ইউরোপের ক্ষুদ্রতম দেশের একটি দেশ হচ্ছে লিখটেনস্টাইন। এটি আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর ষষ্ঠ ক্ষুদ্রতম। এবং ইউরোপের চতুর্থ ক্ষুদ্রতম দেশ। লিখটেনস্টাইনের সরকারী নাম প্রিন্সিপালিটি অফ লিখটেনস্টাইন। এর দক্ষিণ আর পশ্চিমে সুইজারল্যান্ড এবং উত্তর আর পূর্ব দিকে অস্ট্রিয়া অবস্থিত। দেশটির রাজধানী ভাদুজ; যার আয়তন মাত্র ১৭ বর্গ কিলোমিটার। পুরো দেশটির আয়তন এতটাই ছোট যে, বাংলাদেশের যে কোনো একটি জেলার আয়তনের চাইতেও বেশ কম। মাত্র ১৬০ বর্গ কিলোমিটার এবং প্রায় ৩৮ হাজার জনসংখ্যা নিয়ে ইউরোপের এই দেশটি গঠিত।
লিখটেনস্টাইন ১৭১৯ সালে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮০৫ সালে একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃত হয়। জানা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লিখটেনস্টাইন অস্ট্রিয়ার সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবেই জড়িত ছিল। এই বিশ্বযুদ্ধের ফলে তৎকালীন যে অর্থনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল তাতে লিখটেনস্টাইনের সাথে সুইজারল্যান্ডের এক বৈরি সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।
ইউরোপের সবচেয়ে দীর্ঘতম নদী রাইন, যা লিখটেনস্টাইনের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। চমৎকার সুন্দর এই দেশটির চারপাশে রয়েছে নানান আকৃতির পাহাড়। সবুজাভ এই পাহাড়গুলো দেশটির সৌন্দর্য যেন কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। এদেশের পূর্ব পাশে রয়েছে আল্পস পর্বতমালা। সবুজে ঘেরা এই দেশটির যে কোনো প্রান্ত থেকেই প্রাচীন এক দূর্গ দেখা যায়। আর এই প্রাচীন দূর্গেই বাস করেন লিখটেনস্টাইনের রাজা-রানী। এই দূর্গই সেই প্রাচীনকাল থেকে পুরো দেশের প্রতীক হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এই দূর্গতে সাধারণ মানুষদের প্রবেশ বেশ কড়াকড়ি ভাবেই নিষিদ্ধ আছে।
লিখটেনস্টাইন সারাবিশ্বে তাদের তৈরি ওয়াইনের জন্য বিখ্যাত। তাদের নিজস্ব আঙুর ক্ষেত থেকে আঙুর সংগ্রহ করে ওয়াইন তৈরি করা হয়ে থাকে। আর শীতপ্রধান দেশ বলে এদেশে এই ধরণের পানীয়ের বেশ চাহিদা রয়েছে। এখানকার আবহাওয়া ও জলবায়ু মহাদেশীয়। শীতকালে এদেশে আবহাওয়া বেশ শীতল এবং আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে থাকে। সেসময় ঘর থেকে বাইরে বের হওয়াটাই মুশকিল হয়ে যায় নাগরিকদের জন্য। কেননা, তুষারপাত, ঝড়-বৃষ্টি এসব যেন লিখটেনস্টাইনবাসীদের নিত্যদিনের সঙ্গী, অন্তত শীতকাল জুড়ে।
আবার, অনেকসময় ভারী তুষারপাতে বরফে পাহাড়, গাছপালা, রাস্তাঘাট সব ঢেকে যায়। যদিও গ্রীষ্মকালের আকাশও মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবুও আবহাওয়া বেশ আর্দ্র থাকে সেসময়টাতে। আবার নাতিশীতোষ্ণও থাকে যার ফলে একধরণের সামঞ্জ্যসতা থাকে পরিবেশের ভারসাম্যে। লিখটেনস্টাইনের বিভিন্ন উৎসবের মধ্যে শীতকালীন উৎসব অন্যতম। শীতের দিনগুলোতে এদেশের মানুষেরা বিভিন্ন উৎসবে মেতে উঠে। স্নো বোর্ডিং, আইস স্কেটিং, স্লেজিং ইত্যাদি খেলার মাধ্যমে লিখটেনস্টাইনবাসী বিনোদনে মুখরিত হয়।
লিখটেনস্টাইনের বহুল ব্যবহৃত ভাষা হচ্ছে জার্মান। তবে ইতালিয়ানসহ অন্যান্য ভাষায়ও মানুষ তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে থাকে। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী লিখটেনস্টাইনে শতকরা ৮৩ ভাগ মানুষই খ্রিষ্টান ধর্মালম্বী। এছাড়া ৭৩ ভাগ নাগরিক রোমান ক্যাথলিক, ৫ ভাগ মুসলিম এবং ৩ ভাগ অন্যান্য ধর্মের মানুষ বাস করেন। লিখটেনস্টাইনের মুদ্রার নাম সুইস ফ্র্যাংক। যা বাংলাদেশে প্রতি মুদ্রায় দাঁড়ায় প্রায় ৯৪ টাকার কাছাকাছি। এছাড়া ইউরো মুদ্রারও প্রচলন রয়েছে দেশটিতে।
ছোট এই দেশটির রয়েছে বেশ প্রাচীন ইতিহাস। ১৭ শতকের দিকে লিখটেনস্টাইনের বর্তমান শাসক পরিবার ভাদুজে আসেন এবং পরবর্তীতে তারা সেলেনবার্গ আর ভাদুজকে একত্র করেন। এরপর ১৭১৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে লিখটেনস্টাইনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। প্রতি বছর ১৫ আগস্ট দেশটির জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। অন্যান্য দিনের চেয়ে এই দিনেই সবচেয়ে বেশি উৎসব মুখর হয়ে উঠে দেশের নাগরিকরা। সেই বিরাট দূর্গে সকলেই একত্রিত হয়ে জমায়েত হন। সাধারণত এই দূর্গটির সামনে সেদিন বিভিন্ন মেলা, নাচ-গানের আয়োজন করে থাকে তারা। সন্ধ্যাবেলা বেশ উত্তেজনাময় সময় কাটে তাদের। আকাশে আতশবাজির ফোয়ারা, অসংখ্য অতিথিদের ওয়াইন পরিবেশন করা হয়। এই দিনে সবার সাথে রাজাও মেতে উঠেন জাতীয় উৎসবে।
লিখটেনস্টাইনের বর্তমান রাজা অ্যাডাম ফারদিনান্দ। রাজার জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি। অ্যাডামের পিতা ফ্রান্স জোসেফ ১৯০৬ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত লিখটেনস্টাইনের শাসন করেন। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো এদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাও বেশ উন্নত। আকৃতিতে বেশ ছোট হলেও দেশটিতে রয়েছে প্রায় ১৫টি ব্যাংক। এদেশের মোট জিডিপির বেশ কিছু অংশই আসে এসব ব্যাংক থেকে।
নানান দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে থাকার পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিক দিয়েই বেশ এগিয়ে লিখটেনস্টাইন। এখানে রয়েছে ৩০টির বেশি বিশাল কোম্পানি যেখানে কর্মরত আছেন প্রায় ৮০০০ লোক। শিক্ষায়ও বেশ উন্নতির দিকেই আছে লিখটেনস্টাইনবাসীরা। চারটি গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ রয়েছে নয়টি উচ্চ বিদ্যালয়। লিখটেনস্টাইনে ইউরোপের অন্য অনেক দেশের মতোই নিজস্ব কোন বিমানবন্দর নেই। কথাটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি! তবে লিখটেনস্টাইন থেকে বেশ কিছুটা দূরে রয়েছে সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানির বিমানবন্দর। যেখান থেকে সড়কপথে লিখটেনস্টাইন প্রবেশ করতে হয়।
পর্যটকদের জন্য এখানে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা রয়েছে। রয়েছে উন্নতমানের ট্রেন এবং বাস। চমৎকার সুন্দর দেশটির পুরনো গ্রামে আছে চোখ জুড়ানো আঙুর ক্ষেত। পূর্বেই বলা হয়েছে, লিখটেনস্টাইনের বিখ্যাত ওয়াইন তাদের নিজস্ব আঙুর ক্ষেত থেকেই তৈরি করা হয়। এছাড়া রয়েছে মনোরম দৃশ্যের প্যানারমা ভিউ পয়েন্ট, রাইন পার্ক, ভাদুজ সিটি ইত্যাদি। এদেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান হচ্ছে ঈগল এডভেঞ্চার হাইক, ট্রেজার চেম্বার অফ লিখটেনস্টাইন, দ্যা টাউন সেন্টার অফ ভাদুজ, লিখটেনস্টাইন মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস, দ্য প্রিন্স অফ লিখটেনস্টাইন ওয়াইনারি, লিখটেনস্টাইনিস ল্যান্ডসেমুয়েজিয়াম, হিলি আর্ট ফাউন্ডেশন, রাগেলার রায়েট নেচার রিজার্ভ ইত্যাদি।
বেশ ছোট আকৃতির এই দেশটিতে আসা যাওয়ায় নেই তেমন কোন বাধা নিষেধ নেই। তাই পর্যটকদের কাছে হয়ে উঠেছে বেশ জনপ্রিয় এক ভ্রমণের জায়গা। এক কথায় এ যেন পৃথিবীতে গড়ে উঠা এক অপার সৌন্দর্যের স্বর্গ!
লিখটেনস্টাইনের খাদ্যাভ্যাসে পার্শ্ববর্তী দেশ অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ডের বেশ প্রভাব লক্ষ্যণীয়। যদিও লিখটেনস্টাইনের নিজস্ব কিছু রীতি আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, এরা চীজ এবং স্যুপ খেতে বেশ পছন্দ করে। অন্তত দিনের যে কোনো খাবার তালিকায় এরা যে কোনো একটি খাবারের পদ টেবিলে পরিবেশন করবেই। ভোজনপ্রিয় পর্যটকেরা লিখটেনস্টাইন ভ্রমণে এলে বিশেষ করে তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার উপভোগ করে থাকেন।
তাদের পাহাড় থেকে শুরু করে দামী রেস্তেরায় স্বাদ নেয়া যায় অত্যন্ত সুস্বাদু খাবারের। তাদের আঞ্চলিক খাবারের মধ্যে হোয়াইট ওয়াইন, রিভেলা নামক এক অতি সুস্বাদু ফলের জুস তালিকায় রয়েছে। লিখটেনস্টাইনের ঐতিহ্যবাহী একটি খাবারের মধ্যে একটি হচ্ছে তোরক্যারেবল (Torkareble)। এটি তরল দুধের সাথে কর্ণ ফ্লাওয়ার, পানি এবং লবণের মিশ্রণে তৈরি করা হয়। এই খাবারটি রেস্তেরায় খুব কম পাওয়া যায় এবং এটি ঐতিহ্যভাবে বড় জ্যাম এবং কফি দুধের সাথে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। এছাড়া হাফালাব, ফিশ স্ট্যু তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।
অপার সৌন্দর্যের এই দেশটির শিক্ষা, চেতনা, এদের অর্থনৈতিক দিক সব কিছুই যেন এক অদ্ভুতভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে দেশটিকে। আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা পাওয়ার পর থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত একেক দিক দিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় ছোট হলেও আলোচনায় উঠে এসেছে বেশ ভালোভাবেই। সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য সামরিক বাহিনী কিংবা দেশের জনগণের আদর্শ জীবনের জন্য আইনশৃঙ্খলার কাজ অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে সম্পন্ন করা হয়। খাবার, দেশের জনগণ, ঐতিহ্য, পর্যটন স্থান ইত্যাদির সংমিশ্রণে লিখটেনস্টাইন দিনে দিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
Feature Image: planetware.com
তথ্যসূত্রসমূহ:
01. Liechtenstein.
02. Liechtenstein.
03. Liechtenstein Country Profile.