বৈরি আবহাওয়ার কারণে আর্কটিক অঞ্চলে মানুষের বসবাস খুবই কম। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের মানুষের পক্ষে উক্ত অঞ্চলে বসবাস করা খুবই দুস্কর একটি ব্যাপার। কারণ সেখানের পরিবেশ এতই প্রতিকূল যে তাপমাত্রা মাইনাস ৬০ ডিগ্রীও হয়ে থাকে। তবে তার মানে এই না যে, সেখানে কেউ বাস করে না। পৃথিবীর এই অংশে নানা আদিবাসীর বসবাস রয়েছে। তন্মধ্যে এস্কিমো বা ইনুইট সম্প্রদায় অন্যতম।
এই সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী কানাডা, সাইবেরিয়া, গ্রিনল্যান্ড এবং রাশিয়ার আর্কটিক অঞ্চলে বসবাস করে। বলা হয়ে থাকে এরা থুলে (Thule) নামক গোষ্ঠীর বংশধর যারা সাইবেরিয়া থেকে আলাস্কায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। অবশ্য ইনুইটদের এস্কিমো নামেও ডাকা হয়। কিন্তু এই শব্দটিকে ইনুইটরা আপত্তিকর বলে বিবেচনা করে।
কেননা, এস্কিমো শব্দের অর্থ কাচা মাংস ভক্ষণকারী। অপরদিকে ইনুইট দ্বারা প্রকৃত মানুষকে বুঝানো হয়ে থাকে। তাই তারা নিজেদেরকে ইনুইট বলেই আখ্যা দেন। এছাড়াও, আমেরিকাও এস্কিমো শব্দ ব্যবহারে আইনগত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
ইতিহাস
আর্কটিক অঞ্চলের ১২ হাজার মাইল এলাকা জুড়ে ইনুইটদের বসবাস। তবে তাদের জনসংখ্যা মাত্র ষাট হাজার। বলা হয়ে থাকে, এই আদিবাসী জনগোষ্ঠী অন্যান্য আদিবাসীদের থেকে অনেক পরে উত্তর আমেরিকাতে প্রবেশ করেছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, তারা মাত্র ৪ হাজার বছর পূর্বে আলাস্কা অঞ্চলে আসেন, যার কিছু অংশ গ্রীনল্যান্ড ,সাইবেরিয়াতে বসবাস করছে।
আবার, অন্য এক পক্ষের তথ্যমতে, সাইবেরিয়া থেকে ১৩ শতকের দিকে তারা গ্রিনল্যান্ডে পৌঁছায় এবং যেহেতু উক্ত অঞ্চলটি বরফে আচ্ছাদিত থাকে, তাই সহজে মাছ শিকার করার জন্য সমুদ্রের তীরেই বসতি স্থাপন করে।
সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত দিক থেকে এদেরকে আমেরিকান মনে করা হলেও ইনুইটদের আদি আবাসস্থল পূর্ব এশিয়াতেই, বিশেষ করে মঙ্গোলিয়ার সাথে এদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বলে ধারণা করা হয়।
ভাষা
আর্কটিকের প্রধান ভাষা হলো এস্কালিউট (Eskaleut)। তবে ইনুইটদের আলাদা ভাষা রয়েছে। এমনকি অঞ্চলভেদে এর ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন- আলাস্কায় বসবাসকারী ইনুইটদের ভাষা ইনুপিয়াক, পূর্ব কানাডায় অঞ্চলে সেটি ইনকিটুট আবার গ্রিনল্যান্ডে কালালিসাত (Kalaallisut)। অর্থাৎ, তারা এক বিচিত্র পরিচয় বহন করে চলছে যা অন্যান্য ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান।
সংস্কৃতি ও জীবনযাপন
ইনুইট সম্প্রদায় জল এবং স্থলের মেলবন্ধনের উপর ভিত্তি করেই তাদের সংস্কৃতিকে আগলে রেখেছে। মূলত তাদের প্রধান পেশা শিকার করা। আর এই কার্য পরিচালনার জন্য জনগোষ্ঠীটির মানুষজন দক্ষ জেলে হয়ে উঠেছে।
শিকারের জন্য তারা বর্তমানে প্রচলিত কায়াক নামক নৌকাকে ব্যবহার করে যাকে সেখানে হান্টিং বোর্ড বলা হয়। অন্যদিকে, হিমায়িত বরফে চলাচলের জন্য তারা স্লেজ বা ক্যামুটিক এবং কাঠের প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ করে। এর অগ্রভাগে কুকুরকে ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করে।
স্লেজের নিচের অংশ মসৃণ থাকে যেন সহজে বরফের উপর চলতে পারে। ইনুইটরা আধুনিক সভ্যতার উপর তেমন একটা নির্ভর নয়। শিকারের মাধ্যমেই তাদের খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থানের চাহিদা পূরণ হয়। এমনকি শিল্প ও কারুশিল্পের একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে, যা প্রায়শই তাদের ঐতিহ্যগত জীবনধারাকে প্রতিফলিত করে।
তাদের বস্ত্র তৈরি হয় শিকার করা জন্তুর বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করেই। পার্কা হলো তাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক যেটি আর্কটিকের ঠান্ডা পরিবেশে তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এছাড়াও, তাদের প্যান্ট ও জুতা ক্যারিবু নামক পশু থেকে তৈরি হয়ে থাকে।
ইনুইট সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পরিবার। ইনুইটরা খুবই পরিবার-ভিত্তিক মানুষ, এবং তারা আত্মীয়তার সম্পর্ককে উচ্চ মূল্য দেয়। এছাড়াও, ইনুইটরা নানা পৌরাণিক কাহিনী এবং বয়োজ্যষ্ঠদের নৈতিক মূল্যবোধকে অনুসরণ করেই তাদের নিজস্ব মোরাল কোড (Moral Code) সাজিয়েছে।
ভবিষ্যৎ
ইনুইট আদিবাসী ভবিষ্যতে তাদের এই সংস্কৃতি ও জীবন যাপনের ধারা টিকিয়ে রাখতে পারবে কিনা সে নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা দেখা যাচ্ছে। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, তারা এখন হুমকির সম্মুখীন। প্রকৃতি ও আধুনিক সভ্যতা এই হুমকির মূল কারণ।
বৈষ্ণিক উষ্ণায়নের দরুণ আর্কটিক অঞ্চলের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। গত পঞ্চাশ বছরে উক্ত এলাকার তাপমাত্রা ২ থেকে ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলস্বরুপ, বরফ অতি দ্রুত গলছে এবং গবেষকরা দাবি করছেন যে,কিছু কিছু অঞ্চলের বরফ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে।
আদিবাসীরা বলছেন যে,তাদের জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে গিয়েছে। যেই সমুদ্রে ইচ্ছা করলেই শিকার করতে যাওয়া যেত, সেখানে তারা নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত শিকারে যেতে পারে না। এর প্রভাব বন্যপ্রানীতেও পড়েছে। ইনুইটদের মতে গোটা অবস্থাই এখন অস্থির ও অনির্দেশক অবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এই বৈষ্ণিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর কর্মকান্ডও ইনুইটদের প্রভাবিত করছে। বিভিন্ন পরিবেশ সংস্থা ও সরকার তাদের চলাফেরা ও কর্মকান্ডকে একটি নির্দিষ্ট সীমায় আনার কথা বলছেন। যেমন-গ্রিনল্যান্ড সরকার ইনুইটদের শিকার করার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তারা চাইলেই এখন আর চাহিদামতো শিকারকার্য পরিচালনা করতে পারে না।
উদাহরণস্বরুপ, ক্যারিবু নামক পশুর কথাই ধরা যাক। প্রাণিটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের লিস্টে পড়ার কারণে তারা সেটি শিকার করতে পারছে না। এর ফলে, তাদের খাদ্য সংকট তো হচ্ছেই, তার সাথে সাথে উক্ত পশু দ্বারা পোশাক, জুতা তৈরি হওয়ায় তার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
তবে এখানে খাদ্যের সংকটই মুখ্য বলা চলে। কেননা, তারা চাইলেই তাদের খাদ্যভাস বদলাতে পারছে না। আর্কটিক অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সিল, ওয়ালরুশ, মেরু ভালুক এবং কিছু পাখি তাদের মূল খাবার। সমস্যা হচ্ছে ইনুইটদের শিকারের কারণে তাদের সংখ্যা কমেছে তো বটেই, তার সাথে সাথে বৈষ্ণিক উষ্ণায়নের দরুণ উক্ত প্রাণিদের সংখ্যা ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। এতে করে বাস্তসংস্থানে ভারসাম্যহীন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
তাহলে কি সব শেষ?
সমস্যার সমাধান করতে নানা প্রকার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে নীতি নির্ধারক পর্যায়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এজন্য ইনুইটদের বর্তমান প্রজন্মের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। দেখা যায় যে, তাদের অনেকেই উক্ত অঞ্চল ত্যাগ করে অন্য জায়গায় স্থানান্তর হচ্ছেন।
সরকার এই কৌশলকে উৎসাহিত করছে। তবে, সম্পূর্ণ আদিবাসী জনগোষ্ঠী যে আদিম স্থান ছাড়বে সেই অবস্থা কখনোই সম্ভব নয়। এর প্রেক্ষিতে, পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য গবেষক দল কানাডার রিলোগেট এলাকার ইনুইটদের নিয়ে গবেষণা করছেন। তবে এর ফল খুবই মর্মান্তিক। পরিস্থিতির অবনতির জন্য ইনুইটদের শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটেছে।
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্যভাস থাকায়,সেটির স্বল্পতা তাদেরকে দূর্বল এবং মানসিক সমস্যায় পতিত করছে। আমেরিকার একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত কানাডা অঞ্চলে বসবাসকারী ইনুইটদের আত্নহত্যার প্রবৃত্তি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ইনুইটের বিলুপ্তি নিশ্চিত?
উপরোক্ত গবেষণা বা সরকারি পদক্ষেপের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে, পদক্ষেপগুলো শুধুমাত্র আলাস্কা কিংবা কানাডিয়ান অঞ্চলেই নেওয়া হচ্ছে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই অঞ্চলের বাইরেও ইনুইট বসবাস করে। আর বৈষ্ণিক উষ্ণায়নের প্রভাব গ্রিনল্যান্ডেই সব থেকে বেশি। আর বরফ গলে বাণিজ্যিক রুট তৈরি হওয়ায় উক্ত অঞ্চলেই পরাশক্তিগুলো ভবিষ্যতে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে।
বিশ্বের ইতিহাসে নানা জাতি, প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। এর সবকিছুর কারণই ছিল ক্ষমতাধারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। ইতিহাস থেকে তাই বলা চলে, বিশেষ কোন পদক্ষেপ না নিলে ইনুইট আদিবাসীদের অস্তিত্ব পৃথিবীতে তেমন একটা স্থায়ী হবে না। তবে, যদি শিল্পোন্নত দেশগুলো প্রকৃত অর্থেই প্যারিস জলবায়ু চুক্তি পালন করে তাহলে এখনো তাদের বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ আছে। প্রাচীন বনাম আধুনিক সংস্কৃতির এই বিরোধে অবিচারকে প্রতিহত না করলে হয়তো এমন মানবগোষ্ঠীর বিলুপ্তি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হবে।
Feature Image: The Universal Story References: 01. Inuit. 02. A Comparative Look at Inuit Lifestyle. 03. The world is changing for Greenland's native Inuit. 04. Traditional Lifestyles of the Inuit. 05. Suicide Rates in Aboriginal Communities.