পনেরো শতকের শেষের দিকের ঘটনা। জাপানিজ শোগুন আশিকাগা ইয়োশিমাসার প্রিয় চাইনিজ চায়ের একটি বাটি ভেঙে যায়। তিনি বাটিটি মেরামত করানোর উদ্দেশ্যে চীনে পাঠান। কিন্তু চীন হতে মেরামত করে পাঠানো ভাঙা বাটিটি স্ট্যাপল দিয়ে ঠিক করানোর ফলে দেখতে আরো বাজে লাগছিল। স্ট্যাপল মূলত এমন একটি কৌশল যেখানে ভাঙা টুকরোগুলোকে ড্রিল করে পাশাপাশি জোড়া লাগানো হয়ে থাকে।
ইয়োশিমাসা চায়ের বাটিটিকে আরো সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলার জন্য জাপানি কারিগরদের খবর পাঠান, তারাও এমন এক অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যা শুধু নান্দনিকভাবে আনন্দদায়কই নয়, বরং জীবনের এক বড় অর্থ বহন করে। মূলত সুন্দর এই অভিনব পদ্ধতিটিই ছিল ‘কিনৎসুগি’।
কিনৎসুগি কী?
কাব্যিকভাবে নাম দেয়া ‘গোল্ডেন জয়েনারি’, কিনৎসুগি বা কিনৎসুকুরোই হলো জাপানি শিল্প যেখানে ভাঙা মৃৎপাত্রকে আঠালো পদার্থ দিয়ে জোড়া না দিয়ে, উরুশি বার্ণিশের ধুলো বা গুঁড়ো সোনা, রূপা বা প্ল্যাটিনাম দিয়ে মেরামত করা হয়।
জাপানি উরুশি বার্ণিশ মূলত উরুশি গাছের রস থেকে তৈরি করা হয় এবং প্রায় ২৪০০ খ্রিস্টাব্দ হতে জাপানে এর ব্যবহার চলে আসছে। শতাব্দী পুরোনো এই কৌশলটি প্রায়শই যেমন ভেঙে যাওয়া বস্তুর ফাটলগুলোকে সুন্দর ও মূল্যবান করে তোলে, ঠিক তেমনি একটি বস্তুর ইতিহাসকে আরো দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে সহায়তা করে।
কিনৎসুগি শিল্পের মাধ্যমে ভেঙে যাওয়া মৃৎপাত্রগুলোর ফাটলের দাগ লুকিয়ে রাখার পরিবর্তে এই ভাঙনকে সবার সামনে আরো সুন্দরভাবে উন্মোচিত করে তুলে। অপূর্ণতাই যে সৌন্দর্যের এক বড় রহস্য এই কথাটাই যেন বারবার জানান দিয়ে থাকে কিনৎসুগি শিল্প।
যেভাবে কিনৎসুগি শিল্প ছড়িয়ে পড়ে
পনেরো শতকের ইয়োশিমাসার চায়ের বাটি ভেঙে যাওয়ার দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে কিনৎসুগির জন্ম হওয়ার পর এই শিল্পটি ধীরে ধীরে সাধারণ জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সতেরো শতকের সময়ে, জাপানে কিনৎসুগির ব্যবহার বেশি থাকায় এটি একটি সাধারণ শিল্প হিসেবে রয়ে যায়।
ফ্রিয়ার গ্যালারি অব আর্ট এবং আর্থার এম. স্যাক্লার গ্যালারির সিরামিকের কিউরেটর, লুইস কোর্টের মতে, সতেরো শতকের এই সময়েই একজন জাপানি যোদ্ধা জনপ্রিয়তা লাভ করার উদ্দেশ্যে কুখ্যাতভাবে মানসম্পন্ন চায়ের বাটি ক্রয় করে ভেঙে ফেলতেন এবং কিনৎসুগি কৌশলে আবার মেরামত করতেন।
এর মাধ্যমে জানা যায় যে, সতেরো শতকে ভাঙা জিনিস মেরামত করার জন্য কিনৎসুগি একটি সাধারণভাবে ব্যবহৃত কৌশল ছিল এবং চায়ের পাত্র তৈরির জন্যে সিরামিকের ব্যবহার বহুল প্রচলিত ছিল।
কিনৎসুগির সাথে ওয়াবি-সাবি’র যোগসূত্র
কিনৎসুগি নান্দনিক শিল্পের নীতি হিসেবে প্রচলিত হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত দার্শনিক ধারণাগুলোকে উপস্থাপন করে আসছে। ঠিক যেমন, ওয়াবি-সাবি এর সাথে কিনৎসুগি শিল্পের সম্পর্ক।
‘ওয়াবি’ সরলতা, অস্থিরতা, ত্রুটি এবং অপূর্ণতাকে প্রকাশ করে। অপরদিকে, ‘সাবি’ কোনো পদার্থ বা বস্তুর উপর সময়ের প্রভাব প্রদর্শন ও প্রকাশ করে থাকে। দুটো শব্দ একসাথে অর্থাৎ, ‘ওয়াবি-সাবি’ বার্ধক্য বয়স, ত্রুটি, এবং অপূর্ণতার প্রভাবে যে সৌন্দর্য লুকিয়ে রয়েছে তা নান্দনিকভাবে প্রকাশ করে থাকে। এটি মূলত প্রাকৃতিক বস্তু এবং প্রকৃতির শক্তি উভয়েরই প্রশংসা যা মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতিতে কোনোকিছুই বা কোনোরূপই চিরস্থায়ী নয়।
একইভাবে, সময়ের প্রভাবে একটি বস্তুর নষ্ট হয়ে যাওয়া কিংবা ভেঙে যাওয়ার পরেও বস্তুটিকে বর্জ্য হিসেবে ফেলে না দিয়ে, এর ভাঙন বা কমতিগুলোকে নিপুণতার সাথে ফুটিয়ে বস্তুটিকে নতুনভাবে গ্রহণ করা, ব্যবহার করাই কিনৎসুগি শিল্পের প্রধান উদ্দেশ্য।
বস্তুটির ভেঙে যাওয়া আবার মেরামত হয়ে ফিরে আসার পরেও ফাটলের দাগ থেকে যাওয়া যেন জীবনেরই একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে তুলে ধরে। কেননা বস্তুটির মেরামতের পর যেমন আরো সুন্দর আর মজবুত হয়ে উঠে, ঠিক তেমনই একজন মানুষও জীবনে ভেঙে পড়ে ঠিকই, কিন্তু আবার নতুন উদ্যমে আরো জোরালোভাবে জীবনের পথে চলতেও শুরু করে।
কিনৎসুগি শিল্পের সাথে ‘মুশিন’ এর সম্পর্ক
কিনৎসুগির সাথে জাপানের একটি বিখ্যাত দর্শন ‘মুশিন’ এর যোগসূত্র পাওয়া যায়। মুশিনে ‘মু’ বা ‘শূন্যতা’ সাধারণত একটি শূন্য মনকে বোঝায়। যেখানে একজন ব্যক্তির মন এমন পর্যায় পৌঁছায় যে ভয়, উদ্বেগ, যুদ্ধ, বিগ্রহ ইত্যাদি আবেগ তাকে কোনোভাবেই বিচলিত করতে পারে না।
একটি মুশিন মনে কোনোরূপ অহংকার কিংবা অন্য কোনো ধ্যান-ধারণাও থাকে না। এটি বিশুদ্ধ জ্ঞান এবং আত্মার নিখুঁত উপলব্ধি। মূলত মুশিনের ধারণা মানব জীবনে চলার পথে মাঝে মাঝে খাপ খাওয়াতে না পারা, নানারকম পরিবর্তন এবং ভাগ্যের ফয়সালাকে মেনে এগিয়ে যাওয়াকে নির্দেশ করে।
কিনৎসুগি শিল্প যেন মুশিনের ধারণাকে আরো দৃঢ় করে। কেননা মুশিনে যেমন জীবনের দুর্বিষহ মূহুর্তগুলোকে লুকিয়ে না রেখে, বরং সেগুলোকে মেনে নিয়ে চলার উপদেশ দেয়, ঠিক তেমনই কিনৎসুগি শিল্পেও বস্তুগুলোর ফাটল লুকিয়ে না রেখে সেগুলোকে নৈপুণ্যের সাথে ফুটিয়ে তোলা হয় এবং বস্তুটির মাঝে সৃষ্ট পরিবর্তনগুলোকে মেনে নেওয়ার মানসিকতাকে গড়ে তোলে।
কিনৎসুগি শিল্পের দৃষ্টিতে জীবনের দর্শন
কিনৎসুগি শিল্পে ভেঙে যাওয়া পাত্রকে যে প্রক্রিয়ায় মেরামত করা হয়, তাতে পাত্রের ফাটল বা অপূর্ণতাগুলো এক ভিন্ন আঙ্গিকের সৌন্দর্য দান করে। অপূর্ণতা এবং বিভিন্ন পরিবর্তনও যে জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম এবং এই বৈশিষ্ট্যগুলোর যে নিজস্ব সৌন্দর্য ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা বুঝতে সাহায্য করে।
বিংশ শতাব্দীর এই সময়ে একজন ব্যক্তির সমাজ, পরিবার, বন্ধুবান্ধবের নানারকম প্রত্যাশা পূরণ করার চাপে নিজের ইচ্ছাগুলো অপূর্ণই থেকে যায়। কঠিন এই জীবনে চলার পথে শত চেষ্টার পরেও ব্যক্তির হাজারো স্বপ্ন ভেঙে যায়। ব্যর্থতার এই অনুভূতিগুলো একসময় ব্যক্তিকে হতাশাগ্রস্ত করে ফেলে এবং ব্যক্তি নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে শুরু করে।
ব্যর্থতার এই অনুভূতিগুলো দীর্ঘস্থায়ী মানসিক বিপর্যয়ের কারণ হলেও এমন অনেক শিক্ষা, অনুশীলন এবং দর্শন রয়েছে যা একজন ব্যক্তির মনে পুনরায় আশা জাগানোর জন্য যথেষ্ট। এমনই একটি অনুশীলন হলো কিনৎসুগি শিল্প।
অপূর্ণতা, সোনালী ফাটল, যা নতুন বস্তুটিকে অনন্য করে তোলে। যখনই বস্তুটির মালিক এই সোনালী ফাটলগুলোর দিকে তাকাবেন, তখনই তার সফলভাবে কাটিয়ে উঠা ‘ব্যর্থতার’ মূহুর্তগুলো চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
বর্তমানের এই যুগে, অপূর্ণ জিনিসগুলোকে গ্রহণ এবং উদযাপন করতে শেখা খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। জীবনযাত্রায় পড়ে থাকা হতাশা আর ব্যর্থতার টুকরোগুলোকে কুড়িয়ে নিয়ে নতুন কিছুতে রূপান্তর করার মাধ্যমেই মানুষ এগিয়ে যেতে শিখে।
সেই নতুন জিনিসটি নিখুঁত নাও হতে পারে বা হয়তো যেভাবে কল্পনা করা হয়েছিল তেমনটা নাও হতে পারে, কিন্তু নতুন জিনিসটি অবশ্যই সুন্দর হবে। কেননা, ত্রুটিগুলোকে ঢেকে না রেখে সবার সামনে তুলে ধরার মাধ্যমেই সত্যিকারের আত্মপ্রকাশ নিহিত। আর আত্মপ্রকাশের মাধ্যমেই বৃদ্ধি পায় আত্মবিশ্বাসের।
কিনৎসুগি শিল্পের এই দর্শন জীবন পদ্ধতিতে প্রয়োগের মাধ্যমে নিজের অপূর্ণতাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ এবং ব্যর্থতাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। এই শিল্প শুধু বস্তুকেই অনন্য, মজবুত করে তোলে না বরং প্রতিটি মানুষকে আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ়ভাবে গড়ে উঠার শিক্ষা দেয়, যা বর্তমান যুগের জন্য অপরিহার্য।
Feature Image: onmanaroma.com References: 01. Kintsugi. 02. Kintsugi can help us navigate failure. 03. Kintsugi-Kintsukuroi.