লাসভেগাস….যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদা অঙ্গরাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর৷ হাজারো মানুষের স্বপ্নের স্থান৷ সংক্ষেপে একে ভেগাস বলেও ডাকা হয়৷ প্রায় ১১৭ বছর বয়সী এই শহরটি আমেরিকার ২৫তম জনপ্রিয় শহর৷ এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভ্রমনকৃত শহরগুলোর একটি৷ কিন্তু কেন এই শহর এত জনপ্রিয়? এই শহর সিন বা পাপের শহর নামে পরিচিত৷
এখানে রয়েছে অসংখ্য ক্যাসিনো ও ক্যাসিনো হোটেল৷ এই শহরটি যৌনতার জন্যও বিখ্যাত৷ সিন সিটিতে পতিতাবৃত্তি অহরহ দেখা যায়৷ রাস্তায় বের হলেই দেখা যাবে চোখ ধাধানো সৌন্দর্য নিয়ে মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে৷ তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে৷ আসলে প্রস্টিটিউটরা তাদের সম্ভাব্য ক্লায়েন্টদের বিভিন্ন রকমের আকার ইঙ্গিত দিয়ে আকৃষ্ট করতে চাচ্ছে৷
নেভাদাই যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র অঙ্গরাজ্য যেখানে পতিতাবৃত্তি বৈধ তবে শুধুমাত্র কয়েকটি কাউন্টিতে৷ কিন্তু লাস ভেগাস এর অন্তর্ভুক্ত নয়৷ তাই বলাই যায় লাস ভেগাসে পতিতাবৃতি অবৈধ৷ এখানে অসংখ্য ব্রথেলস দেখা যায় যেগুলো নেভাদার খালি মরুভুমিতে অবস্থিত এবং সিন সিটি থেকে অল্প দূরে৷
এখানে প্রায় প্রতিটি ক্যাসিনো ও হোটেলে রয়েছে বার৷ এমনকি অনেক ক্যাসিনো জুয়াড়ীদের জন্য বিনামূল্যে মদের ব্যবস্থা রাখে৷ তাই লাস ভেগাস অ্যালকোহলিকদের স্বর্গরাজ্য, একথা বলাই যায়৷
লাস ভেগাসের ইতিহাস
লাস ভেগাসের ইতিহাসটাও কিন্তু পাপের থেকেই শুরু৷ সংঘবদ্ধ অপরাধ বিরাজমান ছিল শহরটির জন্মের পর থেকেই৷ ২০ শতকের দিকে মব এক্টিভিটি দেখা যেত লাস ভেগাসের সর্বত্র৷ ফ্র্যাংক দেত্রা লাস ভেগাসে মব এক্টিভিটির উত্থান ঘটান৷ বেশিরভাগ বড় বড় হোটেল ও ক্যাসিনোগুলোও পরিচালিত হতো মবস্টারদের দ্বারা৷ এক্ষেত্রে বুগসি সিয়েগেল এর নামটা উল্লেখ করা যায়৷
পুরো নাম বেঞ্জামিন বুগসি সিয়েগেল, যাকে লাস ভেগাস উত্থানের নায়ক বলা যেতে পারে৷ মাইনিং শহর থেকে লাস ভেগাসকে জুয়ার স্বর্গ রাজ্য বানানোর জন্য সে জনপ্রিয়৷ গ্যাম্বলিং বা জুয়া ইন্ডাস্ট্রির উন্নতিতে তার অবদানের জন্য তাকে ফাদার অব লাস ভেগাস বলা হয়৷
লাস ভেগাসে বেশ কয়েকবার প্রতিষ্ঠিত ক্যাসিনো কিনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে বুগসি সিয়েগেল ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করে ফ্লেমিঙ্গো ক্যাসিনো ও হোটেল কিনে নেয় ১৯৪৬ সালে৷ ১৯৪৭ সালের ২০ জুন সিয়েগেল বেভারলি হিলস-এ গুলিবিদ্ধ হয় অপরিচিত গানম্যান দ্বারা৷ লস এঞ্জেলস-এর হলিওড ফরএভার সমাধিস্থলে তাকে কবর দেওয়া হয়৷
২০ শতকের শেষের দিকে শহরটির হর্তাকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এই পাপের শহরটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে এবং তারা খানিকটা সফল হয়৷ তাদের উদ্দেশ্য ছিল অ্যাডাল্ট এক্টিভিটি কমিয়ে লাস ভেগাসের সিন সিটি পরিচয় বাদ দিয়ে এর একটি সুন্দর ইমেজ তৈরী করা ও আরো বেশি পরিবারকে এখানে ভ্রমন করতে আনা৷ তখন থেকে লাস ভেগাসে শুধু ফ্যামিলি ইমেজের বিজ্ঞাপনই দেওয়া হয়৷ যাতে অনেকেই খানিকটা বিরোধিতা করে এটা বলে যে, লাস ভেগাসে অ্যাডাল্ট এক্টিভিটির বিজ্ঞাপনও দেওয়া দরকার, তবে সেটা সীমিত আকারে৷
লাস ভেগাসের বিখ্যাত সব খাবার
বর্তমানে লাস ভেগাস হয়ে উঠেছে ওয়ার্ল্ড ক্লাস কুলিনারি ডেস্টিনেশন৷ মডার্ণ ফ্লেয়ারের সাথে ক্ল্যাসিক আমেরিকান স্টাইলের মিল আপনার ভ্রমণকে করে তুলবে আরো উপভোগ্য৷ বলা হয় লাস ভেগাসে এসে জুয়ায় হেরে গেলেও খাবার খেয়ে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে৷ লাস ভেগাসে এসে যেসব খাবার না খেলেই নয় তার মধ্যে আছে- লাসাগনা, হাই রোলার, ট্রুফলস এন্ড বেকন, ম্যাকারনি এন্ড চিজ কার্বোনারা, ক্যান কন কোয়েসো, সুশি কাপকেক, ডার্টি কর্ন, ডার্ট ডগ এবং সেইজ ফ্রাইড চিকেন।
লাস ভেগাসের আকর্ষণ
মার্চ থেকে মে এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর হলো লাস ভেগাসে ভ্রমণ করার উপযুক্ত সময়৷ এ সময়ে প্রচুর ট্রাভেল ডিল ও অফার পাওয়া যায়৷ বিশেষ করে শীতের সময় এখানে বেশি পর্যটক আসে নিউ ইয়ার, সুপার বোউল কিংবা ভ্যালেন্টাইনকে উপলক্ষ্য করে৷
লাস ভেগাসে যে শুধু অ্যাডাল্ট এক্টিভিটিই হয় তা কিন্তু নয়৷ লাস ভেগাস ইতিহাস, ঐতিহ্য কিংবা সৌন্দর্যের দিক থেকেও আছে অনেকের পছন্দের তালিকায়৷ লাস ভেগাসের একটা বড় আকর্ষণ মব মিউজিয়াম৷ যার অফিসিয়াল নাম The National Meuseum of Organized Crime and Law Enforcement.
এখানে এনগেজিং, ইন্টারএক্টিভ প্রদর্শনী ও ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে আমেরিকার মব ইতিহাস তুলে ধরা হয়৷ যা থেকে সেই সময়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ফ্যাশন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়৷ আরেকটি মিউজিয়ামের কথা উল্লেখ করতেই হয়, সেটি হলো নিয়ন মিউজিয়াম৷ এটা ৭৭০ লাস ভেগাস, বৌলভার্ড নর্থে অবস্থিত৷
সারা বছর জুড়ে অসংখ্য পর্যটক এখানে ভ্রমণ করতে আসেন৷ বর্তমানে নিয়ন মিউজিয়াম তার সংগ্রহশালা উন্নত করতে ও শহরের ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ এখানে ঘুরতে আসলে পেয়ে যাবেন গাইডও,যারা আপনাকে পুরো মিউজিয়ামটা ঘুরে দেখতে সাহায্য করবে৷
লাস ভেগাসে ফ্রিতে উপভোগ করার মতো আরেকটি জায়গা হচ্ছে ক্যারোল শেলবি হেরিটেজ সেন্টার৷ লাস ভেগাসের অন্যতম আকর্ষণ এটি এবং সম্পূর্ণ ফ্রি৷ বছরের পর বছর সময় নিয়ে ক্যারোল শেলবি ৩০ টি ক্ল্যাসিক কারেন ডিজাইন তৈরী করেন এবং সেগুলোকে বাস্তবে রূপ দেন৷এখানে আপনি দেখতে পাবেন শোরুমের পেছনের ফ্যাক্টরি ফ্লোরে কিভাবে দক্ষ টেকনিশিয়ানরা নিজ হাতে কার তৈরী করছে৷
এবার লাস ভেগাসের কিছু হোটেল-মোটেলের নাম জেনে নেই যেখানে দর্শনার্থীরা থাকতে পারবেন৷ লাস ভেগাসের লাক্সারি হোটেলের মধ্যে Bellagio,Venetian,Caesars Palace অন্যতম৷ মিড লেভেলের মধ্যে আছে Treasure Island,Park MGM Las Vegas,The Hilton Grand Vacations Suits On The Las Vegas Strip. আপনি যদি সীমিত বাজেটের হোটেল মোটেল খুঁজেন তাহলে The Excalibur,Motel 6 Tropicana কিংবা The Travelodge by Wyndam Las Vegas Strip হতে পারে আপনার কাংখিত স্থান৷
লাস ভেগাসের ঘুরতে যাবেন অথচ স্ট্রিপ ভ্রমণে বের হবেন না,এমনটা ভাবা খানিকটা অবিশ্বাস্যই৷লাস ভেগাস বৌলভার্ড এর প্রায় আড়াই মাইল লম্বা সেন্ট্রাল সেকশন,যেটা শহরের উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত৷ এটাকেই মূলত স্ট্রিপ বলা হয়৷ লাস ভেগাসের নাম বললেই অনেকের মনে হয়তো এই স্ট্রিপের ছবিই প্রথমে ভেসে উঠবে৷
লাস ভেগাসের মোস্ট ডো’জ এর মধ্যে স্ট্রিপে হাঁটা অন্যতম৷ বিশেষ করে রাতে এই স্ট্রিপের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়ে যায়৷ চারপাশের উজ্জ্বল নিয়ন সাইনগুলো যেনো এই স্ট্রিপের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়,আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য৷মান্ডালে বে হোটেল থেকে ট্রেজার আইল্যান্ড হোটেল পর্যন্ত এই স্ট্রিপ বিস্তৃত৷
স্ট্রিপ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে লাস ভেগাসের ডাউনটাউনে ফ্রিমন্ট স্ট্রিট অবস্থিত৷ যা লাস ভেগাসের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ৷ ৫ টি ব্লকে ভাগ করা এই ফ্রিমন্ট স্ট্রিট ক্যানোপি এলইডি লাইড দিয়ে আলোকিত৷ যা আকাশে হরেক রকম রং এর মেলা ঘটায়৷ স্ট্রিট পারফরমারদের মনোমুগ্ধকর পারফরমেন্স আর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজন ফ্রিমন্ট স্ট্রিটের রাতকে করে তুলে আরো উপভোগ্য৷
The Mirage Hotel, স্ট্রিপে হাঁটতে গেলে খুব সহজেই নজরে পড়বে,লাস ভেগাসের আকর্ষণীয় রিসোর্টগুলোর মধ্যে একটি৷ এই রিসোর্টের সামনের অংশে রয়েছে একটি ভলকানো বা আগ্নেয়গিরি যেটা নিয়মিত বিরতিতে বিস্ফোরিত হয়৷ রাতের বেলায় এই আগ্নেয়গিরির লাল আগুন আর বিস্ফোরণ দেখা যায় স্ট্রিপ থেকেই,যা নি:সন্দেহে লাস ভেগাসের এক অনন্য আকর্ষণ৷
এই রিসোর্টের ভেতরের অংশে রয়েছে সিগফ্রিয়েড ও রয়ের সিক্রেট গার্ডেন এবং ডলফিনের আবাস৷ যদিও সিগফ্রিয়েড ও রয় বর্তমানে জীবিত নেই তারপরেও এখনো সেখানে সাদা বাঘ ও সিংহ সহ বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়৷ ডলফিনের আবাসটিতে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন গ্যালন এর পুলে বিশাল সংখ্যক ট্রেইন্ড ডলফিন রয়েছে,যারা দর্শনার্থীদের এন্টারটেইন করে৷
মান্ডালে বে এখানকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রিসোর্ট৷ যা স্ট্রিপের শেষাংশে দক্ষিণ পশ্চিমে লাক্সর হোটেলের কাছেই অবস্থিত৷ এই রিসোর্টটির মূল আকর্ষণ এর শার্ক রিফ অ্যাকুয়ারিয়াম৷প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার গ্যালন ট্যাংকে রয়েছে বিভিন্ন রকমের শার্ক বা হাঙ্গর,মাছ,সরিসৃপ,গ্রিন সি টার্টলস, এমনকি একটি কমোডো ড্রাগনও আছে৷ প্রায় ১৫ প্রজাতির ১০০ টি শার্ক সহ সবমিলিয়ে প্রায় ২০০০ প্রাণীর বসবাস এই অ্যাকুয়ারিয়াম এ৷ এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফিচার হলো শার্ক টানেল,যা দেখতে সারাবছর পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে৷
পুরো লাস ভেগাস শহরকে আরো ভালোভাবে দেখতে চাইলে আপনার জন্যই রয়েছে হেলিকপ্টার রাইড৷ বিশেষ করে যাদের হাতে সময় খুব কম কিন্তু আমেরিকার অন্যতম আকর্ষণীয় এই শহরকে ঘুরে দেখতে চান,তাদের জন্যই স্থানীয় বিভিন্ন কোম্পানি হেলিকপ্টার রাইডের ব্যবস্থা করেছে৷
গ্রেট ব্যাসিন, মোজাভে, সনোরান এবং চিহুয়াহুয়ান নামক ৪টি ডেজার্ট বা মরুভূমি রয়েছে লাস ভেগাসে৷ এছাড়াও, লাস ভেগাসে রয়েছে স্কাইডাইভিং এর ব্যবস্থা৷ সব মিলিয়ে লাস ভেগাস পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানগুলোর একটি, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়৷
Feature Image: pexels.com References: 01.http://planetware.com. 02.http://lasvegassun.com. 03.http://fslv.com. 04.http://delish.com.