রূপকুন্ডের অমীমাংসিত রহস্য: কঙ্কাল হ্রদ

636
0

১৯৪২ সালে টহলকারী এক ব্রিটিশ বনরক্ষী হিমালয়ের ত্রিশূল পর্বতমালার শৃঙ্গে একটি রহস্যজনক হ্রদের সন্ধান পান, যা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ১৬ হাজার ফুট উপরে এবং শ’খানেক মানবকঙ্কালে বিস্তৃত। জায়গাটি রূপকুন্ড লেক বা কঙ্কাল হ্রদ নামে পরিচিত। হ্রদটি ১৩০ ফুট চওড়া এবং ১০ ফুট গভীর। ঋতু ও আবহাওয়ার ভিত্তিতে হ্রদটি ছোট-বড় হয়। ফলে শীতকালে বরফের নিচে চাপা পড়ে থাকা মানবকঙ্কালগুলো গ্রীষ্মকালে ভেসে উঠে। বরফ গলে গেলে কঙ্কাল হ্রদে দেখা যায় ৬০০-৮০০টি মানব কঙ্কাল। এই সময় পর্যটকদের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠে এই হ্রদটি। পর্যটকদের এই আকর্ষণ ধরে রাখতে স্থানীয় সরকার এই হ্রদটির নাম দেন, রহস্যময় হ্রদ।

অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই জনমানব শূন্য এলাকায় এতগুলো কঙ্কাল এলো কিভাবে? এলাকার সবচেয়ে নিকটবর্তী যে গ্রাম সেখানে যেতেও সময় লেগে যায় প্রায় পাঁচদিন। তাহলে এতগুলো মানুষের দেহাবশেষ এখানে এলো কিভাবে? কারা নিয়ে এলো এদের? কেনোই বা তারা একসাথে এখানে আসলো প্রাণ দিতে? প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা আছে, আবার নেই’ও। অর্থাৎ এই রহস্যের সঠিক ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি।

কঙ্কালগুলো এতই পুরনো যে কিছু কিছু কঙ্কাল নিজেই বরফের মমিতে পরিণত হয়ে গেছে। তবে দীর্ঘসময়ে বরফে চাপা থাকার কারণে এগুলো একেবারে অক্ষত রয়েছে। ১৯৫৬ সালে কলকাতার এক নৃতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা সিদ্ধান্ত নেয় তারা রূপকুন্ড লেকের দেহাবশেষ নিয়ে গবেষণা করবেন। সেই উদ্দেশ্যে ত্রিশূল পর্বতে যাত্রাও করেন। কিন্তু তুষার ঝড়ের কারণে বানচাল হয়ে যায় তাদের সেই যাত্রা। কয়েকমাস পর তারা আবার একই উদ্দেশ্যে কঙ্কাল হ্রদে গিয়ে কঙ্কালের নমুনা নিয়ে আসতে সক্ষম হন। কিন্তু সেইসময় কার্বন ডেটিং গবেষণা এতটা উন্নত ছিলনা বলে সেই ফলাফলগুলো খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

কঙ্কাল হ্রদ; Image: archaeology wiki

পুরনো তত্ত্বমতে, ৮৭০ বছর আগে অতিরিক্ত বরফ পড়ার কারণে এক ভারতীয় রাজার পুরো পরিবার এবং রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়। এই কঙ্কালগুলো সেই রাজা, তার স্ত্রী এবং তাদের সহযোগীদের দেহাবশেষ। অপর একটি তত্ত্বানুসারে, ১৮৪১ সালে কিছু ভারতীয় সৈন্য তিব্বত আক্রমন করার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। তাই ফিরে আসার সময় রাজা তাদেরকে হত্যা করেন। আরেকটি তত্ত্বমতে ধারণা করা হয়, এটি একটি কবরস্থান। মহামারীতে কেউ মারা গেলে তাকে এখানে সমাধিস্থ করা হত।

কিন্তু এই মানব কঙ্কাল সম্বন্ধে স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য একটু ভিন্ন। তাদের মুখে মুখে প্রচলিত লোকসংগীতের মাধ্যমে জানা যায়, নন্দ নামক এক দেবীর কথা; যিনি অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন। তিনি তার শক্তি প্রয়োগ করে একদা একটি শক্তিশালী ঝড় তৈরি করেন, সেই ঝড়ে প্রাণ হারায় এই মানুষগুলো। ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ত্রিশূল পর্বতমালা শৃঙ্গে এই কঙ্কাল হ্রদের পাশাপাশি একটি মন্দিরেরও শিলালিপি পাওয়া গেছে। যা অষ্টম-দশম শতাব্দীর সময়কালের বলে নৃবিজ্ঞানীরা মনে করেন। তাই মনে করা হয়, এই মন্দিরে তীর্থ যাত্রাকালে যাত্রীরা তুষার ঝড়ের সম্মুখীন হয়ে মারা যায় এবং এই কঙ্কালগুলো তাদেরই দেহাবশেষ।

যেহেতু এই পর্বতশৃঙ্গে মন্দিরের শিলালিপি পাওয়া গেছে এবং এখনও তীর্থযাত্রার প্রথা প্রচলিত রয়েছে তাই তীর্থযাত্রায় এসে কিছু মানুষ (নন্দ দেবীর) তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে এবং দেহাবশেষগুলো সেই অমর তীর্থযাত্রীদের কঙ্কাল, এই তথ্যটিই বেশি গ্রহণযোগ্য।

Image: orissapost.com

১৯৭০ সালে উইলিয়াম স্যাক্স নামক নৃবিজ্ঞানের এক ছাত্র ভারতের এই রহস্যময় হ্রদের ব্যাপারে জানতে পারেন। কৌতুলহলবশত তিনি এই হ্রদ পরিদর্শন করেন এবং বেশ উৎফুল্ল হন। ফলে তিনি তার রিসার্চ টপিক হিসেবে বেছে নেন এই কঙ্কাল হ্রদ। রিসার্চের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে তিনি নন্দদেবীর তীর্থযাত্রাতেও অংশগ্রহণ করেন। স্যাক্স তার গবেষণার সকল জ্ঞানকে একীভূত করে ১৯৯১ সালে একটি বই লেখেন, মাউন্টেন গডেস শিরোনামে। বইটি প্রকাশ পাওয়ার পর বিশ্ববাসী মূলত এই রহস্যজনক হ্রদের ব্যাপারে ভালোভাবে জানতে পারে এবং রূপকুন্ড লেক হয়ে উঠে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র।

শুরু হয় কঙ্কাল হ্রদ নিয়ে আবার নতুন করে গবেষণা। ১৯৯১ সালের পর সাম্প্রতিককালে যে গবেষণাটি হয়েছে তাতে দেখা যায়, উদ্ধারকৃত বেশিরভাগ কঙ্কালের উচ্চতা সাধারণ মানুষের উচ্চতার চেয়ে বেশি এবং তাদের বয়সের ব্যবধান খুব একটি বেশি নয়। সকলেই প্রায় মধ্যবয়সী অর্থাৎ ৩৫-৪০ বছর বয়সের ছিলেন। কঙ্কালগুলোর নমুনায় কোন রোগেরও আলামত পাওয়া যায়নি। তাই সুস্পষ্টভাবেই বলা যায়, এইটা সমাধিস্থান ছিল না কখনোই। এই এলাকার যুদ্ধের কোন অস্ত্রেরও সন্ধান মেলেনি। সুতরাং এটাও সুনিশ্চিত যে, এখানে কখনো কোন সৈন্যদল আসেনি।

২০০৪ সালে অত্যধুনিক কার্বন ডেটিং পদ্ধতির মাধ্যমে আরেকটি গবেষণা চালানো হয় কঙ্কাল হ্রদের দেহাবশেষের উপর। যেখানে ৩৮টি নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়; যার মধ্যে ১৫টি নারী এবং ২৩টি পুরুষ। কিন্তু কোন শিশুর দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি। এই পরীক্ষায় প্রকাশ পায়, কোন শিলার আঘাতে প্রাণ হারায় মানুষগুলো। তাই বলা হয়, ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে মারা সম্ভাবনাই বেশী। এই গবেষণাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষজ্ঞ, টম হিঘাম রূপকুন্ডের নমুনাগুলো নিয়ে পুনরায় বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন, দেহাবশেষগুলো নব্বই দশকের এবং এরা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মারা গিয়েছিল।“

রূপকুন্ড লেকের দেহাবশেষ; Image: nytimes

গবেষণাটির ফলপ্রকাশের পর মানুষের বিশ্বাস একেবারে দৃঢ় হয় যে, মানুষগুলো তীর্থযাত্রায় যাওয়ার সময় তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে মারা গেছে। এর বছর কয়েক পরে কঙ্কালগুলোর ডিএনএ নিয়ে পুনরায় পরীক্ষা চালান কয়েকজন বিজ্ঞানীরা। পরীক্ষার ফলাফল যা আসে তা পুরোপুরি তাক লাগিয়ে দেয় বিশ্ববাসীকে। ভারতীয় বিজ্ঞানী ডক্টর নিরাজ রাই এবং হার্ভার্ড বিজ্ঞানী ডেভিড রেইখ এই গবেষণায় মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। তারা বলেন,

“কয়েকটি কঙ্কাল সপ্তম-দশম শতাব্দীর মধ্যে বিভিন্ন সময় মারা যাওয়া মানুষের এবং এরা সকলেই দক্ষিণ এশিয়ান বংশগতির চিহ্ন বহন করে। আবার, কিছু দেহাবশেষ প্রায় ১ হাজার ২০০ বছর পুরনো বলে ধারণা করা হয়। এগুলোর মধ্যে দুই ধরণের বৈশিষ্ট্য পরিক্ষলিত হয়। একটি পূর্ব এশিয়ান বংশগতির, আরেকটি পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের। কিন্তু সেই সময় এই এলাকায় ভূমধ্যসাগরীয়দের উপস্থিতি একেবারেই অসম্ভব ছিল।“

অতপর রহস্যময় হ্রদের রহস্যের জট খুলতে খুলতে আবার বন্ধ হয়ে যায়। তবে থেমে নেই, অদ্ভুত লেকটির রহস্য খোলাসা করার প্রয়াস। কিন্তু, ডক্টর রাই এবং রেইখের গবেষণার পরে কঙ্কাল হ্রদ নিয়ে আর কোন বিশেষ তথ্য বিজ্ঞানীরা প্রকাশ করতে পারেননি।

 

Feature Image: strangsounds.com
তথ্যসূত্রসমূহঃ
01. The mystery of India’s ‘lake of skeletons’.
02. The unsolved mystery of Skeleton Lake.
03. The mystery of Skeleton Lake.