সকলের মতো হাত পা ছেড়ে দিয়ে হার মেনে নেননি সেদিনের সেই যুবক। বরং কেবল ইচ্ছেশক্তি আর বেঁচে থাকার প্রবল মনোবল শক্তি এক করে নিজে তো বেঁচে ফিরেছিলেনই, বাঁচিয়ে ছিলেন আরো চৌদ্দটা তরতাজা প্রাণ।
এরকম অবস্থায় নাবিকদের বেঁচে ফেরার ইতিহাস নেই বললেই চলে। ইতিহাস নতুন করে লেখানো সেই যুবক এখন দুরারোগ্য ক্যান্সারে ক্লিষ্ট অবস্থায় চারদেয়ালে বন্দি। শুয়ে শুয়ে আর সময় কাটতে চায় না। আন্দাজে হাত চালিয়ে সৌখিন লাঠিটার নাগাল পেয়ে বৃদ্ধ যেন আশার পালে হাওয়া পেলেন। লাঠিতে ভর দিয়ে দরজা পর্যন্ত অনেক কষ্টে হেঁটে এসে বাম হাতে খিল আলগা করে দিতেই দরজা খুলে গেল। চোখের সামনে খোলা আঙিনা। দরজার খোলা মুখে বহুদিন পর বাইরের বাতাস আর রোদ একসাথে এসে হাজির হয়েছে।
এই বাতাসে কেমন একটা টান আছে, নোনতা একটা ভাব আছে। সমুদ্রের টান চিনতে নাবিকের কি কোনদিন ভুল হয়? কিন্তু এখন ফেলে আসা উদ্দীপ্ত যৌবনের মুখর দিনগুলো তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। আর এদিকে শেষ জীবনের যন্ত্রণায় একটু যেন বিরতি চান তিনি। আর কয়টা দিন যদি বাঁচা যেত শক্ত হাতে হাল ধরে! এককালের অসমসাহসী নাবিকের পক্ষে এই জ্বালা-যন্ত্রণা দুর্বিষহ। কে এই বৃদ্ধ নাবিক? মাঝ সমুদ্রে মৃত্যুর সাথে লড়ে কীভাবে ফিরে এসেছিলেন আবার? তার বীরত্বটা কী ছিল আসলে?
বৃদ্ধের নাম লুইস আলেহান্দ্রো ভেলাসকো। ১৯৩৪ সালে কলম্বিয়ায় তাঁর জন্ম। ২০০০ সালে ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হন সমুদ্রবিজয়ী এই বীর নাবিক।
কী ঘটেছিল সেদিন
পরলোকগত ভেলাসকোর শেষ ইচ্ছামতে তার দেহভস্ম সমুদ্রে ছড়িয়ে দেওয়ার পঁয়তাল্লিশ বছর আগের গল্পটা শুনি চলুন। সেদিন ক্যারিবিয়ান সাগরে ভাসছিল ভেলাসকোকে বহনকারী কলম্বিয়ান নেভাল ডেস্ট্রয়ার ক্যালডাস। জাহাজের ডেক ভর্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা মালপত্রে। টিভিসেট, ওয়াশিং মেশিন, ফ্রিজ — এসব। সেনাবাহিনির নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এসব নিয়ে কলম্বিয়ার দিকে এগিয়ে চলছিল ক্যালডাস।
সবকিছু যখন আপাতভাবে ঠিকঠাকই চলছিল, তখনই বিপদ আসে বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে। সমুদ্র হয়ে পড়ে উত্তাল। হয়তো ভেলাসকো আর তার দল প্রস্তুতি নিচ্ছিলই। কিন্তু প্রকৃতি কি সবাইকে সময় আর সুযোগ দেয়? কিছু বুঝে উঠার আগেই এক দৈত্যসম ঢেউ এসে এলোমেলো করে দেয় সব!
ওই ভারী ভারী জিনিসগুলোর চাপে এতটাই দেবে ছিল জাহাজ, যে সমুদ্রে টাল সামলানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এমনকি নাবিকদেরও উদ্ধার করার সুযোগ মেলেনি। ওদিকে জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জামও তেমন ছিল না জাহাজে। যা-ও বা ছিল তা আকারে ছোট। আর কলম্বিয়ান নৌবাহিনি মোটে চারদিনের মাথায় উদ্ধারকাজ বন্ধ ঘোষণা করে দেওয়ায় হতাহতের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়।
ভেলাসকোর কীর্তি
অমন একটা প্রবল পরাক্রান্ত ঢেউয়ের আঘাতে সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার গল্প শুনলেই গাঁ শিউরে উঠে। একদিকে বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছে; একদিকে মৃত্যুর আতংক; অন্যদিকে সহযাত্রীদের করুণ আর তীব্র আর্তনাদ; আরেকদিক উত্তাল আর অশান্ত সমুদ্রের ভয়াল রূপ। এমন পরিস্থিতিতে আর অস্তিত্বের যুদ্ধে টিকে থাকা কি এতটাই সহজ?
শারীরিকভাবে সুস্থ স্বাভাবিক একজন মানুষের পক্ষে এমন সমুদ্রসংগ্রাম অনেকটাই অসম্ভব যদি না সেই মানুষটি মানসিকভাবে অদম্য শক্তি সম্পন্ন না হয়। কোন কল্পকাহিনির লেখকেরও দূরতম কল্পনার একটা সীমা থাকে এরকম ক্ষেত্রে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় নায়কের ট্র্যাজিক মৃত্যু। লুইস আলেহান্দ্রো ভেলাসকোর বীরত্বের সত্যি ঘটনাটা কাহিনিকেও হার মানায়। জাহাজ থেকে ছিটকে পড়ে এক লহমার জন্যও মনোবল হারালে সলিল সমাধি হতো তার। উত্তাল ক্যারিবীয় সমুদ্রে আক্ষরিক অর্থেই স্রোতের বিপরীতে চলেছে তার জীবন।
বেঁচে থাকার যুদ্ধে
ভেলাসকো যখন নিজেকে জলে আবিষ্কার করলেন, তিনি দেখলেন তার পাশেই একটা ভেলা ভেসে চলেছে। সেই ভেলা তাড়া করে তাতে উঠলেন তিনি। তার সাথে একই ভেলায় উঠতে চেয়েও পারেননি, ডুবে গেছেন তারই চার সহকর্মী। এই দৃশ্যে তিনি যেমন আশাহত হয়েছেন, তেমন আশায় বুক বেঁধেছেন যখন উদ্ধার হবার একটু সম্ভাবনাও উঁকি মেরেছে। উড়োজাহাজে উদ্ধারকারীরা তাকে দেখতে ব্যর্থ হওয়ায় উদ্ধারকর্ম পিছিয়েছে। এতে আবার বেড়েছে তার হতাশা।
এইভাবে দশ দিন। নেই খাবার, নেই বিশুদ্ধ পানি। ভেসে চলেছেন ভেলাসকো। প্রতিদিন হাঙরের সাথে যুদ্ধ করতে করতে একসময় গাংচিলের দলের দেখা পেলে তার জীবনের আশার পালে হাওয়া লাগে। একপর্যায়ে ক্ষুধার জ্বালায় একটা গাংচিল কোনোমতে ধরে সেটার ঘাড় মটকে খেয়ে ফেলার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু পারেননি। ক্ষুধার জ্বালায় থাকতে না পেরে নিজের জুতোজোড়াও খাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। দাঁত দিয়ে ছিড়তে তো পারতে হতো!
শেষমেশ তার কাছে থাকা শক্ত কাগুজে বিজনেস কার্ড খেয়ে ক্ষুধা মিটিয়েছেন ভেলাসকো। এভাবে বিরূপ পরিবেশে ভাসতে ভাসতে ভেলা তাকে নিয়ে কলম্বিয়া উপকূলে পৌঁছালে ছয়শো লোকের বাহিনি তাকে স্যান জুয়ান শহরে নিয়ে যায়। সাড়া পড়ে যায় গোটা শহরে। তাকে জাতীয় বীরের তকমা দেওয়া হয় তারপর। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকেন ভেলাসকো।
বীরত্বের প্রচারণা
লুইস আলেহান্দ্রো ভেলাসকো তো রাতারাতি সেলিব্রিটিই হয়ে গেলেন। এরপর তিনি কী করলেন? এত সাড়াজাগানো একটা ঘটনার পর ভেলাসকোর একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হয় সেকালের কলম্বিয়ার বিখ্যাত পত্রিকায় – এল এস্পেক্টাডরে। সেই সময় সেখানে ফিচার লেখার কাজ করতেন পরবর্তীতে নোবেলজয়ী লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। তার কাছেই সাক্ষাৎকার দেন ভেলাসকো। সাক্ষাৎকারটা চৌদ্দ পর্বের সিরিজে ছাপা হয় পত্রিকায়। গ্রাহকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সেই সময় পত্রিকা অফিসে।
আরো পরে মার্কেজ ভেলাসকোর কাহিনি অবলম্বনেই লেখেন ‘Story of a Shipwrecked Sailor’ যা পরবর্তীতে একটা তুমুল আলোচিত বইয়ে রূপান্তরিত হয়। প্রকাশিত হয় ভেলাসকোর ঘটনার পনেরো বছরের মাথায়, ১৯৭০ সালে। বইটি স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হয় Relato de un náufrago নামে।
লুইস আলেহান্দ্রো ভেলাস্কোর পরিহিত সেই জুতোর প্রস্তুতকারক কোম্পানি তাঁকে দুই হাজার পেসো সম্মানী দেয়। বিনিময়ে তাকে কেবল বিজ্ঞাপন করে দিতে হয়েছিল। তার গল্পটা রেডিওতে প্রচারবাবদ তখন তিনি পান আরো পাঁচ হাজার পেসো। দশ দিনের ক্ষুধাতৃষ্ণা তার জন্য এত লাভজনক কিছু হবে, তা ভেলাসকোর দূরতম ভাবনায়ও ছিল না। এসবই ঘটনার পর তার নিজের স্বীকারোক্তি।
মানুষ আশায় বাঁচে । কিন্তু আর যে জিনিসটি জরুরি, সেটি হচ্ছে মানুষের মনের জোর। মনের জোরেই ভেলাসকোর জাহাজডুবি থেকে বেঁচে ফেরা। রূপকথার মতো শোনালেও ভেলাসকোর এই মৃত্যুঞ্জয়ী বীরত্ব এক নিদারুণ সুন্দর বাস্তব সত্য।