প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন মিত্রশক্তির জয়জয়কার এবং অক্ষ শক্তির অবস্থা বেগতিক ঠিক তখনই পরবর্তী এক মহাযুদ্ধ ঠেকাতে আমেরিকার উইড্রো উইলসন এক আন্তর্জাতিক সংস্থা তৈরির প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবিত এই আন্তর্জাতিক সংস্থার নামই ‘লীগ অফ নেশন্স।’ এই সংস্থাটিকে জাতিসংঘের পূর্বসূরি বলা যায়। তো কিভাবে এই সংস্থার উত্থান হলো এবং কেনই বা এর পতন ঘটলো – চলুন জেনে নেওয়া যাক।
উত্থান
লীগ অফ নেশন্স নামক এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি বানানোর মূল কারণ ছিল ভবিষ্যৎ মহাযুদ্ধ প্রতিরোধ করা। ১৯২০ সালে প্যারিস শান্তি আলোচনায় ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এর আত্নপ্রকাশ ঘটে। হেডকোয়ার্টার হিসেবে সুইজারল্যান্ডের জেনেভাকে নির্বাচিত করা হয়।
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, আমেরিকা দ্বারা সংস্থাটি তৈরি করণের প্রস্তাব আসলেও আমেরিকা এই সংস্থার সদস্য ছিল না। কেননা তাদের সিনেট সংস্থাতে যোগদানের বিরুদ্ধে মতামত দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা ছাড়াই ইতালি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জাপানকে স্থায়ী সদস্য হিসেবে নির্বাচন করে লীগ অফ নেশন্সের যাত্রা শুরু হয়।
লীগ অফ নেশন্সের মূল লক্ষ্য অর্থাৎ যুদ্ধ এড়ানো ছাড়াও শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, জেল বন্দীদের মানবাধিকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় নিয়েও কাজ করার প্রতিজ্ঞা করা হয়। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, লীগ অফ নেশন্স-এর স্থায়ী সদস্যরা সেই মিত্র শক্তিই।
তাই অনেকে মনে করে যে, লীগ অফ নেশন্স প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জয়ী পক্ষেরই একটি জোট যেটা কিনা তাদের স্বার্থ হাসিল করবে এবং অক্ষ শক্তি অর্থাৎ জার্মানি, ভাগকৃত অস্ট্রো হাঙ্গেরিয়ান-অস্ট্রিয়ান সম্রাজ্যকে পুনরায় শক্তিধর হিসেবে উত্থানে রোধ করবে। অর্থাৎ এখানে পরিলক্ষিত যে, বর্তমানের জাতিসংঘে যেমন সব শক্তিধর রাষ্ট্র বিদ্যমান, লীগ অফ নেশন্সে সব পরাশক্তিযুক্ত ছিল না এবং রাশিয়াও পরে যুক্ত হলেও তাদেরকে বহিষ্কার করা হয়। এই সংস্থার সর্বোচ্চ সদস্য রাষ্ট্র ছিল ৫৮টি।
পতন
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কেন লীগ অফ নেশন্স টিকে থাকতে পারলো না? হয়তো একটু আঁচ করাই যায় এর পতনের কারণ কি। কিন্ত এর সাথে কিছু ঘটনাও জড়িত যা লীগ অফ নেশন্সকে টিকতে দেয়নি।
জাপানের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ
১৯৩১ সালে জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করলে চীন লীগ অফ নেশন্সকে তাদের আপত্তির কথা জানায়। লীগ অফ নেশন্স জাপানকে শুধুমাত্র মৌখিকভাবেই তাদের সৈন্য সরাতে নির্দেশ দেয়। কিন্ত জাপানের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে তারা সেই নির্দেশ তোয়াক্কা করেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে লীগ অফ নেশন্স লর্ড লিটন (Lytton) এর কমিশন গঠন করে। এই কমিশন মতামত দেয় যে চীন এবং জাপান উভয় পক্ষই দোষী। তাই অঞ্চলটি লীগ অফ নেশন্স শাসন করবে।
জাপান ও চীন উভয় দেশই এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে এবং জাপান সংস্থাটি ত্যাগ করে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, লীগ অফ নেশন্স মূলত যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের আওতায় চলতো। তাই, যুক্তরাজ্য অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য জাপানের সাথে খারাপ সম্পর্ক করতে চায় না বলেই তারা জাপানের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ করেনি।
নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন
১৯৩২-৩৩ সালে বিশ্ব নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে বলা হয় ইউরোপের শান্তি স্থাপনে জার্মানির সৈন্য ও অস্ত্র হ্রাস করার বিকল্প নেই। এর প্রতিউত্তরে জার্মান সরকার জানায় যে, বাকি দেশরা যদি নিরস্ত্রীকরণে অংশ নেয় তাহলে তারাও করবে। কিন্ত ফ্রান্স তাতে দ্বিমত পোষণ করে এবং এক পর্যায়ে বলে- যদি ব্রিটেন এবং আমেরিকা ফ্রান্সকে ভবিষ্যত আক্রমণ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয় তাহলেই তারা নিরস্ত্রীকরণ করবে।
যদিও ব্রিটেন ও আমেরিকা এতে সাঁই দেয়নি। ফলস্বরুপ হিটলার শুধুমাত্র জার্মানির উপরই নিয়ম চেপে দেওয়ার অভিযোগ দিয়ে লীগ অফ নেশন্স ত্যাগ করে। জার্মানি এতে করে তাদের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতেই থাকে এবং ১৯৩৬ সালে রাইনল্যান্ডেও আক্রমণ করে বসে।
আবিসিনিয়া আক্রমণ
জাপান ও জার্মানির পর ইতালিও বর্তমান ইথিওপিয়া অর্থাৎ আবিসিনিয়া আক্রমণ করে বসে। আবিসিনিয়া লীগ অফ নেশন্সের কাছে সাহায্যের আবেদন করলে তারা তেমন একটি প্রতিক্রিয়া পায়নি। ইতালির উপর নামমাত্র অর্থনৈতিক অবরোধ দেওয়া হয়। ইতালির ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রপ্রধান মুসোলিনী এতে করে জার্মানির সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করা শুরু করে।
ইতালির যুক্তি ছিল যে ব্রিটেন, ফ্রান্স তাদের কলোনি বৃদ্ধি করলে সমস্যা না থাকলে ইতালির কলোনি সম্প্রসারণেও লীগ অফ নেশন্সের সমস্যা থাকা উচিত নয়। অর্থাৎ লীগ অফ নেশন্স শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ তথা ব্রিটেন, ফ্রান্সের স্বার্থ হাসিলেই কাজ করছিল। এতে করে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কিছু ঘটলেই পদক্ষেপ নিতে দেখা যেত। অন্যথায় বড় বড় পরাশক্তির বিরুদ্ধে তারা ছিল নিশ্চিহ্ন।
অন্যান্য সমস্যা সমূহ
এছাড়াও লীগ অফ নেশন্সের কিছু সমস্যা লক্ষ্য করা যায়।
প্রথমত, এই সংস্থাটি একটি শান্তি চুক্তির ভিত্তিতে স্থাপিত হয়। অর্থাৎ সব দেশ একযোগ হয়ে এটিকে তৈরি করতে উদ্যোগ নেয়নি। শুধুমাত্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্র শক্তির তত্ত্বাবধায়নে এটির উদ্ভব। এতে করে একযোগ হয়ে কাজ করার যেই অভিপ্রায় দরকার তা এখানে ছিল না। এটাকে অনেকে মিত্র শক্তির পুতুল সংস্থা (Puppet Organization) বলে আখ্যা দেয়।
দ্বিতীয়ত, এর কোন নিজস্ব সেনা বা সিকিউরিটি ফোর্স ছিল না যেটি এখন জাতিসংঘের আছে। জাতিসংঘ তার নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে আক্রমণকৃত এলাকায় প্রতিরোধ করতে পারলেও লীগ অফ নেশন্সের ক্ষেত্রে তা সম্ভব ছিল না।
এছাড়াও আমরা আগেই দেখেছি যে আমেরিকা এই সংস্থায় সূচনালগ্ন থেকেই অনুপস্থিত। এবং পরবর্তীতে রাশিয়াকে বহিস্কার, জার্মানি ও ইতালির সরে যাওয়া লীগ অফ নেশন্সের সাধ্যতাকে প্রশ্নের মুখোমুখী ফেলে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ দুনিয়ায় যখন শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে তখন যদি দেখা যায় যে পরাশক্তিগুলোই সেই উদ্যোগের শামিল নয়, তখন সেটি কার্যকর করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে দাঁড়ায়।
এর পাশাপাশি লীগ অফ নেশন্সের কনফারেন্স ভিত্তিক অ্যাম্বাসেডর মেয়াদকাল অতিবাহিত হওয়ার পরও কাজ করতে থাকে। এই অ্যাম্বাসেডরদের মেয়াদকাল ছিল সংস্থার কাঠামো তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত। এতে করে লীগ অফ নেশন্সের মূল অংশ এবং এই অংশের সাথে মতের বিরোধ দেখা যায় যেমনটা লিথুনিয়া ও পোল্যান্ডের মধ্যে ভিলনিয়া শহরের বিরোধের ক্ষেত্রে ফুটে উঠে। একপক্ষ শহরটিকে লিথুনিয়ার এবং অপরপক্ষ পোল্যান্ডকে দেওয়ার মতামত দেয়।
আরো কিছু দূর্বলতা এই সংস্থাটিকে পতনের দিকে ধাবিত করে।
- তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতাঃ এক্ষেত্রে লীগ অফ নেশন্স যেকোন সিদ্ধান্তে সর্বসম্মত হওয়ার প্রয়োজন থাকলেও তা কখনোই সম্ভব হয়নি ।
- সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধ্যকতা না থাকাঃ যদিও লীগ অফ নেশন্স সিদ্ধান্ত নিত যে অন্য কোন দেশকে সেনা দিয়ে সহায়তা করবে, তখন সব দেশ এটি করতে বাধ্য ছিল না। কোন দেশ না চাইলে জোর করে সাহায্যের আদেশ দেওয়া লীগ অফ নেশন্সের ছিল না। অর্থাৎ কোন দেশ যে চাপে কাজ করবে তার কোন এখতিয়ার ছিল না।
লীগ অফ নেশন্সের মূল লক্ষ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রতিরোধ করা। তারা সেটি করতে পরিপূর্ণভাবেই ব্যর্থতার পরিচয় দিলেও সেই সময়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থাও তাদের ব্যর্থতার কারণ বলে অনেকে মনে করেন। উক্ত সময়ে অর্থনৈতিক মন্দা, দুর্ভিক্ষ এবং এর ফলস্বরুপ কট্টরপন্থী ফ্যাসিবাদি, নাৎসিবাদী সরকার অবস্থাকে আরো বেগতিক করে তোলে। মূল কথা সবাই অবস্থার সুযোগ নেয় তো বটেই তার সাথে সাথে লীগ অফ নেশন্সের একতরফা আচরণও পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে বাধ্য করে।
Feature Image: The Guardian References 01. League of Nations. 02. The League of Nations: Destined for Failure. 03. Why Did the League of Nations Fail? 04. Paris Peace Treaties and the League of Nations, to 1933. 05. League of Nations.