ভারতীয় উপমহাদেশে অনেকধরনের পৌরাণিক কাহিনী বা মিথ প্রচলিত আছে। ঠিক তেমনি প্রাচীন তামিল সভ্যতায় অবস্থিত একটি পৌরাণিক হারিয়ে যাওয়া মহাদেশ হচ্ছে কুমারী কন্দম। এটি কারো কারো কাছে কুমারী নাড়ু নামেও পরিচিত। এটি ভারত মহাসাগরে ভারতের বর্তমান অবস্থানের দক্ষিণে অবস্থিত ছিল বলে ধারণা করা হয় ।
এই মহাদেশটি সমুদ্রের নীচে নিমজ্জিত ছিল এবং উনিশ শতকের শেষের দিকে এর অস্তিত্ব সামনে চলে আসার পর থেকে একে নিয়ে অনেক জল্পনা, পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া কুমারী কন্দম নামক এই মহাদেশ নিয়েই আজকের এই ফিচার।
ইতিহাস
উনিশ শতকের শেষের দিকে কিছু আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ান স্কলারগণ আফ্রিকা, ভারত, মাদাগাস্কার এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভূতাত্ত্বিক এবং অন্যান্য দিক থেকে সাদৃশ্য ব্যাখ্যা করার জন্য লেমুরিয়ার হারিয়ে যাওয়া মহাদেশ নিয়ে একটি ধারণা দিয়েছিলেন।
এই হারিয়ে যাওয়া মহাদেশের উপস্থিতি কিছু তামিল রচনাতেও উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীতে এই নিমজ্জিত মহাদেশকে বোঝাতে ‘কুমারী কন্দম’ শব্দটি ব্যবহার করা শুরু হয়। তামিল ন্যাশনালিস্টদের আরেকটি দলের মতে, কুমারী কন্দম শব্দটি সর্বপ্রথম পনের শতকের দিকে কান্দা পুরানামে আবির্ভূত হয়েছিল, যা স্কন্দ পুরাণমের তামিল সংস্করণ।
কিছু চাইনিজ এবং গ্রীক লিটারেচারেও কুমারি কন্দম সম্পর্কে অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। পাহাড়ুলি নদী, পেরু নদী এবং মেরু পর্বত (৪৯টি চূড়া সহ) যেখান থেকে কুমারী নদী, পেরু নদী এবং পাহরুলি নদীর উৎপত্তি হয়েছিল। কথিত আছে যে চীনা শ্রমিকরা পান্ডিয়ান রাজার দ্বারা নিযুক্ত ছিল এবং যখন তারা খনিতে নামতো তখন তাদের ছোট পিঁপড়ার বিশাল সেনাবাহিনীর মতো দেখা যেত। তাই তাদের বলা হত পোন থোন্ডি এরম্বুকাল (সোনার খনির পিঁপড়া)। এটি প্রাচীন চীনা ইতিহাস দ্বারাও নিশ্চিত করা হয়েছে।
আনুমানিক সাড়ে তিনশ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, মেগাস্থেনিস নামক হেলেনিস্টিক যুগে একজন গ্রীক নৃতাত্ত্বিক এবং অনুসন্ধানকারী ভারতে তাঁর ভ্রমণের বিবরণ, ইন্দিকা রচনাটি রচনা করেছিলেন। তিনি সেখানে উল্লেখ করেছেন যে তাপরোবান যা বর্তমানে শ্রীলঙ্কা হিসেবে পরিচিত একটি নদী দ্বারা ভারতীয় উপদ্বীপের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, শ্রীলঙ্কা একটি ছোট স্থলভাগ দ্বারা ভারতীয় উপদ্বীপের সাথে সংযুক্ত হতে পারতো কিন্তু তাদের থামিরাবারানী নদী বিভক্ত করে।
ভৌগলিক অবস্থান
পনের শতকের তামিল গাণিতিক কানাক্কাথিকারম তার এক কাব্যিক সাহিত্যকর্মে ১ কাভাতম (১ কাতাম) এর দৈর্ঘ্যকে ২৪ হাজার মুজহাম (৩৩ হাজার ফুট, ৬৪ মাইল) হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে এবং এটিকে আবৃত করতে ৭.৫ নাজিগাল বা ১ সামাম (৩ ঘন্টার সমতুল্য) লাগে। যা স্বাভাবিক হাঁটার গতির মাধ্যমে কভার করা যায়।
এই ভূমিটি ৪৯ টি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল, যার নাম তিনি সাতটি নারকেল অঞ্চল (এলুটেঙ্গা নাটু) হিসাবে রেখেছেন। সাতটি মাদুরাই অঞ্চল (ইলুম্যাচারাল নাটু), সাতটি পুরানো বালুকাময় অঞ্চল (ইলুমুনপালাই নাটু), সাতটি নতুন বালুকাময় অঞ্চল (ইলুপিনপালাল নাটু), সাতটি পর্বত অঞ্চল (ইলুকুনরা নাটু), সাতটি পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চল (ইলুকুনাকরই নাটু) এবং সাতটি বামন- পামলুম অঞ্চল নাটু)। এই সমস্ত জমি, কুমারীকোল্লাম থেকে শুরু হওয়া বহু-পাহাড়ের জমি, বন ও বাসস্থান সহ, সমুদ্র দ্বারা নিমজ্জিত হয়েছিল। এই অঞ্চলগুলির মধ্যে দুটি ছিল বর্তমান কোল্লাম এবং কন্যাকুমারী জেলার অংশ।
আরেকজন তামিল সাহ্যিতিক সিলপ্পাধিকারমের মতে, দ্বিতীয় শতাব্দীতে লেখা তামিল সাহিত্যের পাঁচটি মহাকাব্যের একটিতে তিনি এভাবে আখ্যায়িত করেছিলেন যে নিষ্ঠুর সমুদ্র পান্ডিয়ানের জমি দখল করেছিল। যার একটি অংশ পাহাড়ুল নদী এবং কুমারী নদীর পাহাড়ী তীরগুলোর মধ্যে বিদ্যমান ছিল এই নদীগুলো নিমজ্জিত ভূমিতে প্রবাহিত হয়েছে বলে কথিত আছে।
মহাকাব্যের বারো শতকের ভাষ্যকার আদিয়র্ককুনাল্লার ব্যাখ্যা করেছেন যে, বর্তমান কন্যাকুমারীর দক্ষিণে এক সময় একটি ভূমি ছিল, যা উত্তরে পাহাড়ুলি নদী থেকে কুমারী নদী পর্যন্ত ৭০০ কাবটম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দক্ষিণ পরিমাপের আধুনিক সমতুল্য কাভাতম, যা তামিল ভাষায় কাতাম নামেও পরিচিত, এর দূরত্ব ৬ দশমিক ২৫ মাইল (১০ দশমিক ০৬ কিমি)।
কুমারী কন্দমের ঐতিহ্য অনুসারে, প্রায় ১১ হাজার বছরের সময়কালে, তামিল রাজাদের একটি ঐতিহাসিক রাজবংশ পান্ডিয়ান তাদের প্রজাদের মধ্যে জ্ঞান, সাহিত্য এবং কবিতার প্রতি ভালবাসা বৃদ্ধির জন্য তিনটি তামিল সঙ্গম গঠন করেছিল। এই সঙ্গমগুলো ছিল তামিল সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এবং তাদের মূলমন্ত্র ছিল তামিল ভাষা ও সাহিত্যের পরিপূর্ণতা।
প্রথম দুটি সঙ্গম বর্তমানে দক্ষিণ ভারতে অবস্থিত ছিল না, তবে দক্ষিণে পূর্ববর্তী তামিল ভূমিতে অবস্থিত ছিল যা প্রাচীনকালে কুমারী কন্দম নামে পরিচিত ছিল, আক্ষরিক অর্থে ভার্জিন বা ভার্জিন মহাদেশের দেশ। প্রথম সঙ্গম (মুতারকারকম) হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে এটি পান্ডিয়ান রাজার রাজধানী শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
মাদুরাই (কদল কোন্ডা তারপর মাদুরাই – যার অর্থ দক্ষিণ মাদুরাই যা সমুদ্রে নিমজ্জিত ছিল। পুরানো মাদুরাইকে তৃতীয় সঙ্গমের রাজধানী মাদুরাইয়ের সাথে পার্থক্য করার জন্য দক্ষিণ মাদুরাই নামে ডাকা হয়েছিল), যা মোট ৪৪৪০ বছর স্থায়ী হয়েছিল এবং ৫৪৯ জন সদস্য ছিল, যার মধ্যে শিব, কুবের এবং মুরুগানের মতো হিন্দু দেবতাদের কিছু দেবতা অন্তর্ভুক্ত ছিল। মোট ৪৪৪৯ জন কবি এই সঙ্গমের জন্য গান রচনা করেছেন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কায়সিনা ভালুদি থেকে শুরু করে ৮৯ জন পান্ডিয়ান রাজা ছিলেন। কাডুনগন ছিলেন সেই সময়ের বংশধর এবং শাসক।
দ্বিতীয় সঙ্গম (ইরান্দাম কনকাম, ইতাইকাঙ্কাম) তৎকালীন কাপাতাপুরমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পান্ডিয়ান রাজার রাজধানী শহর ছিল এটি। এই সঙ্গম ৩৭০০ বছর ধরে চলে এবং ৫৯ জন সদস্য ছিল। পান্ডিয়ান রাজা ছিলেন ছিলেন সেই সময়ের বংশধর ও শাসক। এই শহরটিও সমুদ্রে তলিয়ে গিয়েছিল। রামায়ণ এবং কৌটল্যের অর্থশাস্ত্র কাবতপুরম নামে একটি শহরের অস্তিত্বকে সমর্থন করে।
তৃতীয় সঙ্গম (মুনড্রাম ক্যাঙ্কাম, কাতাইকাঙ্কাম) বর্তমান মাদুরাই শহরে অবস্থিত ছিল, পান্ডিয়ান রাজার তৎকালীন রাজধানী শহর এবং এটি ১৮৫০ বছর ধরে চলেছিল। মুদাত্তিরুমারন (যিনি কাবাদপুরম থেকে বর্তমান মাদুরাইতে এসেছিলেন) থেকে শুরু করে উকিরাপেরু ভালুদি পর্যন্ত ৪৯ জন পান্ডিয়ান রাজা ছিলেন সেই সময়ের বংশধর ও শাসক। ৪৯ জন সদস্য ছিল এবং ৪৪৯ জন কবি সঙ্গমে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
কুমারী কন্দম নিয়ে কিছু মিথ
কুমারী কন্দম নিয়ে বেশ কিছু মিথ প্রচলিত রয়েছে, বিংশ শতাব্দীতে তামিল পুনরুজ্জীবনবাদীরা বিশ্বাস করতেন কুমারী কন্দম সেই জায়গা যেখানে প্রথম দুটি তামিল সঙ্গম সংগঠিত হয়েছিল। তারা এটিকে সভ্যতার দোলনা বলেও দাবি করেছিল যা তামিল সংস্কৃতি এবং ভাষার ঐতিহ্যকে প্রতিনিধিত্ব করে।
অনেক লোক বিশ্বাস করে যে পান্ডিয়ান রাজারা সমগ্র ভারতীয় মহাদেশ শাসন করতেন এবং তামিল সভ্যতা বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা। কেউ কেউ দাবি করেছেন যে হারিয়ে যাওয়া মহাদেশের নিমজ্জিত হওয়ার পরে, এর বাসিন্দারা বিভিন্ন সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন শুরু করে।
কুমারী কন্দমের অস্তিত্বকে সমর্থন করার আরেকটি প্রমাণ হল অ্যাডামস ব্রিজ (যাকে রামার সেতুও বলা হয়), বালি, পলি এবং ছোট নুড়ি দিয়ে তৈরি চুনাপাথরের একটি শৃঙ্খল যা ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত ১৮ মাইল বিস্তৃত পাল্ক স্ট্রেটে অবস্থিত। ভূমির এই স্ট্রিপটিকে একসময় প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হয়েছে বলে মনে করা হতো, তবে, অন্যরা যুক্তি দেখান যে NASA স্যাটেলাইট দ্বারা তোলা চিত্রগুলি এই ভূমি গঠনটিকে সমুদ্রের পৃষ্ঠের নীচে একটি দীর্ঘ ভাঙা সেতু হিসাবে চিত্রিত করে।
Sources:
- The Lost Continent of Kumari Kandam
- Kumari Kandam – Geographical Evidence of the Lost Continent on Earth
- Kumari Kandam: A Myth or Lost Continent
- Kumari Kandam- The Lost Continent