জেনেপিল: মঙ্গোলিয়ার শেষ রাণি

591
0

মৃত‌্যদন্ড কার্যকর হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তার চোখে ভেসে ওঠে বিগত জীবনের সকল স্মৃতি। যিনি রাজবংশের অংশীদারই হতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু এই রাজবংশের জন‌্যই তার আজকের এই দিন দেখতে হচ্ছে। 

স্বামী এবং সন্তান থাকা সত্ত্বেও, ১৯ বছর বয়সে তাকে আবার বিয়ে করতে হয়েছিল এক ৫৩ বছরের অসুস্থ বৃদ্ধকে। সেখান থেকে শুরু হয় তার আরেক জীবন। বলা হয়ে থাকে, ভদ্রমহিলার সৌন্দর্যতার জন‌্য তার এই দ্বিতীয় বিয়েটি হয়েছে; যেখানে তার প্রথম স্বামী-সন্তানরা কোন অন্তরায় ছিলেন না।  

তিনি এমন একজন নারী যার পোশাক পরিচ্ছেদ থেকে পরবর্তীতে অনুপ্রাণিত হয়ে, নির্মিত স্টার ওয়ারস: দ্য ফ্যান্টম মেনেস এর রাণি অ্যামিডালার সিনেট গাউনের ডিজাইন করা হয়। 

তিনি ছিলেন মঙ্গোলিয়ার শেষ রাণি জেনেপিল। তার পরিবারের সাথে তাকে মৃত‌্যুদন্ড দেওয়া হয় মাত্র ৩৩ বছর বয়সে। ধারণা করা হয়, যে অভিযোগের জন‌্য তাকে মৃত‌্যুদন্ড দেওয়া হয় আদতে তার কোন ভিত্তি ছিল না। কেনই বা সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল এবং কেনই বা তাকে মৃত‌্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল তা জানতে হলে যেতে হবে প্রায় ১০০ বছর আগে। যেখানে ঘটেছিল ঘটনার সূত্রপাত, তাহলেই জানা যাবে কেন হলো তার এমন ভাগ‌্য? 

রাণী জেনেপিলের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করা হয় স্টার ওয়ারস: দ্য ফ্যান্টম মেনেস এর রানী অ্যামিডালার সিনেট গাউন। Image Source: jetsettimes.com

শেষ খান বোগদ খান 

মঙ্গোলিয়ানদের শেষ খান ছিলেন বোগদ খান। চীনের রাজবংশ ‘কিং’-দের থেকে মঙ্গোলিয়াকে স্বাধীনতা ঘোষণার পর তিনি ১৯১১ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ১৮৬৯ সালে তিব্বতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোট থাকা অবস্থাতেই বোগদ খানকে ভবিষ‌্যত আউটার মঙ্গোলিয়ার তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের আধ্যাত্মিক নেতা ‘বোগড গেজেন’-এর নতুন অবতার হিসাবে স্বীকৃত করা হয়। 

দালাই লামা এবং পঞ্চেন লামার পরে তিনি তিব্বতীয় শ্রেণিবিন‌্যাসের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব‌্যক্তি, যাকে ‘জেবতসুন্দাম্বা খুতুক্ত’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। যিনি ছিলেন এই খেতাব প্রাপ্ত ৮ম ব‌্যক্তি। এরপর তাকে, মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উরগা (বর্তমানে উলানবাটার নামে পরিচিত) নিয়ে যাওয়া হয, পরবর্তীতে তিনি তার বাকি জীবন মঙ্গোলিয়ায় কাটিয়েছিলেন। 

তার অল্প বয়স হওয়া সত্ত্বেও, একবার তিনি উরগায় ছিলেন, সেখানে তিনি মঙ্গোলিয়ায় অবস্থিত কিং রাজ বংশের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক কৌশলের শিকার হোন। পরবর্তীতে তাকে মঙ্গোলিয়ান কমিউনিস্টদের ভিত্তিহীন প্রচারণার আক্রমণও মোকাবেলা করতে হয়। 

কিং রাজবংশ ইতিমধ্যেই চীনা সরকারকে সংস্কার করতে এবং বিদেশী আগ্রাসনকে প্রতিহত করার জন্য সংগ্রাম করছে, মঙ্গোল সম্ভ্রান্তরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে স্বাধীনতার দিকে কাজ করার সময় এসেছে। তারা জেবতসুন্দাম্বা খুতুক্টুকে রাজি করান স্বাধীনতার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য অভিজাত ও কর্মকর্তাদের সাথে একটি সভা ডাকতে। 

মঙ্গোলিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। Image Source: wikimedia.com

১৯১১ সালের ১০ অক্টোবর সিনহাই বিপ্লবের শুরুতে, মঙ্গোলরা ১৯১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। একই দিনে, জেবতসুন্দাম্বা খুতুক্টুকে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন মঙ্গোলিয়ার ধর্মতান্ত্রিক সার্বভৌম বোগদ খান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। 

এরই মধ‌্যে বোগদ খান এক ছেলে সন্তানসহ দাম্পত‌্য জীবন পার করছিলেন। তার এই দাম্পত‌্য জীবনের শুরু হয় ১৯০২ সালে তার স্ত্রী সেনডিন ডন্ডোগডুলামের সাথে। ১৯২৩ সালের ৪৭ বছর বয়সে বোগদ খানের প্রথম স্ত্রী সেনডিন ডন্ডোগডুলামের মৃত‌্যু হয়। তার আগে ১৯১৯ সালে চীনা সৈন‌্যরা আবার দেশে প্রবেশ করেন এবং বোগদ খানকে শাসকের আসন থেকে অপসারণ করা হয় এবং গৃহবন্দী করা হয়। 

১৯২১ সালে, মঙ্গোলিয়া তার নিজস্ব বিপ্লব অনুভব করেছিল, রাশিয়ান বিপ্লব দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। এরপরে, গৃহবন্দী থাকা বোগদ খানকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এবং পুনর্বহাল করা হয়েছিল তবে কেবল নামেমাত্র শাসক হিসেবে। যদিও তার স্ত্রীর মৃত্যু তাকে গভীরভাবে শোকাহত করেছিল। এরপরও ৫৩ বছর বয়সী একজন অসুস্থ মানুষ, তিনি অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, রাজতন্ত্রের ভাবমূর্তি বজায় রাখার জন‌্য তাকে জোর করা হয়েছিল। 

বোগদ খানের পরামর্শদাতারা তার নতুন পাত্রী নির্বাচনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রেখেছিলেন, এই প্রক্রিয়ায় তাকে কোন কথা বলা হয়নি। পাত্রীর অনুসন্ধানটি শুরু হয় ১৯২৩ সালের গ্রীষ্মে, এবং ‘নির্বাচিত একজন’ ছিলেন ১৯ বছর বয়সী সেয়েনপিল। 

বোগদ খান । Image Source : joyvspicer.com

সেয়েনপিল থেকে জেনেপিল

১৯০৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন সেয়েনপিল, তিনি উত্তর মঙ্গোলিয়ার বাল্ডান বিরিভেন নামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। যিনি মঙ্গোলিয়ার বৃহত্তম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মঠগুলির মধ্যে একটি মঠের আশেপাশে বসবাস করতেন। এটি সত্য যে, তিনি ইতিমধ্যেই স্বামী এবং সন্তানসহ তার দাম্পত‌্য জীবনে ছিলেন। তারপরও স্বামী সন্তান থাকা সত্ত্বেও বোগদ খানের স্ত্রী হতে তা বাধা হিসাবে বিবেচিত হয়নি। 

কারণ এটি সবারই জানা ছিল যে, খানের স্ত্রী হওয়া কেবল চেহারার জন্যই ছিল এবং বিবাহটি খুব সংক্ষিপ্ত হবে। কারণ সবাই আশা করছিল তার শারীরিক অবস্থার জন‌্য তিনি হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবেন না। এভাবেই তার সেয়েনপিল থেকে জেনেপিল হওয়ার যাত্রা শুরু হয়। 

বিয়ের রাতে জেনেপিলকে প্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার সময়, বোগদ খানের পরামর্শদাতারা তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি শীঘ্রই আবার তার প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যেতে পারবেন। বিয়ের পর তার নাম সেয়েনপিল থেকে জেনেপিল করা হয়। 

জেনেপিল তার ভাগ‌্য এবং অবস্থান সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতেন না। তিনি ধারণাও করতে পারেননি। তিনি প্রাসাদে গিয়ে দেখেন একজন ৫৩ বছর বয়সী বৃদ্ধ প্রায় অন্ধ, অচল এবং অসুস্থ। এভাবে দিন চলতে থাকলো। এরই মধ‌্যে এক বছর পার না হতেই ১৯২৪ সালের ১৭ এপ্রিল শেষ বোগদ খান মৃত‌্যুবরণ করেন।

রাণী জেনেপিল মাত্র এক বছর তার সহচারিনী হিসেবে ছিলেন এবং বোগদ খানের মৃত‌্যুর মাধ‌্যমে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়। বোগদ খানের উপদেষ্টাদের সাথে চুক্তি হয়েছিল যে, রাজার মৃত‌্যুর পর রাণি জেনেপিলকে তার পূর্বের স্বামীর ঘরে ফেরত পাঠানো হবে। কিন্তু তা আদৌ হয়েছিল কি না তা এখনো রহস‌্য। 

রাণী জেনেপিলের রঙিন ছবি । Image Source : tsemrinpoche.com

জেনেপিলের ভাগ‌্যবদল

রাজার মৃত‌্যুর পর তার বাকি জীবনটুকু যেভাবে পার করবেন ভেবেছিলেন তা হয়তো হয়নি। ১৯৩০ সালে দিকে আধুনিক মঙ্গোলিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারের একজন ব‌্যক্তির কাছেই ক্ষমতা ছিল। 

তিনি হলেন খোরলোগিন চোইবালসান, মঙ্গোলিয়ার তৎকালীন নেতা এবং মঙ্গোলিয়ান পিপলস আর্মির মার্শার যাকে ইতিহাসে প্রায়ই ‘মঙ্গোলিয়ার স্ট‌্যালিন’ নামেও আখ‌্যায়িত করা হয়েছে। 

১৯৩৭ এবং ১৯৩৯ সালের মধ‌্যে তিনি পুরো মঙ্গোলিয়া জুড়ে রাজতন্ত্র নির্মূল করছিলেন, যা সোভিয়েত ইউনিয়নে সংঘটিত স্ট‌্যালিনবাদী সম্প্রসারণের একটি উদ‌্যোগ ছিল। এই নির্মূলকরণ চলাকালীন সময় আনুমানিক ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজার) থেকে ৩৫,০০০ (পয়ঁত্রিশ হাজার) মঙ্গোলিয়ানদের মৃত‌্যু হয়। ধ্বংস হয় অসংখ্য স্থাপনা। 

যাদের মধ‌্যে ছিলেন অনেক বৌদ্ধ ধর্মযাজক, বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক এবং অনেক অভিজাত ব‌্যক্তি যাদেরকে ‘বিপ্লবের শত্রু’ বলে অভিযুক্ত করে হত‌্যা করা হয়। এর মধ‌্যে আওতাভুক্ত হোন রাণী জেনেপিল, রাজার প্রাক্তন সহধর্মিনী হিসেবে তাকেও অভিযুক্ত করা হয়। তার উপর অভিযোগ আনা হয়, জাপানের সহায়তায় একটি বিদ্রোহে অংশগ্রহণ এবং স্বেচ্ছায় কাজ করার। 

This 1913 photo shows exactly the kind of monastery destroyed by Joseph Stalin and his forces during the purges in the 1930s.
স্টালিনবাদী আগ্রাসনে ধ্বংস হয়ে যায় এরকম দৃষ্টিনন্দন অসংখ্য ধর্মীয় স্থাপনা। Image Source: thevintagenews.com

তিনি এবং তার পরিবারকে ১৯৩৭ সালে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু এই অভিযোগ যে সত‌্য তা আজও প্রমাণিত হয়নি। এবং নির্বিশেষ রাণি জেনেপিলকে তার পরিবারের সাথে ১৯৩৮ সালে মৃত‌্যুদন্ড দেওয়া হয়। মৃত‌্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৩৩ বছর এবং পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। 

তার মৃত‌্যুর পর পার হয়ে গেছে অনেকগুলো বছর এখনও রহস‌্য হয়ে আছে যে, বোগদ খানের মৃত‌্যুর পর তাকে প্রথম স্বামীর কাছে ফেরত পাঠানো হয় নাকি আবার বিয়ে করেন তিনি। আর জাপানের সহায়তায় বিদ্রোহে অংশগ্রহণের যেই অভিযোগ তা আদৌ সত‌্য কি না। রাজতন্ত্রে অংশ হওয়ার ইচ্ছা ছিল না এমন একজন নারীর জ‌ন‌্য এটি একটি করুণ পরিণতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

 

 

 

Feature Image: jetsettimes.com
References: 
01. Last Queen of Mongolia. 
02. The Mad Monarchist Consort Profile: Queen Genepil of Mongolia.  
03. THE END OF MONGOLIAN MONARCHY AND QUEEN GENEPIL. 
04. How Queen Genepil Of Mongolia Became An Inspiration.